গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্তগুলি আলোচনা কর।

by - November 20, 2022

গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্তগুলি আলোচনা কর। 

গণতন্ত্রের অপরিহার্য উপাদানগুলি আলোচনা কর। 

গণতন্ত্রকে সফল করে তুলতে কোন কোন উপাদান অপরিহার্য ? 



গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্ত। 

গণতন্ত্র হল মূলতঃ একটি উদারনৈতিক রাষ্ট্রদর্শন। যখন একটি রাষ্ট্র গণতন্ত্রকে রাষ্ট্রের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে তখন সেখানে গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য কিছু শর্তাবলি প্রযুক্ত হয়। মিল , লর্ড ব্রাইস , বার্নস - প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ একটি রাষ্ট্র আদর্শ হিসাবে গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য বেশ কিছু শর্তের অবতারণা করছেন। এইসকল শর্তগুলি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ত্রুটি বিচ্যুতি দূর করে সাফল্যের সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে সহায়তা করে। গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্তগুলি নিম্নরূপ :-


১. গণতান্ত্রিক চেতনা :- 
শিক্ষাব্যবস্থা , সামাজিক কাঠামো ও রাজনৈতিক চেতনা বিস্তারের মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনার বিস্তার ঘটে। নাগরিকদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনার বিস্তার গণতন্ত্রকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। গণতান্ত্রিক চেতনার বিস্তারের ফলে জনগণ সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে এবং সরকারকে জনগণের স্বার্থে নীতি প্রণয়নে বাধ্য করে। 

২. গণতান্ত্রিক শিক্ষার বিস্তার :- 
রাষ্ট্রের নাগরিকগণের মধ্যে যত বেশি গণতান্ত্রিক শিক্ষার প্রসার ঘটবে গণতান্ত্রিক কাঠামো ততটাই শক্তিশালী হবে। গণতান্ত্রিক শিক্ষা বলতে বোঝায় , গণতান্ত্রিক কাঠামো , গণতান্ত্রিক আদর্শ , নাগরিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য - ইত্যাদি সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতার বিস্তার। রাজনৈতিক কর্মকান্ড , শিক্ষা - ইত্যাদির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শিক্ষার বিস্তার ঘটে। 

৩. অর্থনৈতিক সাম্য :- 
দেশের অর্থনীতি ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত না হলে গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়না। মুষ্টিমেয় কিছু পুঁজিপতির হাতে যদি দেশের বেশিরভাগ সম্পদ কুক্ষিগত হয় তাহলে গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। কেননা , অর্থনৈতিক সাম্যের সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। 

৪. সর্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা :- 
ভোটাধিকার অর্জনের আগে যদি প্রতিটি নাগরিকদের প্রারম্ভিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করা যায় তাহলে নাগরিকগণ রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো সম্পর্কে যথার্থভাবে অবহিত হতে পারে এবং নিজের ভোটাধিকারকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারে। তাই গণতন্ত্রের সাফল্যের ক্ষেত্রে জন মিল সর্বজনীন শিক্ষার বিস্তারে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। 

৫. ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ নীতি :- 
গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম শর্ত হল ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ নীতি অনুসরণ। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ নীতি অনুসরণ করলে জনগণ সরাসরি প্রশাসনে অংশগ্রহণ করতে পারে। গণতন্ত্রের সাফল্যের একটি অন্যতম শর্ত হল জনগণ কর্তৃক প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে অংশগ্রহণ। 

৬. লিখিত সংবিধান :- 
যেহেতু গণতান্ত্রিক কাঠামোতে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ নীতি অনুসৃত হয় , সেহেতু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে লিখিত সংবিধান গ্রহণ করা আবশ্যিক। লিখিত সংবিধানে প্রশাসন ও রাজনৈতিক পরিকাঠামোর মধ্যে ক্ষমতার স্পষ্ট বন্টন থাকার ফলে সকল কর্তৃপক্ষ ও জনগণ নিজেদের দায়িত্ব , কর্তব্য ও অধিকার সম্পর্কে অবগত হতে পারে। 


৭. বিরোধী দলের ভূমিকা :- 
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাফল্যের অন্যতম শর্ত হল শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতি। শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতি সরকারের স্বৈরাচারী প্রবণতাকে রোধ করতে সক্ষম হয়। বিরোধী দলের সদর্থক ভূমিকা সরকারকে জনবিরোধী নীতি প্রণয়ন থেকে বিরত রাখে। এছাড়াও বিরোধী দল শক্তিশালী হলে জনগণের দাবীসমূহ যথার্থভাবে আইনসভায় উপস্থাপিত হতে পারে। 

৮. স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের উপস্থিতি :- 
স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের উপস্থিতি গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম শর্ত। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে। বিচারবিভাগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ না হলে জনগণ রাষ্ট্রকাঠামোর উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। 

৯. ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা :- 
যেকোনো রাষ্ট্রীয় কাঠামোতেই ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এই ভিন্ন ভিন্ন মতবাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম শর্ত। শাসক ও বিরোধী দল পরস্পরের প্রতি সহিষ্ণুতার মনোভাব রাখলে গণতন্ত্র সফলভাবে কার্যকরী হয়। 

১০. জনমত :- 
গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী হল জনমত। জনমত সরকারের স্বৈরাচারিতাকে রোধ করতে পারে , সরকারকে জনগণের স্বার্থে নীতি প্রণয়ন করতে বাধ্য করতে পারে , জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই সরকারি কর্মসূচি নির্ধারিত হয়। এছাড়াও শক্তিশালী জনমত রাজনৈতিক কর্মকান্ডকেও নিয়ন্ত্রণ করে। তাই শক্তিশালী জনমত গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম শর্ত। 

১১. যোগ্য নেতৃত্ব :- 
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যুমপিটার গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য সুযোগ্য নেতৃত্বকে অন্যতম উপাদান হিসাবে দাবী করেছেন। গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী নেতৃবৃন্দের হাত ধরে গণতান্ত্রিক আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রসারলাভ করে। উল্টোদিকে অযোগ্য নেতৃত্বের উপস্থিতি গণতন্ত্রের প্রধান উদ্দেশ্যগুলিকে নস্যাৎ করে। 

১২. দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা :- 
দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি। শাসনব্যবস্থা দুর্নীতিমুক্ত না হলে জনগণ শাসনব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। সমাজে দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত হলে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হয় , সকল ক্ষমতা এক শ্রেণীর মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়। তাই গণতন্ত্রকে সফল করে তুলতে শাসনব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত হওয়া আবশ্যক। 

১৩. সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার :- 
গণতন্ত্রের সাফল্যের অপর একটি অন্যতম শর্ত হল সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার। সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার গৃহীত না হলে প্রশাসনিক ক্ষমতা এক শ্রেণীর মানুষ দখল করবে এবং প্রশাসন শোষণযন্ত্রে পরিণত হবে। 

১৪. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির উপস্থিতি :- 
কোনো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির উপস্থিতিকে গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম শর্ত বলে মনে করেন। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির উপস্থিতির ফলে আইন , শাসন ও বিচার - এই তিন বিভাগ স্বাধীন , স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে। 

পরিশেষে বলা যায় , গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্তগুলিকে সফলভাবে প্রয়োগ করতে হলে চাই সদর্থক মানসিকতা , জনগণের রাজনৈতিক চেতনা ও গণতন্ত্রের উপযোগী রাষ্ট্রীয় কাঠামো। সচেতন জনগণ , গণমাধ্যমের সক্রিয়তা - ইত্যাদি বিষয়গুলি গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী হিসাবে কাজ করে।   

    

You May Also Like

0 comments