সমাজ কাকে বলে ? সমাজের বৈশিষ্টগুলি লেখ।
সমাজ কাকে বলে ? সমাজের বৈশিষ্টগুলি লেখ।
সমাজের সংজ্ঞা দাও। সমাজের বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর।
সমাজের ধারণা / সংজ্ঞা :-
চার্লস হর্টন কুলি সমাজকে একটি জটিল প্রক্রিয়া বলেছেন। তাঁর মতে , সমাজে অবস্থানকারী প্রতিটি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান একে - অপরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে।
মরিস জিনসবার্গ বলেছেন - সমাজে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী , প্রতিষ্ঠান - ইত্যাদির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। তাদের মধ্যে যে সহযোগিতামূলক ও প্রতিযোগিতামূলক , সংগঠিত ও অসংগঠিত , সচেতন ও অসচেতন , প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ - সম্পর্ক দেখা যায় - তার সমষ্টিই হল সমাজ।
ম্যাকাইভার ও পেজ সমাজকে সামাজিক সম্পর্কের এক জটিল জাল বলেছেন। এছাড়াও তিনি সমাজকে সদা পরিবর্তনশীল বলেছেন।
আরনল্ড গ্রীন সমাজকে একটি বৃহত্তর গোষ্ঠী হিসাবে অভিহিত করেছেন। এই বৃহত্তর গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি , ব্যক্তিগোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান অবস্থান করে।
সুতরাং সমাজ হল - মানুষের একটি সাংগঠনিক প্রকাশ যা ব্যাপক ও সার্বজনীন। সমাজের গঠন এবং বিবর্তন একটি জটিল প্রক্রিয়া। সমাজের মধ্যেই সকল প্রকার মানুষ একে - অপরের সঙ্গে ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়া করে ও ভাবের আদান - প্রদান করে। সমাজ একটি স্থায়ী জনসংগঠন।
সমাজের বৈশিষ্ট :-
১. অভিন্নতা :-
সমাজে অবস্থানকারী সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে সম উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। সমাজে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষের চাহিদার বৈচিত্রের মধ্যে একটি সাধারণ সম্পর্কের সূত্র আছে। যেমন পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন - শিক্ষা , খাদ্য , বস্ত্র , বাসস্থান , চিকিৎসা পরিষেবা - ইত্যাদি। সকল সমাজেই উক্ত ব্যবস্থাগুলি লক্ষ্য করা যায় - তা সেই সমাজ অপর সমাজ থেকে যতই ভিন্ন হোক না কেন।
২. বিভিন্নতা :-
অভিন্নতা স্বত্বেও সমাজের ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বিভিন্নতা বর্তমান। যেমন নারী ও পুরুষের মধ্যে বিভিন্নতা , সমাজের বিভিন্ন মানুষের ক্ষমতা ও স্বার্থের বিভিন্নতা , শাসক ও শাসিতের মধ্যে বিভিন্নতা - ইত্যাদি। এই বিভিন্নতা বা বৈসাদৃশ্য সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করতে একান্ত অপরিহার্য। বিভিন্নতা মানুষের সামগ্রিক প্রয়োজন পূরণের জন্য কার্যকরী।
৩. পারস্পরিক নির্ভরশীলতা :-
সমাজে অবস্থানকারী প্রতিটি ব্যক্তি , ব্যক্তিগোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান একে - অপরের উপর নির্ভরশীল। মানুষের চাহিদা বহুবিধ ও বৈচিত্রপূর্ণ। তাই সমাজের সকলকে পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল থাকতে হয়। যেমন - একজন কৃষক খাদ্যের ব্যাপারে আত্মনির্ভরশীল হলেও - চিকিৎসা , শিক্ষা , বস্ত্র - ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপরের উপর নির্ভরশীল।
৪. বিমূর্ততা :-
সমাজের জৈব আকৃতি বলতে কিছু নেই। তাই অধ্যাপক গিডিংস সমাজকে একটি মনস্তাত্ত্বিক ধারণা বলে অভিহিত করেছেন। সমাজের অস্তিত্বকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি মাত্র।
৫. সর্বব্যাপী :-
সমাজ একটি সর্বব্যাপী প্রতিষ্ঠান। পৃথিবীর প্রতিটি অংশে , যেখানে মানুষ বসবাস করে - সেখানেই সমাজের অস্তিত্ব বর্তমান। সমাজ বহির্ভুত ব্যক্তির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায়না। তাই পৃথিবীর সর্বত্র সমাজের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়।
৬. সুপ্রাচীন - ব্যবস্থা :-
সমাজ কখনোই হঠাৎ করে জন্ম নেয়নি। মানব সভ্যতার সূচনাকাল থেকেই সমাজের অস্তিত্ব বর্তমান। প্রাচীন , আদিম যুগে যখন ভাষা , লিপি - ইত্যাদি কিছুই প্রচলিত হয়নি - তখনও সমাজের অস্তিত্ব ছিল। তাই সমাজ একটি সুপ্রাচীন ব্যবস্থা।
৭. গতিশীলতা :-
সমাজ একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। কোনো সমাজই একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে নিজেকে আবদ্ধ রাখেনা। নির্দিষ্ট প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণের তাগিদে সমাজ সর্বদা গতিশীল। যেমন আদিম সমাজ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নীত করেছে। প্রাগৈতিহাসিক সমাজ থেকে পুরাতন প্রস্তর যুগ , তারপর নব্য প্রস্তর যুগ , তারপর ধীরে ধীরে আধুনিক যুগে উত্তরণ।
৮. মিথস্ক্রিয়া :-
সমাজে অবস্থানকারী প্রতিটি ব্যক্তি , গোষ্ঠী , প্রতিষ্ঠান একে - অপরের সঙ্গে ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়া সংগঠিত করে। এই ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই মানুষের বহুবিধ চাহিদা পূরণ হয়।
৯. দলবদ্ধতা :-
সমাজে অবস্থানকারী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে দলবদ্ধতার চাহিদা লক্ষ্য করা যায়। মানুষ সর্বদাই দলবদ্ধ প্রাণী , সে কখনো একা বেঁচে থাকতে পারেনা। তাই সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে একত্রে বসবাসের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
১০. শ্রমবিভাজন :-
প্রতিটি সমাজের মধ্যে শ্রমবিভাজন লক্ষ্য করা যায়। শ্রমবিভাজন সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের সামগ্রিক প্রয়োজন পূরণ করে। বিভিন্ন ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন কর্মে লিপ্ত থাকার কারণে মানুষের ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োজনগুলি পূরণ হয়।
১১. সামাজিক রীতিনীতি :-
প্রতিটি সমাজে সামাজিক রীতিনীতির অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। প্রতিটি সমাজে বিভিন্ন সামাজিক প্রথা , লোকাচার , লোকনীতি থাকে। এগুলির মাধ্যমে সমাজে একটি নির্দিষ্ট আইনবিধি তৈরী হয় এবং এই আইনবিধি দ্বারা সমাজ পরিচালিত হয়।
১২. সামাজিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি :-
সামাজিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি মানুষের একটি প্রধান বৈশিষ্ট। তাই , প্রতিটি সমাজে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অবস্থান করে। মানুষ এই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক এবং সংরক্ষক।
১৩. কর্তৃত্ব :-
প্রতিটি সমাজ পরিচালিত করতে নির্দিষ্ট কর্তৃত্বের প্রয়োজন। প্রতিটি সমাজ পরিচালনার জন্য ভিন্ন ভিন্ন কর্তৃত্বমূলক ব্যক্তি বা সংস্থার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। তবে ভিন্ন ভিন্ন সমাজে কর্তৃত্বের প্রকৃতি ও চরিত্র ভিন্ন ভিন্ন হয়। যেমন রাজতান্ত্রিক সমাজে সকল প্রকার কর্তৃত্ব ছিল রাজা ও তার কর্মচারীদের হাতে ; আবার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকল প্রকার কর্তৃত্ব নিহিত থাকে সাধারণ মানুষের হাতে।
১৪. বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অবস্থিতি :-
প্রতিটি সমাজে বিভিন্ন ধরণের প্রতিষ্ঠানের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। সমাজ পরিচালনা করতে ও সমাজকে সচল রাখতে সমাজে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। শিক্ষা , স্বাস্থ্য পরিষেবা , পৌর পরিষেবা , আইন - শৃঙ্খলা রক্ষা , খাদ্য ও পণ্যের উৎপাদন ও বন্টন - ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান সমাজকে সচল রাখে ও মানুষের বহুবিধ প্রয়োজন পূরণ করে।
0 comments