জনসম্প্রদায় কাকে বলে ? জনসম্প্রদায়ের বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর।
জনসম্প্রদায় কাকে বলে ? জনসম্প্রদায়ের বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর।
জনসম্প্রদায়ের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট।
Definition and features of Community.
জনসম্প্রদায়ের ধারণা / সংজ্ঞা :-
মানুষ সামাজিক জীব। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে সামাজিকভাবে দলবদ্ধভাবে বসবাস করতে করতে সেইসকল মানুষের মধ্যে এক গভীর ঐক্যবোধ , সমজাতীয় মানসিকতা গড়ে ওঠে। এইভাবে তাদের মধ্যে জীবন ধারণ , চিন্তাজগৎ , সংস্কৃতি - ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে এক সামাজিক সম্পর্ক তৈরী হয়। সেই নির্দিষ্ট অঞ্চলে গড়ে ওঠা মানবসমাজকেই জনসম্প্রদায় (Community) বলা হয়।
চার্লস হর্টন কুলি জনসম্প্রদায়কে স্থায়ী সামাজিক গোষ্ঠী বলে অভিহিত করেছেন। এই সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যেই মানুষ তার সকল প্রকার প্রয়োজন পূরণ করে।
কিংসলে ডেভিস জনসম্প্রদায়কে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আঞ্চলিক গোষ্ঠী বলে অভিহিত করেছেন। এই গোষ্ঠীর সকল সদস্য জনসম্প্রদায়ের মাধ্যমেই তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে।
ম্যাকাইভার বলেছেন , জনসম্প্রদায় হল এমন এক সামাজিক গোষ্ঠী যার মধ্যে বসবাসকারী সকল সদস্য সমজাতীয় বৈশিষ্টপূর্ণ জীবনযাত্রা করে ও একে - অপরের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন করে।
সুতরাং বলা যায় , জনসম্প্রদায় হল একটি সামাজিক গোষ্ঠী , যার মধ্যে বসবাসকারী সদস্যরা একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাস করে , সমজাতীয় আদর্শ ও সংস্কৃতি ধারণ ও বহন করে , তাদের মধ্যে এক গভীর '' আমরা বোধ '' তৈরী হয় - তাকেই জনসম্প্রদায় বলা হয়।
জনসম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট :-
জনসম্প্রদায়ের বিভিন্ন বৈশিষ্টগুলি হল নিম্নরূপ -
১. নির্দিষ্ট এলাকা :-
জনসম্প্রদায়ের একটি আবশ্যিক শর্ত হল নির্দিষ্ট অঞ্চল বা এলাকা। একটি নির্দিষ্ট জনসম্প্রদায়ের সদস্যরা একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে বসবাস করে। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বহুকাল ধরে বসবাস করতে করতে সদস্যদের মধ্যে এক গভীর ঐক্যবোধ গড়ে ওঠে। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাসকারী জনসম্প্রদায়ের মধ্যে পোশাক - পরিচ্ছদ , খাদ্যাভ্যাস , সংস্কৃতি , শিক্ষা , জীবনযাত্রা , অর্থনতিক কর্মকান্ড , রাজনৈতিক জীবন - ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমজাতীয় ও একই আদর্শযুক্ত সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। তবে এর ব্যাতিক্রমও আছে। যেমন - যাযাবর শ্রেণীর মানুষদের জনসম্প্রদায় বলা হলেও তারা সর্বদা একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাস করে না।
২. আমরা বোধ (We Feeling ) :-
প্রতিটি মানুষ একটি নির্দিষ্ট জনসম্প্রদায়ের সদস্য হিসাবে সমাজে নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে। সমাজের প্রতিটি মানুষ , প্রতিটি গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান পারস্পরিকভাবে ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়াশীল এবং পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। এই নির্দিষ্ট সামাজিক ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সদস্যদের মধ্যে এক গভীর আত্মীয়তা গড়ে ওঠে। একে বলা হয় আমরা - বোধ। সদস্যদের আমরা বোধ জনসম্প্রদায়ের প্রধান ভিত্তি।
৩. উদ্দেশ্য :-
জনসম্প্রদায় কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে ওঠেনা। এর উদ্দেশ্য বহুবিধ ও বহুমুখী। যেহেতু জনসম্প্রদায়ের সকল সদস্য জনসম্প্রদায়ের মধ্যেই তাদের সকল প্রয়োজন পূরণ করে - তাই জনসম্প্রদায়ের উদ্দেশ্য বহুমুখী।
৪. স্বাভাবিক সামাজিক সংগঠন :-
নির্দিষ্ট প্রয়োজনের ভিত্তিতে কৃত্রিমভাবে জনসম্প্রদায়ের জন্ম হয়না। জনসম্প্রদায়ের জন্ম হয় স্বাভাবিকভাবে। একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে বহুকাল ধরে মানব জাতির বসবাসের ফলে স্বাভাবিকভাবেই একটি জনসম্প্রদায় গড়ে ওঠে।
৫. পরিকল্পিত নয় :-
মানুষ জনসম্প্রদায়ের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে ; কিন্তু পরিকল্পিতভাবে জনসম্প্রদায় গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বাস্তবে মানুষের পক্ষে জনসম্প্রদায় গড়ে তোলা সম্ভব নয়। একটি নির্দিষ্ট এলাকায় মানুষ একসঙ্গে বসবাস করতে করতে পরিকল্পনাহীনভাবেই জনসম্প্রদায় গড়ে ওঠে।
৬. সদস্যদের জীবনধারণের সাদৃশ্যতা :-
জনসম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে জীবনধারণের মধ্যে বহুক্ষেত্রে সাদৃশ্যতা লক্ষ্য করা যায়। জনসম্প্রদায়ের সকল সদস্য মোটামুটি একই ধরণের জীবনযাত্রা , আদর্শ , জীবনবোধ - ইত্যাদির অংশীদার হয়ে থাকে। এই সাদৃশ্যতা জনসম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে এক গভীর ঐক্যবোধ গড়ে ওঠে।
৭. আইনগত প্রেক্ষিত :-
জনসম্প্রদায়ের কোনো আইনগত ভিত্তি থাকেনা। অর্থাৎ জনসম্প্রদায়ের মধ্যে বসবাসকারী ব্যক্তিবর্গ জনসম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করতে পারেনা। তাই আইনের দৃষ্টিতে জনসম্প্রদায়ের কোনো স্বীকৃতি , অধিকার , কর্তব্য , দায়িত্ব - ইত্যাদি নেই।
৮. পরিধি :-
জনসম্প্রদায় ছোট , বড় - উভয় প্রকারেই হতে পারে। ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে জনসম্প্রদায়ের পরিধি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। আবার একটি বড় জনসম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকগুলি ছোট ছোট জনসম্প্রদায়ের অস্তিত্বও লক্ষ্য করা যায়। যেমন একটি জেলার জনসম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকগুলি গ্রামের জনসমষ্টি অন্তর্ভুক্ত থাকে।
৯. নাম ও পরিচয় :-
প্রতিটি জনসম্প্রদায়ের নির্দিষ্ট নাম ও পরিচয় থাকে। এই নাম দ্বারাই ব্যক্তিবর্গ নির্দিষ্ট জনসম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হয়। আবার জনসম্প্রদায়ের নির্দিষ্ট নামের ভিত্তিতেই ব্যক্তির পরিচয় , অবস্থান - ইত্যাদি সহজেই বোধগম্য হয়ে ওঠে।
১০. স্থায়ী প্রকৃতি :-
জনসম্প্রদায়গুলি মোটামুটি দীর্ঘস্থায়ী। স্থায়িত্ব জনসম্প্রদায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বহুদিন ধরে বসবাসকারী মানুষের বসবাস একটি জনসম্প্রদায় গড়ে তোলে।
0 comments