সাম্যের প্রকারভেদ / বিভিন্ন প্রকার সাম্য :-

by - November 23, 2022

সাম্যের প্রকারভেদ / বিভিন্ন প্রকার সাম্য :- 

সাম্যের প্রকারভেদ আলোচনা কর।  

বিভিন্ন প্রকার সাম্য সম্পর্কে আলোচনা কর। 

সাম্যের বিভিন্ন ধরণ। 




সাম্যের প্রকারভেদ / বিভিন্ন প্রকার সাম্য :- 


১. স্বাভাবিক সাম্য :- 
স্বাভাবিক সাম্য তত্ত্বের একজন অন্যতম প্রবক্তা হলেন রুশো। তাঁর মতে , মানুষ স্বাধীন হয়েই জন্মায় ; কিন্তু সর্বত্র সে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। রুশো ছাড়াও স্বাভাবিক সাম্য তত্ত্বের অন্যান্য প্রবক্তাগণ হলেন সিসেরো ও পলিবিয়াস। স্বাভাবিক সাম্যের তত্ত্বের মূলকথা হল - মানুষ জন্ম থেকেই স্বাধীন এবং সম অধিকার সম্পন্ন। তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকেনা। 
কিন্তু বর্তমানে স্বাভাবিক সাম্য তত্ত্বের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ একাধিক সমালোচনা করেন। যেমন - জন্ম থেকেই সকল মানুষ দৈহিক , মানসিক , কর্মক্ষমতা এবং সামাজিক অবস্থানগতভাবে সমান হয়না।তাই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ স্বাভাবিক সাম্য বলতে সকল প্রকার বিশেষ সুযোগ সুবিধার অবসানের তত্ত্ব প্রচার করেন। 


২. সামাজিক সাম্য :- 
সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে জাতিগত , বর্ণগত , লিঙ্গগত , অর্থনৈতিক , সামাজিক অবস্থানগত - ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে পার্থক্য বর্তমান। সামাজিক সাম্য তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা হলেন বার্কার। তিনি সামাজিক সাম্য বলতে বুঝিয়েছেন সাংস্কৃতিক , সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমান অধিকারের প্রতিষ্ঠাকে। প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ও দাস সমাজে সামাজিক সাম্যের অস্তিত্ব ছিল না। যেমন আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের সামাজিক অধিকারের ক্ষেত্রে বিস্তর পার্থক্য ছিল ; ভারতে জাতিগতভাবে নিম্নবর্গের কোনো অধিকার ছিলনা। কিন্তু পরবর্তীকালে আমেরিকার মানবাধিকার ঘোষণাপত্র , ফরাসি বিপ্লব - ইত্যাদি ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে সামাজিক সাম্যের ধারণাটি বিকাশলাভ করে। তবে বর্তমানেও যে সামাজিক সাম্য সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে - তা কিন্তু নয়। একমাত্র শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই সামাজিক সাম্য সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। 

৩. আইনগত সাম্য :- 
সাম্যের ধারণাগুলির মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য ধারণা হল আইনগত সাম্য। আইনের দৃষ্টিতে সমতা এবং আইন কর্তৃক সকলের সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার - হল আইনগত সাম্যের মূল বক্তব্য। আইনগত সাম্যের ধারণা অনুসারে সমাজে অবস্থানকারী প্রতিটি ব্যক্তি জাতি - ধর্ম - বর্ণ - লিঙ্গ - সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান - ক্ষমতা ও পদমর্যাদা নির্বিশেষে সাধারণ আইন দ্বারা সমভাবে নিয়ন্ত্রিত ও সংরক্ষিত হবেন। 

৪. রাজনৈতিক সাম্য :- 
রাজনৈতিক সাম্য হল জাতি - ধর্ম - বর্ণ - সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান - ক্ষমতা ও পদমর্যাদা নির্বিশেষে সকলের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সমভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ। রাজনৈতিক সাম্য দ্বারা সকল মানুষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অধিকার , নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার , নির্বাচিত হওয়ার অধিকার , ভোট প্রদানের অধিকার , জনমত সাপেক্ষে শাসন ব্যবস্থায় অংশগ্রহনের অধিকার - ইত্যাদি অধিকার লাভ করে। 


৫. অর্থনৈতিক সাম্য :- 
অর্থনৈতিক সাম্য হল সেই ধরণের ব্যবস্থা যার মাধ্যমে সমাজে বসবাসকারী সকল শ্রেণীর মানুষ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমান সুযোগ - সুবিধা লাভ করে। অর্থনৈতিক সাম্য তত্ত্বের মূল প্রবক্তা হলেন মার্কসবাদীরা। মার্কসবাদীদের মতে , সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত না হলে অন্য সকল অধিকার ও স্বাধীনতা অবাস্তব ও অর্থহীন। মার্কসবাদীরা মনে করেন সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য ব্যতীত সমাজ ও রাষ্ট্র শোষণযন্ত্রে পরিণত হয়। মার্কসবাদীরা অসাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিলোপ করার পক্ষপাতী। ল্যাস্কি বলেছেন - যে সমাজে আমার প্রতিবেশীরা না খেয়ে থাকে সেই সমাজে পর্যাপ্ত আহার গ্রহণের অধিকার আমার নেই। 

৬. ব্যক্তিগত সাম্য :- 
সমাজে অবস্থানকারী সকল ব্যক্তি যখন রাজনৈতিক , সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমান সুযোগ ও অধিকার লাভ করে - তখন তাকে বলে ব্যক্তিগত সাম্য। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ধনবৈষম্যমূলক সমাজে কখনোই পূর্ণাঙ্গরূপে ব্যক্তিগত সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা ; কেননা ধনবৈষম্যমূলক সমাজ সর্বদা প্রভুত্বকারী শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে। সমাজে ব্যক্তিগত সাম্য ব্যক্তির অন্তর্নিহিত সত্তার বিকাশের মূল শর্ত হিসাবে বিবেচিত হয়। এই তত্ত্ব অনুসারে আইন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা সকলের সমান বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ রচনা করে। 

৭. আন্তর্জাতিক সাম্য :- 
আন্তর্জাতিক সমস্যাসমূহের আলোচনামূলক সমাধান , জাতির আত্মনিয়ন্রণের অধিকার - ইত্যাদির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় সম্মিলিত UNO বা জাতিপুঞ্জ। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদের ২(১) নং ধারায় জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও সকল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করা হয়েছে। 
বর্তমান পৃথিবীতে ক্ষুদ্র -বৃহৎ , ক্ষমতাশালী - ক্ষমতাহীন , সম্পদশালী - সম্পদহীন - ইত্যাদি সকল ধরণের রাষ্ট্রেরই অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। এই সকল রাষ্ট্রগুলি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে আন্তর্জাতিক সাম্যের অবতারণা করা হয়। 

পরিশেষে বলা যায় , আইনগত সাম্যের তত্ত্বটিকে বাদ দিয়ে অন্যান্য সকল প্রকার সাম্য তাত্ত্বিক বা অবিধিবদ্ধ ; কেবলমাত্র আইনগত সাম্যের অধিকার প্রদানে রাষ্ট্র অঙ্গীকারাবদ্ধ। রাজনৈতিক সাম্য ও আন্তর্জাতিক সাম্য অবশ্য আইনগত সাম্যের অন্তর্গত। যদিও প্রকৃত অর্থে সাম্য কোনো রাষ্ট্রেই প্রতিষ্ঠিত নেই ; কেবলমাত্র শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজেই প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব।     


You May Also Like

0 comments