ভারতে নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কর্মসূচী :-

by - May 02, 2022

ভারতে নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কর্মসূচীগুলি আলোচনা কর।  

স্বাধীন ভারতে নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপগুলি আলোচনা কর। 

Discuss various steps and programs to eradicate illiteracy in India. ( In Bengali ) . 



ভারতে নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কর্মসূচি :- 


ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের অন্যতম প্রধান সমস্যাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নিরক্ষরতার সমস্যা। সেই সময়ে ভারতে সাক্ষরতার হার ছিল তলানিতে মাত্র ১৬.৬ শতাংশ । এরপর থেকে ভারতের নিরক্ষরতা দূরীকরণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচিগুলির জন্য ভারতের সার্বিক শিক্ষার প্রসারে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। যদিও ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতে সাক্ষরতার হার ৭৪.০৪ শতাংশ। চিত্রটি আশাপ্রদ না হলেও ভারতে সাক্ষরতা কর্মসূচি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। ভারতে নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি ও পদক্ষেপগুলি হল - 


১. কোঠারি কমিশন ১৯৬২-৬৪ :- 
ভারতে সার্বিক শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে গঠিত হয় কোঠারি কমিশন। কোঠারি কমিশন ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতে সার্বিক শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করে। এই সুপারিশগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান হল - 
(ক ) বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার পরিকাঠামোগত পরিবর্তন ঘটানো দরকার। 
(খ ) বিজ্ঞান শিক্ষার বিস্তার। 
(গ ) শিক্ষাকে কর্মমুখী করে তোলার জন্য কর্ম অভিজ্ঞতার উপর গুরুত্ব দেওয়া। 
(ঘ ) সমস্ত বিদ্যালয়গুলিকে কমন স্কুলে পরিণত করে আগামী ২০ বছরের মধ্যে সকলের জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা। 
(ঙ ) প্রতি ১ কিলোমিটারের মধ্যে ১ টি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা। 
(চ ) শিক্ষা প্রসারের কাজে গণমাধ্যমগুলিকে কাজে লাগানো। 

২. জাতীয় শিক্ষানীতি ১৯৬৮ :- 
কোঠারি কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষিত হয়। জাতীয় শিক্ষানীতির উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলি হল - 
(ক ) বয়স্ক শিক্ষার প্রসার। 
(খ ) প্রতিটি গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন। 
(গ ) শিক্ষার প্রসারের জন্য গণমাধ্যমগুলিকে ব্যবহার করা। 
(ঘ ) দূর শিক্ষার প্রসার। 
(ঙ ) নিরক্ষর শ্রমিকদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার। 


৩. জাতীয় বয়স্ক সাক্ষরতা প্রকল্প বা NAEP :- 
১৯৭৮ সালের ২ রা অক্টোবর জাতীয় বয়স্ক সাক্ষরতা প্রকল্প গৃহীত হয়। ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়স্ক নিরক্ষর ব্যক্তিরা এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল - 
(ক ) বয়স্ক নিরক্ষর ব্যক্তিদের মধ্যে 3R এর জ্ঞান প্রদান। 
(খ ) নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বয়স্কদের সচেতন করা। 
(গ ) বয়স্কদের মধ্যে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা। 
(ঘ ) ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধার মনোভাব তৈরী করা। 
(ঙ ) অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার দূর করা। 

৪. জাতীয় শিক্ষানীতি ১৯৮৬ :- 
১৯৮৬ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষিত হয়। ভারতে সাক্ষরতার প্রসারে জাতীয় শিক্ষানীতির সুপারিশগুলি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। জাতীয় শিক্ষানীতির উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলি ছিল - 
(ক ) সর্বস্তরের শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রথা - বহির্ভুত শিক্ষা ও দূরশিক্ষার প্রতি গুরুত্ব প্রদান। 
(খ ) ১৫ - ৩৫ বছর বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে সাক্ষরতার প্রসার ঘটানো। 
(গ ) প্রতিবন্ধীদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন করা। 
(ঘ ) সংখ্যালঘুদের শিক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। 
(ঙ ) UGC , AICTE , NCERT - ইত্যাদি জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিশালী করা। 
(চ ) অর্থপূর্ণ অংশীদারিত্বের প্রতি গুরুত্ব প্রদান। 


৫. অপারেশন ব্ল্যাকবোর্ড :- 
১৯৮৬ সালের জাতীয় শিক্ষানীতির সুপারিশক্রমে অপারেশন ব্ল্যাকবোর্ড নামক এক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ব্ল্যাকবোর্ড শব্দটির দ্বারা প্রাথমিক স্তরের সমস্ত রকম শিক্ষা উপকরণগুলিকে বোঝানো হয়েছে। এই কর্মসূচির বিশেষ কয়েকটি দিক ছিল - 
(ক ) প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের জন্য ক্রীড়াভিত্তিক শিক্ষানীতি গ্রহণ করা। 
(খ ) প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিক্ষা সহায়ক উপকরণগুলি সরবরাহ করা। 
(গ ) প্রতিটি বিদ্যালয়ে অন্ততঃ দুজন শিক্ষক নিযুক্ত থাকবেন ; যার মধ্যে একজন হবেন মহিলা। 
(ঘ ) প্রতিটি বিদ্যালয়ে পানীয় জল ও শৌচাগার স্থাপন করা। 
(ঙ ) সকল ঋতুতে ব্যবহারযোগ্য শ্রেণীকক্ষের ব্যবস্থা করা। 

৬. গ্রামীণ ব্যবহারিক সাক্ষরতা কর্মসূচি বা RFLP :- 
জাতীয় শিক্ষানীতির সহায়ক প্রকল্প হিসাবে গ্রামীণ ব্যবহারিক সাক্ষরতা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এই প্রকল্পের মূল বিষয়গুলি ছিল - 
(ক ) গ্রামীণ জনগণের সাক্ষরতার প্রসারে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান। 
(খ ) প্রকল্পের ব্যায়ভার বহন করবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। 
(গ ) সাক্ষরতার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। 
(ঘ ) প্রকল্পের সার্থক রূপায়ণের জন্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে অংশগ্রহণ করানো। 


৭. জাতীয় সাক্ষরতা মিশন NLM :- 
১৯৮৮ সালের ৫ ই মে জাতীয় সাক্ষরতা মিশন গঠিত হয়। এই মিশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ণ সাক্ষরতা। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যগুলি ছিল - 
(ক ) ১৯৯০ সালের মধ্যে ৩০ মিলিয়ন বয়স্ক ব্যক্তিকে সাক্ষর করে তোলা। 
(খ ) ১৯৯৫ সালের মধ্যে আরও ৫০ মিলিয়ন ব্যক্তিকে সাক্ষর করে তোলা। 
(গ ) অর্থনৈতিক অবস্থা ও স্বচ্ছল থাকার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করা। 
(ঘ ) গাণিতিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস অর্জন করা। 
(ঙ ) ১৯৯০ সালের মধ্যে ৬-১১ বছরের বালক বালিকাদের জন্য শিক্ষা এবং ১৯৯৫ সালের মধ্যে সর্বস্তরের ব্যক্তিদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার। 

৮. সর্বশিক্ষা অভিযান :- 
২০০০ সালে সেপ্টেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক Millennium Development Goal এর প্রস্তাব অনুযায়ী এবং সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের জন্য Apex Court দ্বারা নির্দেশিত হয়ে ভারত সরকার সর্বশিক্ষা অভিযান কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং তা কার্যকর হয় ২০০২ সালে। ভারতে গৃহীত শিক্ষা কর্মসূচিগুলির মধ্যে সর্বাধিক সাফল্যপ্রাপ্ত কর্মসূচি হল সর্বশিক্ষা অভিযান। সর্বশিক্ষা অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল - 
(ক ) ৫ - ১৪ বছর বয়সী সমস্ত শিশুর অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা সুনিশ্চিত করা। 
(খ ) নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষার পাশাপাশি বিকল্প ও পরিপূরক শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা। 
(গ ) বুনিয়াদি শিক্ষা সুনিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। 
(ঘ ) জীবন উপযোগী শিক্ষার ব্যবস্থা করা। 
(ঙ ) ২০১০ সালের মধ্যে সমস্ত শিশুর ৮ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করা।      

পরিশেষে বলা যায় , ভারত পূর্ণ সাক্ষরতার লক্ষ্যে ধীর গতিতে হলেও এগিয়ে চলেছে। পূর্ণ সাক্ষরতার জন্য সরকারি কর্মসূচিগুলির পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সদিচ্ছা ও সচেতনতা ; রাজনৈতিক সদিচ্ছা ; শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলির যথাযথ ভূমিকা ও অর্থপূর্ণ অংশীদারিত্ব - ইত্যাদির প্রয়োজন।    


You May Also Like

0 comments