সংস্কৃতির সংজ্ঞা দাও। সংস্কৃতির বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর।

by - November 24, 2022

সংস্কৃতির সংজ্ঞা দাও। সংস্কৃতির বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর। 

সংস্কৃতির সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট। 

সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানগুলি সম্পর্কে আলোচনা কর। 




সংস্কৃতির সংজ্ঞা / সংস্কৃতির ধারণা :- 


সংস্কৃত শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Culture শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ Colere থেকে ; এর অর্থ কর্ষণ করা। একজন শিশু ছোটবেলা থেকে যা কিছু শেখে তার প্রায় সবকিছুই রপ্ত করে। এরপর অনুশীলনের দ্বারা শিশু সেই অভিজ্ঞতাকে আচার - আচরণের অঙ্গ করে তোলে। তাই সংকীর্ণ অর্থে সংস্কৃতি হল অভিজ্ঞতালাভ ও অনুশীলনের মাধ্যমে আয়ত্ত্ব করা বিষয়। 
আবার জার্মান ভাষায় সংস্কৃতি অর্থে Kultur শব্দটি ব্যবহার করা হত। এর অর্থ সুন্দর যাত্রা , ঘর , সাহিত্য ও অন্যান্য ভালো উপাদান। এটি হল সংস্কৃতির ব্যাপক অর্থ। এই অর্থে মানুষের জীবনের সবকিছুই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। 

ই বি টেলর বলেছেন , সমাজের সদস্য হিসাবে প্রতিটি মানুষ সমাজ থেকে জ্ঞান , বিশ্বাস , শিল্পকলা , নৈতিকতা , রীতিনীতি , আইন ও প্রথা , লোকাচার - লোকনীতি - ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়গুলি সম্পর্কে অবহিত হয় ও অভিজ্ঞতালাভ করে। এই সকল উপাদানের জটিল সমষ্টি হল সংস্কৃতি। 

ম্যাথু আরনল্ড বলেছেন , সংস্কৃতি হল পরিপূর্ণতা। মানব সমাজের সামগ্রিক দিক সংস্কৃতির মাধ্যমেই পরিচালিত ও আবর্তিত হয়।  

ম্যালিনস্কি বলেছেন , সংস্কৃতি হল মানুষের উদ্দেশ্য পূরণের একটি মাধ্যম। 

ম্যাকাইভার বলেছেন , আমরা যা , তা'ই হল সংস্কৃতি। 

লিনটন বলেছেন , সংস্কৃতি হল আচার - আচরণের সমষ্টি। 

উপরোক্ত বক্তব্যগুলিকে বিশ্লেষণ করলে বলা যায় , সংস্কৃতি এমন একটি বিষয় যা মানুষ সমাজ থেকে আয়ত্ত্ব করে , যা ব্যক্তিগত নয় - সর্বজনীন এবং যা মানুষের শিক্ষা - দীক্ষা , আচার - ব্যবহার , রীতিনীতি , প্রথা , লোকাচার , আনন্দ - উৎসব , সাধারণ জীবনযাত্রা - ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়র পরিচয় বহন করে। 


সংস্কৃতির বৈশিষ্ট / সংস্কৃতির উপাদান :- 


১. মানুষের প্রয়োজনভিত্তিক :- সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানগুলি মানুষের প্রয়োজনে রচিত হয়। যেসকল উপাদান মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়না , সেগুলি সাংস্কৃতিক উপাদানরূপে বিবেচিত হয়না। মানুষ নির্দিষ্ট অভাবের পরিপ্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট উপাদানগুলোকে সংস্কৃতির উপাদান হিসাবে গ্রহণ করে। 

২. বস্তুগত ও অবস্তুগত উপাদান :- সংস্কৃতির উপাদানগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় - বস্তুগত ও অবস্তুগত উপাদান। বিদ্যালয় , অফিস , মন্দির - ইত্যাদি হল বস্তুগত উপাদান। অন্যদিকে অবস্তুগত উপাদানগুলি হল মানসিক। অবস্তুগত উপাদানগুলির মধ্যে প্রধান হল - আদর্শ , নীতি , মূল্যবোধ , ধারণা , কল্পনা - ইত্যাদি। 

৩. ভিন্ন ভিন্ন সমাজে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা :- বর্তমান পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন সমাজে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। প্রতিটি সমাজের ধর্মবিশ্বাস , রীতিনীতি , আদর্শ - ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির হয়। তাই ভিন্ন ভিন্ন সমাজে সংস্কৃতির স্বতন্ত্রতা লক্ষ্য করা যায়। 

৪. সংস্কৃতিগত প্রলক্ষণ :- প্রতিটি মানব সমাজে কিছু সংস্কৃতিগত প্রলক্ষণ থাকে। মানুষের নিজেদের প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে এই প্রলক্ষণগুলি গড়ে ওঠে। যেমন খাদ্যের প্রয়োজনে রন্ধন প্রক্রিয়া , বিচারের প্রয়োজনে বিচারের প্রক্রিয়া - ইত্যাদি। 


৫. জন্মগত নয় :- সংস্কৃতি কখনোই ব্যক্তির জন্মগত নয় ; এটি শিক্ষা ও অনুশীলনের দ্বারা ব্যক্তি রপ্ত করে। একটি শিশু সমাজে জন্মানোর পর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংস্কৃতির উপাদানগুলোকে অভ্যাসে পরিণত করে। 

৬. সংস্কৃতি একটি সামাজিক বিষয় :- সংস্কৃতি বিষয়টি সামাজিক ; ব্যক্তিগত নয়। একজন মানুষ সামাজিক পরিবেশের মধ্যেই সংস্কৃতির উপাদানগুলোকে আয়ত্ত্ব করে ও অনুশীলনের মাধ্যমে সেগুলিকে নিজের আচার আচরণের অংশ করে তোলে। 

৭. পরিবর্তনশীল :- সংস্কৃতি দেশ ও কাল ভেদে পরিবর্তনশীল। সমাজের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতিরও বিবর্তন ঘটে। মানুষ প্রয়োজনীয় উপাদান বা বিষয়গুলোকে গ্রহণ করে ও অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলিকে বর্জন করে। আবার প্রয়োজনে নতুন নতুন সাংস্কৃতিক উপাদান সৃষ্টি করে। তাই সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল। 

৮. প্রবহমান :- সংস্কৃতি একটি প্রবহমান বিষয় এবং তা প্রজন্ম হতে প্রজন্ম প্রবাহিত হতে থাকে। সংস্কৃতির বিষয়গুলি কখনোই স্থির নয়। 

৯. বিশ্বাস ও মনোভাব :- বিশ্বাস ও মনোভাব হল সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সমাজে বসবাসকারী সকল মানুষ সামাজিক উপাদানগুলির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ঘটায় এবং এই মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমেই ব্যক্তিবর্গের সামাজিক বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বিশ্বাস ও নির্দিষ্ট মনোভাব তৈরী হয়। 

১০. নীতি ও মূল্যবোধের সহাবস্থান :- মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনে নীতি ও মূল্যবোধের পারস্পরিক সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়। নীতি ও মূল্যবোধ সংস্কৃতির ভিত্তি রচনা করে। আদর্শ জীবন ও সমাজ গঠনের লক্ষ্যে মানুষ সমাজে প্রচলিত নীতি ও মূল্যবোধগুলোকে অনুসরণ করে এবং এর মধ্যে দিয়েই সংস্কৃতি সংরক্ষিত হয়। 


১১. প্রতীক ও সংকেত :- কোনো - কোনো সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানগুলোকে প্রতীক বা সংকেত দ্বারা উপস্থাপনের রীতি প্রচলিত আছে। এছাড়াও কোনো বস্তুর অবস্থান বোঝাতে , বিশেষ কোনো নির্দেশ বোঝাতে - প্রতীক বা সংকেত ব্যবহার করা হয়। এই প্রতীক বা সংকেতগুলি সামাজিক আদান - প্রদান ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হয় এবং মূল্যবোধের উপস্থাপক হিসাবেও কাজ করে। 

১২. সামাজিকীকরণ :- সংস্কৃতির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল সামাজিকীকরণ। মানুষ সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সংস্কৃতির উপাদানগুলির সঙ্গে পরিচিত হয় ও তাদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ঘটায়। প্রচলিত সংস্কৃতিকে এক প্রজন্ম থেকে অপর প্রজন্মে সঞ্চারিত করে সামাজিকীকরণ। 

১৩. নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য :- প্রতিটি সাংস্কৃতিক উপাদানের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বর্তমান। উদ্দেশ্যবিহীন সাংস্কৃতিক উপাদান মানুষ বর্জন করে। যেসকল উপাদান মানুষের প্রয়োজন পূরণ করে ; কেবলমাত্র সেই সকল উপাদানগুলিই সাংস্কৃতিক উপাদান হিসাবে গৃহীত হয়। 

১৪. অতিযান্ত্রিক বিষয় : - হার্বার্ট স্পেনসার সংস্কৃতিকে একটি অতিআঙ্গিক ও অতিযান্ত্রিক বিষয় বলে উল্লেখ করেছেন। কোনো একটি বস্তুগত উপাদানকে ভাবগত উপাদানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। যেমন , কোনো দেশের জাতীয় সংগীত শুধুমাত্র একটি গান বা সংগীত নয় ; তার সঙ্গে জড়িত থাকে আবেগ , জাতীয়তাবোধ , দেশপ্রেম - ইত্যাদি। 

১৫. সমাজ নিয়ন্ত্রণ :- সামাজিক নিয়ন্ত্রণের একটি অপরিহার্য উপাদান হল সংস্কৃতি। সমাজে প্রচলিত সংস্কৃতি মানুষের বিচারবুদ্ধিকে প্রভাবিত করে এবং আচার - আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে সামাজিক নিয়ন্ত্রক হিসাবে ভূমিকা পালন করে। 

১৬. সংস্কৃতি একটি অবিধিবদ্ধ বিষয় :- সাধারণতঃ সাংস্কৃতিক বিষয়গুলির কোনো লিখিত ভিত্তি থাকেনা। তবে সমাজে প্রচলিত সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টের মধ্যে কিছু কিছু বিধিবদ্ধ আইনে সংযুক্ত করা হলেও সংস্কৃতির বেশিরভাগ উপাদানগুলি হল প্রথা ভিত্তিক। তাই সংস্কৃতি একটি অবিধিবদ্ধ বিষয়। 

১৭. সংস্কৃতি একটি অন্তঃসম্পর্কিত বিষয় :- প্রথা , লোকাচার , লোকনীতি , রীতিনীতি , আদর্শ - ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের সম্মিলিত রূপ হল সংস্কৃতি। আবার উক্ত বিষয়গুলি সংস্কৃতির মাধ্যমেই পারস্পরিক সংযোগ রক্ষা করে। 

১৮. অভিযোজনের সহায়ক :- সংস্কৃতি ব্যক্তিমানবের অভিযোজনের সহায়ক হিসাবে কাজ করে। মানুষ সমাজে জন্মগ্রহণ করে এবং সংস্কৃতির মাধ্যমেই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে এবং সংস্কৃতির উপাদানগুলি ব্যক্তিবর্গের অভিযোজনের সহায়ক হয়ে ওঠে। 

পরিশেষে বলা যায় , ব্যপক অর্থে সংস্কৃতি প্রসঙ্গে ম্যাকাইভার যথার্থই বলেছেন - আমরা যা , তা'ই আমাদের সংস্কৃতি। সংস্কৃতি সমাজের একপ্রকার বাহ্যিক প্রকাশ এবং কোনো একটি সমাজে সংস্কৃতি দীর্ঘস্থায়ী হলে তা ঐতিহ্যে পরিণত হয়।     


You May Also Like

0 comments