সামাজিকীকরণের বিভিন্ন মাধ্যমগুলি সম্পর্কে লেখ।

by - November 23, 2022

সামাজিকীকরণের বিভিন্ন মাধ্যমগুলি সম্পর্কে লেখ। 

সামাজিকীকরণের বিভিন্ন উপাদান। 




সামাজিকীকরণের মাধ্যম :- 


সামাজিকীকরণ হল একটি বহুউপাদানবিশিষ্ট প্রক্রিয়া। সমাজতাত্ত্বিক কিংসলে ডেভিস সামাজিকীকরণের মাধমগুলিকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন - কর্তৃত্বমূলক ও অকর্তৃত্বমূলক। সামাজিকীকরণের কর্তৃত্বমূলক মাধ্যমগুলি হল সেইসকল মাধ্যম যেগুলি ব্যক্তি বা শিশুর উপর কর্তৃত্ব আরোপ করে ; যেমন - বাবা - মা , শিক্ষক , রাষ্ট্র - ইত্যাদি। অন্যদিকে অকর্তৃত্বমূলক মাধ্যমগুলি হল সেইসকল মাধ্যম যেগুলি শিশুর উপর কর্তৃত্ব আরোপ করেনা ; যেমন - বন্ধুগোষ্ঠী , গণমাধ্যম - ইত্যাদি। 
সামাজিকীকরণের বিভিন্ন মাধ্যমগুলি নিম্নরূপ - 


১. পরিবার :- 
সামাজিকীকরণের মাধ্যমগুলির মধ্যে পরিবারকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমরূপে বিবেচিত করা হয়। প্রতিটি শিশু জন্মগ্রহণের পর থেকে তার পরিবারের মধ্যেই বেড়ে ওঠে। সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনের ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে বিস্তর পার্থক্য থাকলেও পারিবারিক সম্পর্কের বিষয়টি সাধারণতঃ সকল পরিবারে একই ধরণের হয়ে থাকে। শিশুর প্রথম শিক্ষা শুরু হয় তার মায়ের কাছ থেকে এবং তারপর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে। সামাজিক নিয়ম - কানুন , রীতিনীতি ,আদব - কায়দা , প্রথা - এই সমস্তকিছুর শিক্ষা শিশু পায় তার পরিবারের কাছ থেকেই। সেই কারণেই পরিবারকে সামাজিকীকরণের প্রধান ও প্রাথমিক মাধ্যম বলা হয়ে থাকে। 

২. শিক্ষা - প্রতিষ্ঠান :- 
শিক্ষা - প্রতিষ্ঠান হল সামাজিকীকরণের একটি বিধিবদ্ধ মাধ্যম। প্রাথমিক পর্যায়ে পারিবারিক শিক্ষার পর একজন শিশু বিদ্যালয় জীবনে প্রবেশ করে। বিদ্যালয় জীবনে শিশু বিধিবদ্ধভাবে সামাজিকীকরণের বিষয়টিকে আয়ত্ত করে। বিদ্যালয় সামগ্রিক সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ। তাই একজন শিশুর সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যালয় জীবনে শিশুর সামাজিকীকরণ ঘটে পাঠক্রম ও সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীকে কেন্দ্র করে। শৃঙ্খলাবদ্ধতা , নিয়মানুবর্তিতা , শিক্ষক ও গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধার মনোভাব , নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষমতা , পাঠের প্রতি মনোযোগী হওয়া , প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা - ইত্যাদি সামাজিক বিষয়গুলির সঙ্গে পরিচিত হয় ও দক্ষ হয়ে ওঠে। এইভাবে শিক্ষা - প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সামাজিকীকরণ ঘটে। 

৩. গণমাধ্যম :- 
গণমাধ্যম হল সমাজের আয়না স্বরূপ। সমাজে ঘটে চলা বিভিন্ন ঘটনা , সমাজের পরিবর্তন ও বিবর্তন , সরকারি নীতি , শিক্ষা - সাহিত্য ও সংস্কৃতি - ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় সমাজস্থ মানুষের নিকট পরিবেশন করে। শিশুর মধ্যে সামাজিকীকরণের বিকাশের ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যমগুলি হল - রেডিও , দূরদর্শন , সংবাদপত্র এবং আধুনিক কালে ডিজিটাল সামাজিক মাধ্যম বা সোশ্যাল নেটওয়ার্ক। এইসকল গণমাধ্যমগুলির মাধ্যমে শিশু তার পারিপার্শ্বিক , জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের সঙ্গে পরিচিত হয় ও সেই সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে। গণমাধ্যমগুলি জনমত গঠনের ক্ষেত্রে এবং চিন্তাজগতে গভীর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

৪. রাষ্ট্র - ব্যবস্থা :- 
রাষ্ট্র - ব্যবস্থার মূলতঃ তিনটি বিভাগ - আইন , শাসন ও বিচার। এই তিন বিভাগের মাধ্যমে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের উপর বিভিন্ন বাধানিষেধ আরোপ করে ও নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ করে। এই নিয়ন্ত্রণ অবশ্য ইতিবাচক ; কেননা রাষ্ট্র নাগরিকদের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের মাধ্যমে নাগরিকদের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলে। প্রতিটি শিশু রাষ্ট্র - ব্যবস্থার অন্তর্গত একজন সদস্য হিসাবে রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে এবং সমাজের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া সংগঠিত হয়। এইভাবে রাষ্ট্র ব্যবস্থা শিশুর সামাজিকীকরণে সহায়তা করে। 


৫. সমবয়সী ও বন্ধুগোষ্ঠী :- 
পরিবার , শিক্ষা প্রতিষ্ঠান , রাষ্ট্র - এইসকল বিধিবদ্ধ ও কর্তৃত্বমূলক মাধ্যমগুলি ছাড়া শিশুর সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে তার সমবয়সী ও বন্ধুগোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজতাত্ত্বিক Piaget শিশুর সঙ্গে তার সমবয়সী বা বন্ধুগোষ্ঠীকে সর্বাধিক গণতান্ত্রিক বলে মন্তব্য করেছেন। বন্ধুগোষ্ঠীর সঙ্গে শিশুর সম্পর্ক হয় সহজ - সরল ও অবাধ। শিশু এখানে খোলামেলাভাবে মিশতে পারে। বিভিন্ন কর্মে বন্ধুগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ , তাদের কথাবার্তা ইত্যাদি শিশুকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। 

৬. ধর্মীয় রীতিনীতি ও প্রতিষ্ঠান :- 
প্রতিটি মানুষের জীবনে ধর্মের প্রভাব অতি গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের আচার - আচরণ , সমাজ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া , চিন্তা - ভাবনা , আদর্শ - ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় ধর্মের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। ধর্মের বিভিন্ন প্রথা , রীতিনীতি , আচার - অনুষ্ঠান , বিধি - নিয়ম , উপদেশ ও অনুশাসন ব্যক্তির সামাজিক ভূমিকা নির্ণয় করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস ( যেমন দেবতার অস্তিত্ব , পাপ - পুণ্যের বোধ - ইত্যাদি ) শিশুর সামাজিকীকরণে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। 

৭. সাহিত্য :- 
বিভিন্ন গ্রন্থ , পত্র - পত্রিকা , সাময়িক পত্র ও অন্যান্য মাধ্যমে সাহিত্য প্রকাশিত হয়। প্রতিটি সাহিত্যিক রচনায় কবি বা লেখকের জীবনবোধ , দর্শন ও সমাজচেতনা প্রকাশিত হয়। এই চেতনা পাঠকের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। পাঠকবর্গ সাহিত্যপাঠের মধ্যে দিয়ে সমাজের চালচিত্র ও বিভিন্ন রূপ সম্পর্কে অবগত হতে পারেন। এছাড়াও গ্রন্থপাঠ মানুষের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষ সমাজে প্রচলিত ধ্যান - ধারণা , রীতি - পদ্ধতি - ইত্যাদির সঙ্গে পরিচিত হতে পারে। 

৮. বিভিন্ন প্রকার আদর্শ :- 
প্রতিটি শিশু নিজ জীবনে বহু মহাপুরুষ ও কর্মবীরদের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়। মহাপুরুষদের বাণী ও কর্মবীরদের জীবনকাহিনী সাধারণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। সমাজ জীবনে প্রায় প্রতিটি শিশুই শিক্ষার মাধ্যমে বা বড়দের বলা গল্পের মাধ্যমে - এই সকল মহাপুরুষদের আদর্শ সম্পর্কে অবগত হন। এই সকল আদর্শ ব্যক্তিজীবনে ও সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। 

৯. কর্মজগৎ :- 
শৈশব ও শিক্ষাজীবন শেষ করে মানুষ কর্মজগতে প্রবেশ করে। এই কর্মজগৎ মানুষের সামাজিকীকরণের একটি প্রত্যক্ষ মাধ্যম। মানুষ তার যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী উৎপাদনশীলতার সঙ্গে যুক্ত হয়। কর্মক্ষেত্রে মানুষ সমাজকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারে এবং সেইমত নিজেদের আচার - আচরণের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করতে পারে। 

পরিশেষে বলা যায় , সামাজিকীকরণের মাধ্যমগুলি এককভাবে সামাজিকীকরণ ঘটায় না ; সবগুলি মাধ্যম সম্মিলিতভাবে ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়া ঘটায় ও সামাজিকীকরণ সংগঠিত করে। সামাজিকীরণের মাধ্যমগুলি দেশ - কালভেদে মোটামুটি একই রকম থাকে। ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমগুলি ব্যক্তির উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেললে ব্যক্তির জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে ; আবার এর উল্টোটাও দেখা যায়। সামাজিকীকরণের মাধ্যমগুলি মূলতঃ ব্যক্তিজীবনে তাদের ব্যক্তিত্ব ও আচার - আচরণের গতি - প্রকৃতি নির্ধারণ করে।      

    

You May Also Like

0 comments