সাম্যের প্রকৃতি - পরিধি আলোচনা কর।

by - November 24, 2022

সাম্যের প্রকৃতি - পরিধি আলোচনা কর। 



সাম্যের প্রকৃতি ও পরিধি। 


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ১৭৭৬ এবং ফরাসি বিপ্লব প্রসূত মানবাধিকারের ঘোষণা ১৭৮৯ - এই দুটি মহান ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্রেই সাম্যের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সাম্য বলতে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে উপযোগী সকল প্রকার অনুকূল পরিবেশ রচনা এবং সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক প্রাপ্ত সকল প্রকার সুযোগ সুবিধার সমতাকে বোঝায়। বস্তুতঃপক্ষে মানুষের অধিকার , স্বাধীনতা ও সাম্য - এই তিনটি বিষয় পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত ; একটির অনুপস্থিতি অন্যগুলিকেও অর্থহীন করে তোলে। সাম্যের চরিত্র বা প্রকৃতিকে কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করা যেতে পারে। 


বিশেষ সুযোগ সুবিধার অনুপস্থিতি :- 
সাম্যের আদর্শ সমাজে অবস্থানকারী সকল প্রকার ব্যক্তির সমান সুযোগ সুবিধার কথা বলে এবং বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিশেষ সুযোগ সুবিধার কথা অস্বীকার করে। এ প্রসঙ্গে ল্যাস্কির অভিমত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ল্যাস্কির মতে , সাম্য বলতে কখনোই সকলের জন্য সমান ব্যবস্থাকে বোঝায় না ; সাম্য হল সমাজ ও রাষ্ট্র হতে প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধাগুলির সমবন্টন। সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত এই সুযোগ সুবিধাগুলি যদি কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয় , তাহলে সাম্যের আদর্শ অর্থহীন হয়ে পড়বে। তাই সাম্য সকল প্রকার পক্ষপাতিত্ব বর্জন করাকে বোঝায়। 

সুযোগ সুবিধার সমবন্টন ও পর্যাপ্ত সুবিধা প্রদান :- 
একটি সাম্যবাদী সমাজ নাগরিকদের অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে সমান সুযোগের ব্যবস্থা করে। কিন্তু নাগরিকদের সকলেই একই বৈশিষ্ট ও প্রকৃতির অধিকারী হয়না। তাই রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক প্রদত্ত্ব অধিকারগুলির সুব্যবহার যে সকলেই করবে - এমন কোনো কথা নেই। সাম্যের অধিকারগুলিকে সৎ উদ্দেশ্য ও অসৎ উদ্দেশ্য উভয়ভাবেই কাজে লাগানো যেতে পারে ; তবে এর দায় রাষ্ট্র বা সমাজের নয়। রাষ্ট্র বা সমাজ শুধুমাত্র নাগরিকদের সর্বোচ্চ বিকাশের আদর্শ পরিবেশ রচনা করে। 

আদিম সমাজে সাম্য :- 
আদিম সমাজ প্রকৃতিগতভাবে সাম্যবাদী ছিল। সেখানে উৎপাদিত ফসল ও প্রাকৃতিক সম্পদের কোনো ব্যক্তিমালিকানা ছিলনা। ফলে অধিকারভোগী ও অধিকারবিহীন - কোনো শ্রেণীরই অস্তিত্ব ছিলনা। নারীরাও সকল প্রকার সুযোগ সুবিধার সমান অধিকারিণী ছিলেন। কিন্তু কালক্রমে ব্যক্তিগত মালিকানার উদ্ভবের ফলে আদিম সমাজে সাম্যের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং সমাজে অধিকারভোগী ও অধিকারবিহীন শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। 

সামন্ততান্ত্রিক সমাজে সাম্য :- 
সামন্ততান্ত্রিক সমাজে বৈষম্যের চিত্রটি স্পষ্টরূপে ধরা পড়ে। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদন প্রক্রিয়ার দুটি মুখ্য উপাদান ছিল - ক্রীতদাস ও মালিক। ক্রীতদাস , কৃষক ও খেটে খাওয়া মানুষেরা সমাজের সকল প্রকার অধিকার ও সাম্য থেকে বঞ্চিত ছিল। তারা শোষিত হত মালিক বা সামন্তশ্রেণী কর্তৃক। মালিকদের স্বার্থেই সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালিত হত। তাই সামন্ততান্ত্রিক সমাজে ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সাম্যের প্রকাশ ছিল ক্ষীণ এবং সকল অধিকার মালিক ও শাসকেরা ভোগ করতো। 


পুঁজিবাদী সমাজে সাম্য :- 
তবে পরবর্তীকালে পুঁজিবাদী সমাজে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র , ব্রিটেন , ফ্রান্স ও ভারতে সাম্য নীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। তবে এর কারণ ছিল ভিন্ন। পুঁজিবাদী শক্তির সঙ্গে সামন্ততান্ত্রিক শক্তির বিরোধ বাঁধলে পুঁজিবাদী শক্তি সাধারণ মানুষের সমর্থনলাভের উদ্দেশ্যে সাম্যের আদর্শগুলোকে গ্রহণ করে। তবে পুঁজিবাদী সমাজে মালিক শ্রেণী নিজেদের স্বার্থেই সাম্য নীতিগুলিকে গ্রহণ করে। যেখানেই শ্রমিক বা সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে , সেখানে পুঁজিবাদী শ্রেণী সাম্যের অধিকারগুলিকে অস্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করেনি। পুঁজিবাদী সমাজে অর্থনতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত না থাকায় আইনের দৃষ্টিতে সাম্য প্রহসনে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে।    

গণতান্ত্রিক সমাজে সাম্য :- 
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ও সমাজে সাম্যের অধিকারগুলি তুলনামূলকভাবে অধিক সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক সমাজে জাতি - লিঙ্গ - ধর্ম - সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান - ক্ষমতা নির্বিশেষে সকলকে সমান অধিকার প্রদান করা হয়েছে। আইনের অনুশাসন ও আইনের দৃষ্টিতে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের চোখে সকলেই সমান এবং সকলেই আইন কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হন। উদাহরণ হিসাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের স্বীকৃতির কথা বলা যায়।

উদারনৈতিক সমাজতান্ত্রিক সমাজে সাম্য :- 
প্রকৃত সাম্য একমাত্র উদারনৈতিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিষ্টিত হতে পারে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভুত্বকারী বিশেষ কোনো শ্রেণীর সুযোগ - সুবিধা স্বীকৃত হয়না। এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় নীতি কখনোই পুঁজিপতিদের স্বার্থে প্রণীত হয়না এবং আইনগত সাম্য প্রকৃত অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত থাকায় সাম্য - স্বাধীনতা - সৌভাতৃত্ব বিকশিত হতে পারে এবং সকলে নিজের ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারে। 

মার্কসীয় দৃষ্টিতে সাম্য :-     
মার্কসবাদীরা মনে করেন ধনবৈষম্যমূলক ও শ্রেণীবিভক্ত সমাজে প্রকৃত সাম্যের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের বিলোপসাধনের মাধ্যমে সাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তাই মার্কসবাদীরা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। সমাজতান্ত্রিক সমাজে শোষণমূলক সকল উপাদানগুলোকে সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ন্ত্রণ করার ফলে নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। লেনিন সমাজ থেকে সর্বপ্রকার বৈষম্যের অবসানের কথা বলেছেন। 

ল্যাস্কির মতে সাম্য :- 
ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics এবং Liberty in Modern State - গ্রন্থদুটিতে সাম্যের ধারণা বিশ্লেষণ করেছেন। ল্যাস্কির মতে , সমাজে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন ক্ষমতা ও দক্ষতা , আগ্রহ - চাহিদা ও সামর্থ্য বর্তমান। তাই সবার জন্য সমান সুযোগ - সুবিধার অস্তিত্ব থাকা অনভিপ্রেত। সকলেই যে রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক প্রদত্ত সুযোগ - সুবিধার সদ্ব্যবহার করবে - এমনটা নয়। তাই রাষ্ট্র ব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে সকলে নিজের নিজের যোগ্যতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে পারে। 

বার্কারের মতে সাম্য :-  
বার্কার তাঁর Principles of Social and Political Theory - গ্রন্থে সাম্যের ধারণা ও নীতি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। বার্কারের মতে আইনগত সাম্য হল এমন এক ধরণের ব্যবস্থা যাতে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের সুযোগ - সুবিধা প্রদানের সময় কোনোপ্রকার বৈষম্য করে না ; একজন ব্যক্তি রাষ্ট্র কর্তৃক যেসকল সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত করেন ; তা অন্য সকলেও যাতে প্রাপ্ত করতে পারে - সেবিষয়ে লক্ষ্য রাখা হয়। বার্কার বৈধ বা আইনগত সাম্যকেই প্রকৃত সাম্য বলে মনে করেন। 

পরিশেষে বলা যায় , বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাগুলিতে যথার্থ ও প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠা কখনোই সম্ভব নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রযন্ত্র এক শ্রেণীর মানুষের বা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে উদ্যোগী থাকে এবং সাধারণের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়। এজাতীয় ব্যবস্থায় প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আবার প্রতিটি রাষ্ট্রে আইনগত সাম্যের কথা বলা হলেও বাস্তবে শাসক , পুঁজিবাদী , ক্ষমতাশালী - ইত্যাদি শ্রেণীর মানুষদেরকেই রাষ্ট্রের সকল অধিকার ভোগ করতে দেখা যায় , সাধারণ মানুষের স্বার্থ সেখানে উপেক্ষিত থেকে যায়।   

 

You May Also Like

1 comments