স্বাধীনতার সংজ্ঞা দাও। স্বাধীনতার বিভিন্ন রূপগুলি সম্পর্কে লেখ।

by - November 26, 2022

স্বাধীনতার সংজ্ঞা দাও। স্বাধীনতার বিভিন্ন রূপগুলি সম্পর্কে লেখ। 

স্বাধীনতার সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ। 

বিভিন্ন ধরণের স্বাধীনতা। 




স্বাধীনতার ধারণা / সংজ্ঞা :- 


ফরাসি বিপ্লব প্রসূত স্বাধীনতা , সাম্য ও মৈত্রী - এই তিনটি আদর্শকে মহান আদর্শরূপে বিবেচিত করা হয়। এক অর্থে স্বাধীনতা হল সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতার অবসান। তবে স্বাধীনতা কখনোই অবাধ নয় , এর কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। 

স্বাধীনতার সংজ্ঞা প্রসঙ্গে ল্যাস্কি বলেছেন - স্বাধীনতা হল এমন একটি পরিবেশ যেখানে ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব। এই বাহ্যিক পরিবেশ তৈরী করে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ। 

অপরদিকে হেগেল বলেছেন , আইনকে মান্য করাই হল স্বাধীনতা। 

বার্কার বলেছেন , রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা বা আইনগত স্বাধীনতা হল সকলের জন্য শর্তসাপেক্ষে স্বাধীনতা। 

মার্কসবাদীরা অবশ্য স্বাধীনতা সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁদের মতে স্বাধীনতা হল মানুষের পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্বের বিকাশের সুযোগ এবং এজন্য প্রয়োজন সকল প্রকার আর্থিক শোষণ ও অসাম্যের অবসান। 


স্বাধীনতার বিভিন্ন রূপ / বিভিন্ন প্রকার স্বাধীনতা :- 


১. ব্যক্তিগত স্বাধীনতা :- 
ব্যক্তিগত স্বাধীনতা প্রত্যটির জন্ম হয় প্রাচীন গ্রিসের এথেন্সে। তাঁরা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলতে বুঝতেন ব্যক্তির বাহ্যিক আচার - আচরণের ওপর সর্বপ্রকার নিয়ন্ত্রনহীনতা। প্রাচীন গ্রিসে এই ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার মাধ্যমেই স্বাধীনতার বর্তমান ধারণাটি বিকাশলাভ করে। 

২. জাতীয় স্বাধীনতা বা সম্প্রদায়গত স্বাধীনতা :- 
প্রাচীন গ্রিকবাসীদের নিকট জাতীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রদায়গত স্বাধীনতা ছিল সমার্থক। অধ্যাপক বার্নস বলেছেন - সর্বপ্রকার স্বাধীনতার উন্নতির ভিত্তি হল জাতীয় স্বাধীনতা। জাতীয় স্বাধীনতা হল বহিঃশত্রুর নিয়ন্ত্রণবিহীনতা এবং জাতীয় স্বাধীনতা না থাকলে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অস্তিত্বও অর্থহীন হয়ে পড়ে। 

৩. স্বাভাবিক স্বাধীনতা :- 
স্বাভাবিক স্বাধীনতা তত্ত্বের প্রবক্তা হলেন রুশো। প্রাক - সামাজিক ও প্রাক - রাজনৈতিক যুগে মানুষ অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করত। মানুষের উপর কোনোপ্রকার বাধানিষেধ আরোপিত ছিলনা। মানুষের এই স্বাধীনতাকেই স্বাভাবিক স্বাধীনতা বলা যেতে পারে। কিন্তু স্বাভাবিক স্বাধীনতা তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হল - অবাধ ও নিয়ন্ত্রণবিহীন স্বাধীনতা মানুষকে স্বেচ্ছাচারী করে তোলে। 

৪. সামাজিক স্বাধীনতা :- 
সামাজিক আচার - আচরণ , রীতিনীতি , প্রথা - ইত্যাদি অনুসারে যে স্বাধীনতা সংরক্ষিত হয় - তা হল সামাজিক স্বাধীনতা। এইধরণের স্বাধীনতা নীতিবোধ ও সামাজিক বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয়। কিন্তু সামাজিক স্বাধীনতার বিষয়টি আপেক্ষিক। কেননা প্রথা ও রীতিনীতির উপর ভিত্তি করে যে স্বাধীনতা গড়ে ওঠে তা কোনো কোনো সময় অমানবিক হয়ে উঠেছে - এমন নিদর্শনও লক্ষ্য করা যায় ; যেমন ভারতে একদা প্রচলিত সতীদাহ প্রথা , প্রাচীন গ্রিসে প্রচলিত ক্রীতদাস প্রথা - ইত্যাদি। 


৫. নৈতিক স্বাধীনতা :- 
নৈতিক স্বাধীনতা নীতিবোধ ও নৈতিক চেতনার দ্বারা সংরক্ষিত ও পরিচালিত হয়। আদর্শবাদী রাষ্ট্রচিন্তবিদরা নৈতিক স্বাধীনতার প্রধান প্রবক্তা। নৈতিক স্বাধীনতা ব্যক্তির নীতিবোধকে স্বাধীনতা উপভোগের মানদন্ড হিসাবে বিবেচিত করে। 

৬. আইনগত স্বাধীনতা :- 
বর্তমানে সকল রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেই আইনগত স্বাধীনতার অস্তিত্ব বর্তমান। এই ধরণের স্বাধীনতা আইন ও সংবিধান স্বীকৃত হয়। কোনো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আইনগত স্বাধীনতাকে আইন ও সংবিধান কর্তৃক নিয়ন্ত্রণ বলেও মনে করেন। কেননা , রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অবাধ স্বাধীনতা স্বৈরাচারিতার নামান্তর ; তাই মানুষের অবাধ গতিবিধির উপর আইনসঙ্গত নিয়ন্ত্রন আরোপ করা প্রয়োজন। আইনসঙ্গত স্বাধীনতার প্রকারভেদ সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ ঐক্যমত্য না হলেও আইনগত স্বাধীনতাকে প্রধানতঃ তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন - 

৬(ক). ব্যক্তি স্বাধীনতা বা পৌর স্বাধীনতা :- 
ব্যক্তি স্বাধীনতা বা পৌর স্বাধীনতা হল সেই সকল স্বাধীন অধিকার যার দ্বারা ব্যক্তি তার ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন করতে পারে। এই সকল অধিকারের মধ্যে প্রধান হল - ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার , ধর্মীয় অধিকার , বাক স্বাধীনতাও মতামত প্রকাশের অধিকার , স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা ও বসবাসের অধিকার , সম্মিলিত হওয়ার অধিকার , পেশাগত অধিকার - ইত্যাদি। প্রতিটি গণতন্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এই অধিকারগুলি আইন তথা সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত হয়। 

৬.(খ) রাজনৈতিক স্বাধীনতা :- 
রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যতীত গণতন্ত্র অর্থহীন। রাজনৈতিক স্বাধীনতাগুলি মানুষকে রাষ্ট্রব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়। রাজনৈতিক অধিকারগুলির মধ্যে প্রধান হল - নির্বাচিত হওয়ার অধিকার , নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার , সরকারি কার্যাবলীর সমালোচনার অধিকার , সরকারি চাকুরী গ্রহণের অধিকার ইত্যাদি। প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষের রাজনৈতিক অধিকারগুলি স্বীকৃত। 

৬.(গ). অর্থনৈতিক স্বাধীনতা :-  
ল্যাস্কি - প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ মনে করেন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ব্যাতিত অন্য সকল প্রকার স্বাধীনতা অর্থহীন। মার্সবাদীরাও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এপ্রসঙ্গে বার্কার যথার্থই বলেছেন , অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরাধীন শ্রমিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কখনোই স্বাধীন হতে পারেননা। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত প্রধান অধিকারগুলি হল - যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মে অংশগ্রহণের অধিকার , অক্ষম ব্যক্তিদের রাষ্ট্র কর্তৃক প্রতিপালিত হওয়ার অধিকার , উপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভের অধিকার , বার্ধক্যে আর্থিক নিরাপত্তার অধিকার , সর্বপ্রকার শোষণের হাত থেকে মুক্তির অধিকার - ইত্যাদি। 

পরিশেষে বলা যায় , উপরে আলোচিত ভিন্ন ভিন্ন ধরণের স্বাধীনতার মধ্যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বিষয়টি সর্বাধিক বিতর্কিত ও আলোচিত। কেননা , যেসকল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের হাতে অর্পিত থাকে সেখানে সেখানে জনগণ কোনো স্বাধীনতাই সঠিকভাবে উপভোগ করতে পারেনা। একমাত্র মালিকানা ব্যবস্থার পরিবর্তন ও উৎপাদনশীলতার মালিকানা ক্ষেত্রে পরিবর্তন - অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তবে এই বিষয়টি সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ একমত নন।     


You May Also Like

0 comments