গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দাও। গণতন্ত্রের সুবিধা ও অসুবিধাগুলি আলোচনা কর।

by - November 20, 2022

গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দাও। গণতন্ত্রের সুবিধা ও অসুবিধাগুলি আলোচনা কর। 

গণতন্ত্রের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি। 

গণতন্ত্রের দোষগুণ আলোচনা কর। 

গণতন্ত্রের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলি সম্পর্কে লেখ।  



গণতন্ত্রের সংজ্ঞা / ধারণা :- 


গ্রিকরা সর্বপ্রথম গণতন্ত্র শব্দটিকে ব্যবহার করেন। গণতন্ত্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ Democracy শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ থেকে - ডিমোস , যার অর্থ জনগণ এবং ক্রেটাস , যার অর্থ শাসন। অর্থাৎ গণতন্ত্র কথাটির বুৎপত্তিগত অর্থ হল - জনগণের শাসন। 

গণতন্ত্র সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন - গণতন্ত্রে জনগণই হল চূড়ান্ত ক্ষমতার উৎসস্থল। 

লর্ড ব্রাইস বলেছেন - গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসনক্ষমতা সেদেশের সকলের হাতে অর্পিত থাকলেও তা প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে পরিণত হয়। 

ডাইসি বলেছেন - যেধরনের শাসনব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের হাতে শাসনক্ষমতা অর্পিত থাকে - তাকে বলে গণতন্ত্র। 

মার্কিন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছেন - জনগণের জন্য , জনগণ কর্তৃক পরিচালিত জনগণের শাসন হল গণতন্ত্র। 

সুইজি বলেছেন - গণতন্ত্রে জনগণই হলেন শাসনব্যবস্থার উৎসস্থল। 

তবে গণতন্ত্রের সর্বাধুনিক সংজ্ঞা প্রদান করেছেন - স্যুমপিটার , রবার্ট ডাল , জি সি ফিল্ড - প্রমুখ। স্যুমপিটারের মতে , গণতন্ত্র হল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিনিধি নির্বাচন করা। সি জি ফিল্ড বলেছেন , গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকারের সিদ্ধান্তগ্রহনের ক্ষমতাকে জনগণ সরাসরি প্রভাবিত করে থাকে। সার্বিকভাবে বলা যায় , গণতন্ত্র হল এমন এক ধরণের প্রতিষ্ঠান যেখানে শাসন ক্ষমতার উৎস হল জনগণ , প্রয়োজনে জনগণ শাসকদের নিয়ন্ত্রণ ও পদচ্যুত করতে পারেন। তবে সমাজতন্ত্রবাদীরা অর্থনৈতিক সাম্য ব্যতীত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় বলে অভিমত পোষণ করেন। 


গণতন্ত্রের সুবিধা / গণতন্ত্রের পক্ষে যুক্তি :- 


১. জনগণের সার্বভৌমত্ব :- 
গণতন্ত্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণই হলেন সকল ক্ষমতার মূল উৎস। সরকার গঠিত হয় জনগণের সম্মতিক্রমে এবং জনগণের ইচ্ছা - অনিচ্ছা , আশা - আকাঙ্খা দ্বারা প্রভাবিত হয় সরকার পরিচালিত হয়। 

২. স্বাভাবিক অধিকার তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ :- 
একমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমেই স্বাভাবিক অধিকার তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ ঘটানো যায়। মানুষের জীবন , সম্পত্তি ও অধিকার - ইত্যাদির স্বাভাবিক প্রকাশ ঘটে গণতন্ত্রের মাধ্যমেই। 

৩. আইনের শাসন :- 
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একমাত্র বিধিবদ্ধ পদ্ধতি ছাড়া জনগণের স্বাভাবিক জীবনে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে পারে না। গণতন্ত্রে ব্যক্তি তার স্বাভাবিক অধিকারগুলি চরিতার্থ করে আইনের মাধ্যমেই। 

৪. সর্বোচ্চ মাত্রায় ব্যক্তিকল্যাণ :- 
গণতন্ত্রের মূল লক্ষ্য হল সর্বাধিক মাত্রায় ব্যক্তি কল্যাণ। একমাত্র গণতান্ত্রিক পরিবেশের মধ্যেই একজন ব্যক্তি তার অর্থর্নীহিত সত্তার বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ লাভ করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নীতি প্রণয়নের সময়েও সর্বাধিক ব্যক্তিকল্যাণের বিষয়টি খেয়াল রাখে। 

৫. স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ :- 
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতার জন্য গণতন্ত্রে বিশেষ সাংবিধানিক বিধি - ব্যবস্থা বলবৎ থাকে। ফলে আইন ও শাসন বিভাগ কর্তৃক বিচার বিভাগের উপর কর্তৃত্ব আরোপের সম্ভাবনা গণতন্ত্রে খুব কম। 

৬. তিনটি মূলনীতি : সাম্য , মৈত্রী ও স্বাধীনতা :- 
গণতন্ত্রে ফরাসি বিপ্লব উদ্ভুত তিনটি প্রধান আদর্শ - সাম্য , মৈত্রী ও স্বাধীনতার অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। এখানে আইন সকলের প্রতি সমানভাবে প্রযুক্ত হয় এবং আইন কর্তৃক সকলেই সমভাবে সংরক্ষিত হন। একমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই ব্যক্তিস্বাধীনতা সর্বাধিকরূপে চরিতার্থ করা সম্ভব। 


৭. ব্যক্তি স্বাধীনতার চরম প্রকাশ :- 
নাগরিকদের বিভিন্ন প্রকার স্বাধীনতা - যেমন পৌর ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা - ইত্যাদি গণতন্ত্রের মাধ্যমে সর্বোচ্চ হারে প্রকাশিত হয়। রাষ্ট্র নাগরিকদের এই সকল স্বাধীনতা রক্ষা করতে নাগরিকদের নিকট বদ্ধপরিকর থাকে। 

৮. ব্যক্তিত্বের সর্বোচ্চ বিকাশ :- 
একমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই ব্যক্তির আত্মপ্রকাশের সর্বোচ্চ সুযোগ থাকায় ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব সর্বোচ্চ হারে প্রকাশের সুযোগ পায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের আদর্শ ও সহায়ক পরিবেশ রচনা করে ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষতা বিধান করে। 

৯. রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ :- 
যেহেতু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসন ক্ষমতার উৎস হলেন জনগণ এবং জনগণের সম্মতিক্রমে ও জনগণের মাধ্যমেই সরকার গঠিত হয় ; তাই গণতন্ত্রে মানুষের রাজনৈতিক ক্রিয়া - কলাপ অধিক পরিমাণে সংগঠিত হয় - ফলে মানুষের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে। 

১০. স্বৈরাচারের সম্ভাবনা হ্রাস :- 
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অধিক সংখ্যক জনগণের সম্মতিক্রমে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জনগণের ইচ্ছা - অনিচ্ছাকে কেন্দ্র করেই রাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয় - ফলে গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা খুব কম। কেননা , গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার জনগণকে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে। 

১১. মানুষের ইচ্ছা - অনিচ্ছার যথার্থ প্রতিফলন :- 
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের সম্মতির উপর ভিত্তি করে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় ; ফলে সরকার জনগণের ইচ্ছা - অনিচ্ছা ও আশা - আকাঙ্খার প্রতি সংবেদনশীল থাকতে বাধ্য থাকেন। ফলে মানুষের রাষ্ট্রীয় নীতিতে জনগণের ইচ্ছা - অনিচ্ছার যথার্থ প্রতিফলন ঘটে। 

১২. বিপ্লবের সম্ভাবনা হ্রাস :- 
জনগণের সম্মতির উপর ভিত্তি করে সরকার নির্বাচিত হওয়ায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণ - বিপ্লবের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। 

১৩. দায়বদ্ধতা :- 
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র জনগণের নিকট দায়বদ্ধ থাকে। শাসন বিভাগ আইন বিভাগের প্রতি দায়বদ্ধ  থাকে।               
       
১৪. জনকল্যাণকর রাষ্ট্র :- 
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের একমাত্র উদ্দেশ্য হল জনকল্যাণ। এখানে রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণের প্রতি শাসন আরোপিত হওয়ার পরিবর্তে জনগণের কল্যাণের জন্য নীতি আরোপিত হয়। 

গণতন্ত্রের অসুবিধা / গণতন্ত্রের বিপক্ষে যুক্তি :- 


১. অযোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা সরকার পরিচালনার সম্ভাবনা :- 
গণতন্ত্রে সকলের অধিকার সমান ; তাই অযোগ্য ব্যক্তিরাও গণতন্ত্রে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ ও পরিচালনার সুযোগ পান - যা কখনোই উৎকৃষ্ট শাসন পরিচালনা করতে পারেনা। 

২. সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রতি অধিক গুরুত্ব :- 
গণতন্ত্রে সরকার প্রতিষ্ঠা থেকে নীতি প্রণয়ন - সবকিছুতেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার নীতি প্রযুক্ত হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই উৎকর্ষতার পরিবর্তে সাধারণের সম্মতির উপর আস্থা প্রকাশের ফলে - শাসন কার্য পরিচালনা ও নীতি প্রণয়ন তার মূল লক্ষ্য চরিতার্থ করতে পারেনা। 

৩. সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থরক্ষা :- 
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে প্রয়াসী হয়ে থাকে ; ফলে গণতন্ত্রে সকলের স্বার্থ সুরক্ষিত হওয়া সম্ভব নয়। এজাতীয় ব্যবস্থায় কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রীয় নীতির উপর প্রভাব বিস্তার করে। 

৪. আমলাতান্ত্রিকতা :- 
অযোগ্য ও অদক্ষ ব্যক্তিরা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে শাসন কার্যে অংশগ্রহণ করলে তারা আমলাদের উপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ফলে শাসন পরিচালনা ও নীতি নির্ধারণের সকল অংশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পরিবর্তে আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। 


৫. জরুরি অবস্থার ক্ষেত্রে উপযুক্ত নয় :- 
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেকোনো নীতি নির্ধারণ ও পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে সকলের সম্মতি ও বিস্তর আলাপ - আলোচনা - ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জরুরি অবস্থার সময় দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে উপযুক্ত নয়। 

৬. ব্যয়বহুল :- 
অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলির তুলনায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বিভিন্ন নির্বাচন , উপনির্বাচন , যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রয়োজনে বিভিন্ন সরকার - ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। আবার এত ব্যয়ের পরেও জনগণের আশা - আকাঙ্খা চরিতার্থ না হলে - তা হয় অপচয়ের নামান্তর। 

৭. দলীয় স্বার্থ :- 
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি রাজনৈতিক দল জনগণের সন্মতিক্রমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু শাসক দল ও বিরোধী দলের মধ্যে স্বার্থের যে দ্বন্দ্ব তৈরী হয় তার ফলে জনগণের আশা - আকাঙ্খার তুলনায় দলীয় স্বার্থ প্রধান হয়ে ওঠে। 

৮. পুঁজিবাদের বিকাশ :- 
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন একটি প্রধান প্রক্রিয়া। এই নির্বাচনের খরচের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পুঁজিপতিদের আশ্রয়প্রার্থী হয় এবং নির্বাচনে জয়লাভের পর শাসক দল পুঁজিপতিদের স্বার্থেই নীতি নির্ধারণ করে ; ফলে জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়। 

৯. রক্ষনশীলতার সম্ভাবনা:- 
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা যদি মূর্খ ও অযোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হয় , তাহলে তা রক্ষণশীল হতে বাধ্য। কেননা অযোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা কখনোই প্রগতিশীল উদ্ভাবন সম্ভব নয় ; ফলে শাসন ব্যবস্থা রক্ষণশীল হয়ে পড়ে। 

১০. সরকারের স্থায়িত্ব ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কা :- 
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী , জাত ও ধর্ম , বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান - ইত্যাদির পারস্পরিক স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত হয়। সরকার তাদের সকলের স্বার্থে কাজ না করতে পারলে সরকারের স্থায়িত্ব ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কা তৈরী হয়।      


You May Also Like

0 comments