নারীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হিংসাত্মক আচরণ সম্পর্কে আলোচনা কর।

by - May 02, 2022

নারীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হিংসাত্মক আচরণ সম্পর্কে আলোচনা কর। 

Discuss organized violence against women.


নারীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হিংসাত্মক আচরণ :- 


নারীদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক আচরণ বিভিন্ন সমাজে বিভিন্নভাবে প্রচলিত। বর্তমান যুগেও নারীরা তাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হিংসাত্মক আচরণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পান নি। নারীদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক আচরণ সংগঠিত করার মূল কারণ হল সমাজে পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা ও বিকৃত মানসিকতা। নারীদের মর্যাদাগত উন্নতির লক্ষ্যে বিভিন্ন আন্দোলন , বিভিন্ন আইন ও বিভিন্ন সমাজ সংস্কারের ফলে পরিস্থিতি কিছুটা বদলালেও নারীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হিংসাত্মক আচরণ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়নি। নারীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত বিভিন্ন হিংসাত্মক আচরণগুলি হল - 


১. পারিবারিক হিংসা :- 
নারীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হিংসাত্মক আচরণের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হল পারিবারিক হিংসা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পারিবারিক হিংসাগুলির কোনো রিপোর্ট করা হয়না - তাই এগুলি সম্পর্কে সঠিক পরিসংখ্যান প্রদান করা সম্ভব নয়। বেশিরভাগ পরিবারগুলিতেই নারীদের স্বাধীনতা অস্বীকার করা হয়। উদয়াস্ত পরিশ্রম , শারীরিক নিগ্রহ - এগুলি তাদের নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়। এই ধরণের পারিবারিক হিংসাগুলির কোনো প্রতিকার হয়না। 

২. পণ সংক্রান্ত হিংসাত্মক আচরণ :- 
আইন করে পণপ্রথা বন্ধ করে দেওয়া হলেও বহু ক্ষেত্রে পণপ্রথা আজও সমানভাবে প্রচলিত। প্রায় প্রতিদিন পণের দায়ে বধূহত্যার খবর দেখা যায় সংবাদ শিরোনামে। অনেক ক্ষেত্রেই বিবাহের সময় পণ না নেওয়া হলেও বিবাহের পর বিভিন্ন অজুহাতে পণ দাবী করা হয়। পাত্রপক্ষের দাবীমত পণ প্রদান করতে না পারলে বধূর উপর নেমে আসে নিদারুন শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার। এমনকি বহুক্ষেত্রে এই অত্যাচার বধূহত্যা পর্যন্ত এগিয়ে যায়। ১৯৬১ সালে পণপ্রথা বেআইনি বলে ঘোষিত হলেও আজো এর কুপ্রভাব থেকে নারীরা সম্পূর্ণ মুক্তি পাননি। 


৩. কন্যাভ্রূণ ও শিশুকন্যা হত্যা :- 
আজ গর্ভের মধ্যস্থ ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু তবুও কিছু অসাধু উপায়ে বহু ক্ষেত্রে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করা হচ্ছে এবং বহু ক্ষেত্রে সেই ভ্রূণ কন্যাভ্রূণ হলে তা নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। ভ্রূণ হত্যা ছাড়াও কন্যাশিশু হত্যা , কন্যা সন্তান জন্ম দিলে কন্যা সহ মা'কে তার পিত্রালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া বা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া - ইত্যাদি ঘটনা আজও ঘটে চলেছে। এইভাবে বিপুল পরিমান কন্যাভ্রূণ ও কন্যাসন্তান হত্যা করার ফলে নারী পুরুষের অনুপাতের ক্ষেত্রে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। 

৪. যৌন নির্যাতন :- 
ধর্ষণ , শ্লীলতাহানি - এই সকল যৌন নির্যাতন প্রতিদিনই সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে আসে। এছাড়াও বহু শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটে যা প্রকাশ্যে আসেনা। এই ধরণের ঘটনার সংখ্যাই বেশি। National Crime Record Bureau উল্লেখ করেছে ২০১২ সালে নারীধর্ষণের ঘটনা ২৪,৯২৩ টি ও শ্লীলতাহানির ঘটনা ৪৫,৩৫১ টি। এই ধরণের যৌন নির্যাতন নারীদের শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবেই বিধ্বস্ত করে তোলে। বহু ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রমাণের অভাব - ইত্যাদি কারণে দোষীরা আইনের ফাঁক গলে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে এই ধরণের ঘটনা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। 

৫. অপহরণ ও নারীপাচার :- 
National Crime Record Bureau তথ্য প্রদান করেছেন ২০১২ সালে নারী অপহরণের ঘটনা ৩৮২৬২ টি। নারী অপহরণ ও নারীপাচারের বিষয়টি একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। নারীদের অপহরণ করা হয় মূলতঃ দুটি কারণে - বিকৃত কামনা চরিতার্থ করার জন্য এবং নারী পাচারের জন্য। অপহরণ করে নারীদের বিভিন্ন শহরের পতিতালয়গুলিতে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এই অন্ধকার জগৎ থেকে নারীদের বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়না এবং কিছু ক্ষেত্রে নারীদের উদ্ধার করা সম্ভব হলেও সামাজিক কারণে এই সকল নারীদেরকে তাদের পরিবার ত্যাগ করে। নারীদের বিরুদ্ধে এটি একটি দুৰ্ভাগ্যপূর্ণ আচরণ। 

৬. নাবালিকাদের প্রতি হিংসাত্মক আচরণ :- 
বর্তমানে নাবালিকাদের প্রতি যৌন অত্যাচারের ঘটনা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিকট বা দূরসম্পর্কের আত্মীয় , পাড়া - প্রতিবেশী , শিক্ষক বা গৃহশিক্ষক এমনকি পরিবারের পুরুষ সদস্যের দ্বারাও নাবালিকাদের প্রতি যৌন - নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। বহু ক্ষেত্রেই নাবালিকারা তাদের প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায়ের কথা কাউকে বলতে পর্যন্ত পারেনা এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের ভয় দেখানো হয় কাউকে না বলার জন্য। 


৭. কর্মরতা নারীদের প্রতি হিংসাত্মক আচরণ :- 
কর্মরতা নারীদের কর্মক্ষেত্রে নানাবিধ হিংসাত্মক আচরণের সম্মুখীন হতে হয়। চাকরি বজায় রাখা বা পদোন্নতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীদের খুব সহজেই যৌন পণ্যে পরিণত করা হয়। কাজ পাইয়ে দেওয়া , সিনেমা বা দূরদর্শনে কাজের সুযোগ , এবং অন্যান্য আরো অনেক অসহায় পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নারীদের যৌন দাসে পরিণত করা হয়। এছাড়াও কর্মক্ষেত্রে পুরুষ সহকর্মীদের বিভিন্ন বিকৃত আচরণ নারীদের সর্বদাই আতঙ্কিত করে রাখে। 

৮. অন্যান্য হিংসাত্মক আচরণ :- 
নারীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত উপরোক্ত হিংসাত্মক আচরণগুলি ছাড়াও অন্যান্য হিংসাত্মক আচরণগুলি হল - যুদ্ধকালীন যৌন অত্যাচার , বলপূর্বক গর্ভপাত , রাস্তা - পথে - ট্রেনে - বাসে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি ও শ্লীলতাহানি , উশৃঙ্খল জনগণ দ্বারা যৌন হয়রানি , বলপূর্বক বিবাহদান , বলপূর্বক পতিতাবৃত্তি , সন্মান রক্ষার্থে হত্যা - ইত্যাদি। 

পরিশেষে বলা যায় , নারীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হিংসাত্মক আচরণগুলি প্রাচীন সমাজ থেকেই চলে আসছে। আধুনিককালে এইসকল হিংসাত্মক আচরণ বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন আইন প্রণীত হলেও তা যথেষ্ট প্রতিপন্ন হয়নি। তাই এবিষয়ে নারীদের সচেতনতা , বিশেষ শিক্ষার বিস্তার , সামাজিক সুরক্ষা , কার্যকর আইন প্রণয়ন - এইসকল বিষয়গুলি সুনিশ্চিত করা প্রয়োজন।     


   

You May Also Like

0 comments