ভারতে নিরক্ষরতার কারণগুলি আলোচনা কর।

by - April 30, 2022

ভারতে নিরক্ষরতার কারণগুলি আলোচনা কর। 

ভারতে নিরক্ষরতার জন্য দায়ী উপাদানগুলি সম্পর্কে লেখ। 

Causes of  Illiteracy in India . ( In Bengali ) .




ভারতে নিরক্ষরতার কারণ :- 


ভারতে নিরক্ষরতার বিষয়টি একটি অন্যতম সামাজিক সমস্যা। স্বাধীনোত্তর ভারতে নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য বহু পদক্ষেপ ও কর্মসূচি গৃহীত হলেও ভারত আজও নিরক্ষরতার সমস্যায় জর্জরিত। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতে সাক্ষরতার হার ৭৪.০৪ শতাংশ ; অর্থাৎ ২৫ শতাংশের বেশি মানুষ আজও নিরক্ষর। নিরক্ষরতা এমন একটি সামাজিক সমস্যা যা অন্যান্য বহুবিধ সামাজিক সমস্যার জন্ম দেয়। ভারতে নিরক্ষরতার কারণগুলি হল - 


১. ব্রিটিশদের ভূমিকা :- ব্রিটিশরা ভারতে প্রায় ২০০ বছর রাজত্ব করে। এই সময়কালে তারা নিজেদের প্রশাসনিক স্বার্থে শিক্ষামূলক কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও গণশিক্ষা প্রসারের জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। শিক্ষা ছিল শহুরে শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ফলে গ্রামীণ ভারতের বিরাট সংখ্যক মানুষ সাক্ষরতার সুযোগ থেকে বহু দূরে ছিলেন। তাই স্বাধীনতা লাভের সময় জনগণের সিংহভাগই ছিলেন নিরক্ষর। 

২. ঐতিহাসিক পটভূমিকা :- সামান্য কিছু ব্যাতিক্রম বাদ দিলে ব্রিটিশদের পূর্বে সুলতানি ও মোগল যুগে প্রশাসকেরা ব্যাস্ত ছিলেন যুদ্ধ - বিগ্রহ , সাম্রাজ্য বিস্তার ও সামরিক উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি দিয়ে। কিছু ক্ষেত্রে মক্তব , মাদ্রাসা ও হিন্দু শিক্ষার প্রচলন থাকলেও তা সামগ্রিক জনগণের প্রয়োজনের নিরিখে ছিল নিতান্তই নগন্য। প্রায় ৬০০ বছর ধরে চলা ইসলামি শাসন ছিল ভারতের শিক্ষা ক্ষেত্রে এক অন্ধকার যুগ। 


৩. বর্ণভেদ ও জাতিভেদের প্রভাব :- ভারতে চিরাচরিতভাবে বর্ণভেদ ও জাতিভেদ প্রথা প্রচলিত ছিল। এই প্রথা অনুসারে সমাজের নিচু বর্ণভুক্ত মানুষেরা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। কয়েক হাজার বছর ধরে চলা বর্ণভেদ ও জাতিভেদ প্রথা এক বিরাট অংশের মানুষকে নিরক্ষর থাকতে বাধ্য করেছিল। 

৪. জনবিস্ফোরণ :- ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতের জনসংখ্যা ১২১ কোটি ছাড়িয়ে গেছে এবং প্রতি বছর অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যার সমসংখ্যক জনসংখ্যা ভারতে জন্ম নিচ্ছে। এই বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তোলা এখনো সম্ভব হয়নি। 

৫. অর্থনৈতিক কারণ :- ভারতের বহু সংখ্যক মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করেন। এছাড়াও ভারতে মাথাপিছু গড় আয় অত্যন্ত কম। এই সকল মানুষদের ক্ষেত্রে শিক্ষা গ্রহণের তুলনায় রুজি - রোজগার ও বৃত্তিমূলক কর্মে অংশগ্রহণ করা অধিক প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হয়। তাই সর্বজনীন শিক্ষার জন্য বহুবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও আশানুরূপ সফলতা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। 

৬. বিভিন্ন শিক্ষা কর্মসূচির ব্যর্থতা :- ভারতে সাক্ষরতার প্রসারের লক্ষ্যে বহুবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন - অপারেশন ব্ল্যাকবোর্ড , জাতীয় সাক্ষরতা মিশন , সর্বশিক্ষা অভিযান - ইত্যাদি। এই সকল কর্মসূচীগুলি গ্রহণ করা হলেও কোনো কর্মসূচিই সম্পূর্ণ সফলতা অর্জন করতে পারেনি। বহু ক্ষেত্রেই কর্মসূচীগুলি শুধুমাত্র খাতায় - কলমে থেকে গেছে। 


৭. অর্থ - বরাদ্দের অভাব :- ভারত সর্বজনীন শিক্ষার বিস্তারের ক্ষেত্রে খুব সামান্য অর্থ বরাদ্দ করে - জাতীয় আয়ের মাত্র ৩ শতাংশ। বিভিন্ন পিছিয়ে পড়া ও উন্নয়নশীল দেশগুলিও শিক্ষা খাতে জাতীয় আয়ের ৬ শতাংশ ব্যয় করে। এমনকি , নেপাল , শ্রীলংকা , বাংলাদেশ - এইসকল পিছিয়ে পড়া দেশগুলিও শিক্ষাখাতে ৩ শতাংশের বেশি ব্যয় করে। 

৮. বয়স্ক শিক্ষার অভাব :- ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়স্ক যেসকল ব্যক্তি শিক্ষা গ্রহণ থেকে বিরত আছেন - তাদের বয়স্ক বলে। ভারতে প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে বহু পদক্ষেপ ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও বয়স্ক শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। যদিও ১৯৭৮ সালে জাতীয় বয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচি বা NAEP গ্রহণ করা হলেও - সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উদাসীনতা , বয়স্কদের অসহযোগিতা লক্ষ্য করা গেছে। 

৯. সুচিন্তিত পরিকল্পনার অভাব :- স্বাধীন ভারতে একের পর এক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও - সেগুলি কতটা বিজ্ঞানসম্মত ও সুচিন্তিত ছিল - তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। প্রতিটি কর্মসূচি রূপায়িত হওয়ার এক দশকের মধ্যে তা সমালোচিত হয়েছে। একটি শিক্ষা নীতির ভুল সংশোধনের জন্য আরেকটি শিক্ষা নীতি গৃহীত হয়েছে। ফলে শিক্ষা কর্মসূচীগুলি সার্থকভাবে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। 

১০. মানুষের সার্বিক সচেতনতার অভাব :- ভারতের এক বিরাট অংকের মানুষ নিরক্ষর। এইসকল নিরক্ষর মানুষেরা অনেক সময় সাক্ষরতার সুফল সম্পর্কে অবহিত থাকেন না। শিক্ষা যে মানুষের জন্মগত অধিকার - সে বিষয়েও তারা অসচেতন। সার্থক জীবন যাত্রার জন্য শিক্ষা যে কতটা অপরিহার্য তা তারা অনুভব করতে পারেন না। ফলে মানুষের সচেতনতার অভাব ভারতে নিরক্ষরতার একটি অন্যতম কারণ। 

১১. নারীশিক্ষার অভাব :- ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতে নারীশিক্ষার হার মাত্র ৬৫.৪৬ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ৩৫ শতাংশ নারী নিরক্ষর। নারীশিক্ষার এই করুন চিত্র ভারতের সাক্ষরতা বিকাশের পক্ষে একটি বড় বাধা। বহুদিন যাবৎ নারীদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। বর্তমানেও বহু সংখ্যক নারীকে কেবলমাত্র বিবাহের উদ্দেশ্যে শিক্ষা প্রদান করা হয়। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বহু নারীকে আজও বঞ্চিত রাখা হয়। 

১২. উপকরণ ও পরিকাঠামোর অভাব :- সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা কার্যকর করতে যে পরিমান উপকরণ ও পরিকাঠামো প্রয়োজন - তার ঘাটতি রয়েছে। বেশিরভাগ বিদ্যালয়গুলিতেই প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি ছাত্রসংখ্যা রয়েছে। এর ফলে যথার্থ পঠন - পাঠন ব্যাহত হচ্ছে। উপযুক্ত শ্রেণীকক্ষ , পুস্তক , প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষকের অভাব - ইত্যাদি শিক্ষার ধারাকে ব্যাহত করছে। 

পরিশেষে বলা যায় , ভারতের মত জনবহুল দেশে প্রকৃত অর্থে নিরক্ষরতা দূর করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা , কার্যকর নীতি প্রণয়ন , যথেষ্ট আর্থিক বরাদ্দ এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা বিস্তারের প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক শিক্ষানীতি গুলির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এবং ভারতীয় সমস্যার বাস্তবতার বিচারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।   

                      

You May Also Like

0 comments