ন্যায়ের সংজ্ঞা দাও। ন্যায়ের প্রকৃতি - পরিধি আলোচনা কর।

by - November 29, 2022

ন্যায়ের সংজ্ঞা দাও। ন্যায়ের প্রকৃতি - পরিধি আলোচনা কর। 

ন্যায়বিচার কাকে বলে ? ন্যায়বিচারের প্রকৃতি - পরিধি আলোচনা কর। 

ন্যায়ের ধারণা ও প্রকৃতি - পরিধি। 




ন্যায়ের ধারণা / সংজ্ঞা :- 


ন্যায় হল একপ্রকার আদর্শমূলক তত্ত্ব ; তাই ন্যায়ের সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নিরূপণ করা সহজসাধ্য নয়। ন্যায়বিচার মূলতঃ একটি নৈতিক ধারণা। এর মূল ভিত্তি হল যৌক্তিকতা , যথার্থতা ও ঔচিত্যমূলক বিষয়। তবে দেশ - কাল ভেদে ন্যায়ের ধারণার পরিবর্তন ঘটে। তাই ন্যায় হল একটি গতিশীল ধারণা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ও সমাজের আদর্শ , রীতিনীতি , প্রথা ও সংস্কৃতি - ইত্যাদি সবকিছুরই পরিবর্তন ঘটে। যেহেতু ন্যায়ের ধারণাটি উপরোক্ত বিষয়গুলির সঙ্গে সম্পর্কিত তাই ন্যায়ের পরিবর্তন সাধিত হয়। 

অধ্যাপক বার্কার বলেছেন , ন্যায় হল সম্পূর্ণরূপে মূল্যবোধের সমষ্টি এবং ন্যায়ের মধ্যে অন্যান্য রাজনৈতিক মূল্যবোধগুলির সমাবেশ ঘটেছে। 

Institutes of Justinian এর মতে , সঠিক , সাধারণ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার একটি মানসিক অনুভূতি ও ইচ্ছাই হল ন্যায়। 

আর্নেস্ট বার্কার তাঁর Principles of Social and Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে ন্যায় সম্পর্কে তাঁর ধারণা উপস্থাপন করেছেন। তিনি ন্যায়কে একটি সমন্বয়কারী শব্দ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। ন্যায় শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ বিশ্লেষণ করলে বার্কারের মতবাদের সত্যতা প্রমাণিত হয়। ন্যায় শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Justice এবং এই শব্দটি এসেছে দুটি ল্যাটিন শব্দ Justus ও Justitia থেকে। এই শব্দগুলির অর্থ সংযোগসাধন ও সমন্বয়সাধন। সুতরাং একটি সুগঠিত ব্যবস্থার মধ্যে বিভিন্ন মূল্যবোধের সমন্বয় হল ন্যায়। 


ন্যায়ের প্রকৃতি - পরিধি :- 


ন্যায়ের প্রকৃতি - পরিধি বিষয়ে আলোচনা করতে হলে বিভিন্ন মতবাদ ও তত্ত্বের অবতারণা করতে হয়। যদিও ন্যায়ের প্রকৃতি ও পরিধি বিষয়ে একটি সর্বজনগ্রাহ্য তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা কঠিন , তবু কয়েকটি তত্ত্বের উপস্থাপন করে ন্যায়ের প্রকৃতি ও পরিধি বিষয়ে আলোকপাত করা সম্ভব। যেমন - 

ন্যায় সম্পর্কিত প্রাচীন গ্রিক ধারণা :- 
ন্যায়ের প্রকৃতি সম্পর্কে প্রাচীন গ্রিক দর্শনে আলোচনার উল্লেখ পাওয়া যায়। পিথাগোরাসের দর্শনে ন্যায়কে বর্গসম ( Square number ) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ন্যায় হল একটি সমন্বয়পূর্ণ ধারণা।আবার গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তাঁর বিখ্যাত Republic গ্রন্থে ন্যায়কে অধিবিদ্যামূলক তত্ত্ব হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। প্লেটোর মতে , রাষ্ট্রগঠনের প্রধান উপাদানগুলির মধ্যে ন্যায় হল অন্যতম। ব্যক্তি নিজের অবস্থানগত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে অবাঞ্চিত রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ না করাই হল ন্যায়। 

রোমান আইনজ্ঞদের দৃষ্টিতে ন্যায়ের প্রকৃতি :- 
রোমান আইনজ্ঞদের মতে আইন হল ন্যায়ের প্রকাশ। ন্যায় হল ধর্ম ও পবিত্রতার সঙ্গে যুক্ত। আইনসঙ্গত ন্যায় সমাজে সার্বিক দিক দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। সেন্ট অগাস্টাইনও ন্যায়কে ধর্ম ও পবিত্রতার সঙ্গে সংযুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। ন্যায় সমাজের নেতিবাচক শক্তিগুলিকে প্রতিহত করে সমাজে শান্তি , সমতা , স্বাধীনতা , মৈত্রী - ইত্যাদি বিষয়গুলির মধ্যে সমন্বয়সাধন করে। 

উপযোগিতাবাদের সাপেক্ষে ন্যায়ের প্রকৃতি :- 
উপযোগিতাবাদের সমর্থকেরা সামাজিক আদর্শগুলির সমন্বয়সাধনকারী হিসাবে ন্যায়কে বিশ্লেষণ করতে সম্মত নন। যেমন উপযোগীতাবাদের প্রধান সমর্থক ডেভিড হিউম সামাজিক আদর্শ হিসাবে ন্যায়ের ধারণাকে গুরুত্বহীন বলে দাবী করেছেন। তিনি ন্যায়ের পরিবর্তে চাহিদার যোগান ও উপযোগিতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। 


সাবেকী উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ন্যায়ের প্রকৃতি :- 
সাবেকী উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম প্রবক্তা আর্নেস্ট বার্কার ন্যায়কে Social Reality বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে , ন্যায় একদিকে সাম্য , মৈত্রী , স্বাধীনতা , সৌভাতৃত্ব ইত্যাদি বিষয়গুলির মধ্যে সমন্বয়সাধন করে এবং অন্যদিকে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের ভিন্ন ভিন্ন দাবী - দাওয়ার মধ্যেও সামঞ্জস্যবিধান করে। 
সাবেকী উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অপর প্রবক্তা প্লেটো মনে করতেন , একমাত্র সমন্বয়সাধনের মাধ্যমেই ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা সম্ভব। অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ না করে নিজের সামর্থ্য ও যোগ্যতা অনুসারে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের স্বাধীনতা প্রদান করে ন্যায়। 

আধুনিক উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ন্যায়ের প্রকৃতি :- 
নয়া উদারনীতি মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা হলেন জন রুলস। ন্যায় সম্পর্কে তিনি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির অবতারণা করেন তাঁর A Theory of Justice গ্রন্থে। জন রুলসের মতে ন্যায়ের মূল ভিত্তি হল সমবন্টন। জন রুলস বলেছেন , ন্যায়ের অর্থ শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের কল্যাণসাধন নয় ; ন্যায়বিচার সমাজস্থ সকল ব্যক্তিবর্গের কল্যাণের পথ প্রশস্ত করে। ন্যায়ের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে জন রুলস সমাজের দুর্বলতর মানুষের জন্য বিশেষ সুযোগ - সুবিধা প্রদানের কথা বলেছেন। 

জন রুলসের ধারণায় ন্যায়ের প্রধান - প্রধান নীতি :- 
জন রুলস ন্যায়ের তিনটি মূলনীতির কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল - 
(ক) সমাজস্থ সকল ব্যক্তিবর্গের স্বাধীনতার অধিকার। 
(খ) সামাজিক মর্যাদা , সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার , সকল প্রকারের আইনগত অধিকার - ইত্যাদি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সমান সুযোগ সুবিধার উপস্থিতি। 
(গ) সমাজের দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা। 

ন্যায়ের প্রকৃতি সম্পর্কে রবার্ট নোজিক - এর অভিমত :- 
ন্যায়ের প্রকৃতি বিষয়ে জন রুলসের মতবাদের বিরোধী মতবাদ পোষণ করেন রবার্ট নোজিক। রবার্ট নোজিক ন্যায়ের যে প্রকৃতি বিশ্লেষণ করেছেন - তা পদ্ধতিগত ন্যায়ের তত্ত্ব নামে পরিচিত। এই তত্ত্ব অনুসারে , রাষ্ট্র হবে সর্বাপেক্ষা কম শক্তিশালী ; সম্পত্তি ও মুনাফার উপর ব্যক্তির অধিকার সর্বদা প্রতিষ্ঠিত থাকবে। নাগরিকদের সম্পত্তি ও মুনাফার সমবন্টন নীতি অনুসরণ করে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করলে - তা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।    

মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ন্যায়ের প্রকৃতি :- 
মার্কসবাদীরা ন্যায় বলতে অর্থনৈতিক সাম্যের কথা বলেন। মার্কসবাদীদের মতে , সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য ব্যতীত সাম্য , অধিকার , স্বাধীনতা , অধিকার - ইত্যাদি বিষয়গুলি অর্থহীন হয়ে পড়ে। তাই সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে একমাত্র শোষণমুক্ত সাম্যবাদী সমাজে। একমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলেই সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। 

পরিশেষে বলা যায় , ন্যায় মূলতঃ সামাজিক আদর্শসমূহের সমন্বয়সাধনকারী হলেও তা ভিন্ন ভিন্ন স্থানে , ভিন্ন ভিন্ন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তিত হয়। কেননা , দেশ ও কালভেদে আদর্শসমূহের পরিবর্তন ঘটে। আধুনিক যুগে রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রচিন্তার পরিবর্তনের ফলে সাম্যের ধারণার বিবর্তন ঘটেছে এবং যথার্থ সাম্য প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়েছে।    

    

You May Also Like

1 comments

  1. This is the best post of my life. Thank you very much. I love reading your writings. I posted one too. Will check a bit 🙏 মুনাজাতের পিক

    ReplyDelete