সামাজিক সংগঠন কাকে বলে ? সামাজিক সংগঠনের বৈশিষ্টগুলি লেখ।

by - November 26, 2022

সামাজিক সংগঠন কাকে বলে ? সামাজিক সংগঠনের বৈশিষ্টগুলি লেখ। 

সামাজিক সংগঠনের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট। 




সামাজিক সংগঠনের ধারণা / সংজ্ঞা :- 


সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গ সকলেই নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্য একে - অপরের উপর নির্ভরশীল এই প্রয়োজনগুলি বিবিধ ও বহুমুখী। প্রয়োজনগুলি মূলতঃ তিন প্রকার - জৈবিক , মানসিক ও সামাজিক। এই প্রয়োজনগুলি পূরণের উদ্দেশ্যে মানুষ সামাজিক সংগঠন তৈরী করে। সামাজিক সংগঠনগুলি মানুষের এইসকল প্রয়োজন পূরণ করে। এই সামাজিক সংগঠনগুলি মানুষ নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে কৃত্রিমভাবে সামাজিক সংগঠনগুলি তৈরী করে। 

চার্লস হর্টন কুলি বলেছেন , মানুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়ার ফলাফল হিসাবে সামাজিক সংগঠনের জন্ম হয় এবং সামাজিক সংগঠনগুলি পারস্পরিক ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের প্রয়োজন পূরণ করে থাকে। 

জনসন বলেছেন , সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বর্তমান এবং তাদের চাহিদা বহুমুখী। এই বহুমুখী চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে সামাজিক আন্তঃক্রিয়ার ফল হিসাবে সামাজিক সংগঠনের জন্ম হয়। 

অগাস্ট কোঁত বলেছেন , মানুষ তার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য পূরণের তাগিদে '' সাধারণ সামাজিক চুক্তি '' দ্বারা সামাজিক সংগঠনগুলির জন্ম দেয়। 

এমিল ডুরখেইম বলেছেন , সামাজিক সংগঠনগুলি নীতি ও মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। 

সমাজতাত্ত্বিকগণ প্রদত্ত সংজ্ঞা থেকে একথা বলা যায় যে , সামাজিক সংগঠনগুলি মানুষের প্রয়োজন পূরণের তাগিদে কৃত্রিমভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সামাজিক সংগঠনগুলি রাজনৈতিক , সামাজিক , অর্থনৈতিক , শিক্ষামূলক , ধর্মীয় - ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। সামাজিক সংগঠনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল - বিদ্যালয় , ব্যাংক , মন্দির - মসজিদ - ইত্যাদি। 


সামাজিক সংগঠনের বৈশিষ্ট :- 


১. নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকেন্দ্রিক :- 
প্রতিটি সামাজিক সংগঠন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করেই গঠিত হয়। মানুষের নির্দিষ্ট প্রয়োজন পূরণ করাই হল সামাজিক সংগঠনগুলির প্রধান উদ্দেশ্য। সামাজিক সংগঠনগুলি মানুষের প্রয়োজন পূরণ করতে না পারলে তার অস্তিত্ব অর্থহীন হয়ে পরে। 

২. সদস্যদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও সহযোগিতা :- 
সামাজিক সংগঠনগুলিতে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও সহযোগিতার মাধ্যমেই সামাজিক সংগঠনগুলি তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে সফল হয়। সদস্যদের সহযোগিতা ব্যতীত সামাজিক সংগঠন অচল হয়ে পড়ে। 

৩. ঐক্যমত :- 
সামাজিক সংগঠনের সদস্যদের ঐক্যমত্যতা সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করে। ঐক্যমত্যতার ভিত্তিতেই সামাজিক সংগঠনের সদস্যরা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার তাগিদে সহযোগী হিসাবে ভূমিকা পালন করে। 

৪. সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম :- 
সামাজিক সংগঠনগুলি সমাজ নিয়ন্ত্রনের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে। প্রতিটি সামাজিক সংগঠনের কিছু নির্দিষ্ট রীতিনীতি ও নিয়ম থাকে। এই সকল রীতিনীতি ও নিয়ম সমাজের ব্যক্তিবর্গের উপর প্রযুক্ত হয়। এইভাবে সামাজিক সংগঠনগুলি সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম হয়ে ওঠে। 


৫. নির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি :- 
প্রতিটি সামাজিক সংগঠন পরিচালিত হয় নির্দিষ্ট কর্ম - পদ্ধতি দ্বারা। সংগঠনের সদস্য ও সাধারণ মানুষ সকলেই নির্দিষ্ট পদ্ধতির মাধ্যমেই তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে। সামাজিক সংগঠনগুলির কর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রথাগত কর্ম পদ্ধতি ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করাকে অবৈধ বলে মনে করা হয়। 

৬. সংখ্যা :- 
সকল সমাজে এক ধরণের সামাজিক সংগঠন একই সংখ্যায় থাকেনা ; স্থান - কালভেদে সামাজিক সংগঠনগুলির সংখ্যার তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন ভারতের মত জনবহুল দেশে বিদ্যালয়ের সংখ্যা আর নাউরু , ঘানা - ইত্যাদি ক্ষুদ্র দেশগুলিতে বিদ্যালয়ের সংখ্যা কখনো এক হতে পারেনা। 

৭. মর্যাদাগত পার্থক্য :- 
সমাজে বিভিন্ন ধরণের সামাজিক সংগঠন থাকে। কিন্তু কর্মপরিধি , সংস্কৃতি , কাজের ধরণ - ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক সংগঠনগুলির মর্যাদার ক্ষেত্রে তারতম্য ঘটে। যেমন , রামকৃষ্ণ মিশনের সামাজিক মর্যাদা ও একটি ছোট্ট এলাকার উন্নয়ন সমিতির মধ্যে মর্যাদার বিস্তর পার্থক্য আছে ; যদিও উভয়ের উদ্দেশ্যই এক। 

৮. শ্রম - বিভাজন :- 
সমাজে অবস্থিত সকল সামাজিক সংগঠন এক প্রকারের হয়না। ভিন্ন ভিন্ন ধরণের সামাজিক সংগঠন ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে গঠিত হয়। এর ফলেই সামাজিক সংগঠনগুলির মধ্যে শ্রম বিভাজনের ধারণাটি সুস্পষ্টরূপে ফুটে ওঠে। 


৯. প্রকৃতি :- 
প্রতিটি সামাজিক সংগঠনের কাজের ধরণ তার প্রকৃতি নির্ধারণ করে। যেমন রেডক্রস সোসাইটির মূল কাজ হল রক্তদান শিবির আয়োজন করা ও সমাজে রক্তের অভাব পূরণ করা ; অর্থাৎ রেডক্রস সোসাইটি হল একটি জনস্বাস্থ্য ও জনকল্যাণমূলক সংগঠন। আবার বিদ্যালয়ের মূল কাজ হল সাক্ষরতার প্রসার ঘটানো , তাই বিদ্যালয়গুলি হল শিক্ষামূলক সামাজিক সংগঠন। 

১০. প্রকারভেদ :- 
সামাজিক সংগঠনগুলি প্রকৃতিগত দিক দিয়ে দুই প্রকারের হয়ে থাকে ; যথা - বিধিবদ্ধ ও অবিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠন। যেসকল সামাজিক সংগঠনগুলি সাধারণ উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরী হয়না ; নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে কৃত্রিমভাবে তৈরী হয় - সেগুলিকে বলে বিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠন। যেমন , বিদ্যালয়। 
আবার , অবিধিবদ্ধ সামাজিক সংগঠনগুলি হল সাধারণ উদ্দেশ্যযুক্ত এবং এগুলি স্বাভাবিকভাবে সৃষ্টি হয়। যেমন - বন্ধুত্বের সম্পর্ক , একজন ব্যক্তির সঙ্গে অপর ব্যক্তির সাধারণ মানবিক সম্পর্ক - ইত্যাদি। 

১১. বিশ্বজনীন :- 
সামাজিক সংগঠনগুলি বিশ্বজনীন। বিশ্বের প্রতিটি সমাজেই সামাজিক সংগঠনের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। প্রতিটি সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে মানুষ নিজ উদ্দেশ্যগুলিকে পূরণ করে। তাই প্রতিটি সমাজে সামাজিক সংগঠনের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। 

১২. পরিবর্তনশীল :- 
সামাজিক সংগঠনগুলি চরিত্র , প্রকৃতি ও কর্মপদ্ধতি পরিবর্তনশীল। যেমন , গত কয়েক দশকে বৈবাহিক সংগঠনের চরিত্রের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এছাড়াও বিদ্যালয়গুলিতে পঠন - পাঠন পদ্ধতি বিগত দশকের তুলনায় অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। 

পরিশেষে বলা যায় , সমাজে সামাজিক সংগঠনের উপস্থিতি ছাড়া সমাজ অচল হয়ে পড়বে , মানুষের উদ্দেশ্য ও চাহিদাগুলি পূরণ হবেনা। সামাজিক সংগঠনগুলিই সমাজকে সচল রাখে এবং সামাজিক বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

         

You May Also Like

0 comments