ভারতে দারিদ্রতার বিভিন্ন কারণগুলি আলোচনা কর।

by - April 24, 2022

ভারতে দারিদ্রতার বিভিন্ন কারণগুলি আলোচনা কর। 

Causes of poverty in India . ( In Bengali ). 




ভারতে দারিদ্রতার কারণ :- 


২০১৩ সালের একটি হিসেব অনুযায়ী ভারতে দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করেন প্রায় ৩০% মানুষ। International Poverty Line অনুযায়ী ভারতে প্রায় ৩২ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করেন। ভারতে প্রতি ৫ জন যুবকের মধ্যে ১ জন দারিদ্রতার শিকার এবং ৪ জন কৃষকের মধ্যে ১ জন চরম দারিদ্রের শিকার। 
ভারতে দারিদ্রতার কারণগুলি মূলতঃ ব্যক্তিগত , সামাজিক , অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক। গিলিন ও গিলিন দারিদ্রতার কারণগুলোকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন। সেগুলি হল - ব্যক্তির অসামর্থ্য , ভৌগোলিক পরিবেশের বৈপরীত্য , অর্থনৈতিক কারণ , সামাজিক সংগঠনের ত্রুটি এবং যুদ্ধ। মার্কসবাদীরা দারিদ্রতার কারণকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। মার্কসবাদীদের মতে , শ্রেণি শোষণ ; যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের সাহায্যে এক শ্রেণির মানুষ অপর শ্রেণীকে শোষণ করে। 
ভারতে দারিদ্রতার মৌলিক কারণগুলোকে নীচে আলোচনা করা হল। 

১. নিরক্ষরতা :- নিরক্ষরতা ও দারিদ্রতা বিষয়দুটি প্রায় সমার্থক। কোনো ব্যক্তি নিরক্ষর হলে স্বাভাবিকভাবেই সে কর্মক্ষেত্রে নিজেকে উপযুক্ত বলে প্রমান করতে পারেনা। ফলে খুব সহজেই নিরক্ষর ব্যক্তিরা দারিদ্রতার শিকার হয়ে পড়ে। নিরক্ষরতার ফলে ব্যক্তি যেমন একদিকে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ পান না ; তেমনি অন্যদিকে নিজ উদ্যোগে অর্থের সংস্থান করতেও বিভিন্ন সমস্যা হয়। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতে সাক্ষরতার হার ৭৪.০৪% ; অর্থাৎ প্রায় ২৫ শতাংশের বেশি মানুষ নিরক্ষর।  

২. বেকারত্ব :- বর্তমানে ভারতে প্রায় ৭.৪% মানুষ বেকারত্বের শিকার। তীব্র বেকারত্বের ফলে স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের এবং নিজেদের উপর নির্ভরশীল মানুষদের ন্যুনতম চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হন। বর্তমানকালে শিক্ষাগত বেকারত্বের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কর্মী সংকোচন , কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস , যথাযথ নীতির অভাব , রাজনৈতিক অসাধুতা - ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে বেকারত্বের সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না এবং দারিদ্রতার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। 


৩. ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা :- বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা ও পাঠক্রম ব্যক্তির সর্বাঙ্গীন বিকাশে সহায়ক হলেও কর্মসংস্থান ও বৃত্তিগত ক্ষেত্রে তা কার্যকরী নয়। ফলে উচ্চশিক্ষিত হয়েও বহু মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছেন না। পেশাদারি ও বৃত্তিগত শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। কার্যকরী ও কর্মমুখী পাঠক্রমের অভাব ভারতে দারিদ্রতার একটি অন্যতম কারণ। 

৪. মুদ্রাস্ফীতি :- মুদ্রাস্ফীতি কথাটির অর্থ হল অর্থের মূল্য কমে যাওয়া। এর ফলে প্রতিটি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী ক্রয় করতেই মানুষের সমস্যা তৈরী হয়। ফলে নির্দিষ্ট আয়যুক্ত মানুষের ক্ষেত্রে ব্যায়ভার দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। এর ফলে একদিকে যেমন , সরকারের বাজেট সংকুচিত হচ্ছে ও উন্নয়নমূলক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে এবং অন্যদিকে মানুষ জীবনধরণের জন্য ন্যুনতম সামগ্রী সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এইভাবে মুদ্রাস্ফীতি দারিদ্রতা বৃদ্ধি করছে। 

৫. কৃষিক্ষেত্রের সমস্যা :- ভারতীয় অর্থনীতির মেরুদন্ড হল কৃষি। অতিমাত্রায় কৃষি নির্ভরতা ভারতে দারিদ্রতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আবার কৃষকদেরও বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। যেমন - বীজ , সার ইত্যাদির মূল্যবৃদ্ধি , কৃষি শিক্ষার অভাব , আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা , মৌসুমী বায়ুর উপর নির্ভরশীলতা - ইত্যাদি কারণে ভারতীয় কৃষি উৎপাদন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ফলে কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষদের প্রতি ৪ জনের মধ্যে একজন চরম দারিদ্রের শিকার। 

৬. প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব :- ভারতে এমন বহু এলাকা রয়েছে যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদ অপ্রতুল এবং ভূমিরূপ ও আবহাওয়া কৃষির পক্ষে উপযুক্ত নয়। এই সমস্ত এলাকায় বসবাসকারী মানুষেরা খুব সহজেই দারিদ্রতার শিকার হয়ে পড়েন। রাজস্থানের বিস্তীর্ণ মরু মৃত্তিকা অঞ্চল , উপকূলীয় বালুকাময় বিস্তীর্ণ অঞ্চল - ইত্যাদি অঞ্চল কৃষি , পশুপালন - এসবের পক্ষে উপযুক্ত নয়। ফলে এই সমস্ত এলাকায় তীব্রভাবে কর্মসংস্থানের অভাব পরিলক্ষিত হয়। 


৭. প্রাকৃতিক বিপর্যয় :- ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় আবহাওয়া ও জলবায়ুর খামখেয়ালিপনার দরুন কৃষি সহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কার্যাবলী তীব্রভাবে ব্যাহত হয়। বন্যা , খরা , অতিবৃষ্টি , ভূমিকম্প , নিম্নচাপ , ঘূর্ণিঝড় - ইত্যাদি প্রাকৃতিক ঘটনাগুলি অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপগুলিকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে। বহু মানুষ এইসকল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কবলে পড়ে সর্বশান্ত হয়ে যান। ফলে খুব সহজেই তাদের জীবনে দারিদ্রতা নেমে আসে। 

৮. জমির উপর চাপ বৃদ্ধি :- ভারতে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ; সেই সঙ্গে বাড়ছে কৃষি জমির উপর চাপ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মাথাপিছু জমির পরিমান কমে যায়। বর্তমানে ভারতীয় নাগরিকদের মাথাপিছু চাষযোগ্য জমির পরিমান এক একরের থেকেও কম। ফলে মাথাপিছু জমির পরিমান যত কমছে জমি থেকে আয় তত কমছে। জমি থেকে ক্রমাগত আয় কমার ফলে জমির উপর নির্ভরশীল মানুষদের মধ্যে দারিদ্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

৯. মূলধনের অভাব :- শিল্পের প্রসারের জন্য প্রয়োজন মূলধন। দেশীয় ও বৈদেশিক শিল্প সংস্থাগুলি সীমিত হারে মূলধন বিনিয়োগ করে। এইসকল শিল্পসংস্থার একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে মুনাফা অর্জন। তাই , এই সকল শিল্পসংস্থায় অধিক পরিমানে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী হয়না। এছাড়াও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সংস্থার পুঁজি এতটাই কম থাকে যে তাদের পক্ষে নতুন করে বিনিয়োগ সম্ভব হয়না। অনেক দেশীয় শিল্প সংস্থা মূলধনের অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে বেকারত্ব ও দারিদ্রতার পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

১০. উৎপাদিত পণ্যের অসম বন্টন :- উৎপাদিত শিল্পজাত ও কৃষিজাত পণ্যের অসম বন্টন দারিদ্রতা সৃষ্টি করে। উৎপাদিত পণ্যের অসম বন্টনের জন্য সম্পদ , খাদ্যসামগ্রী - ইত্যাদি সবকিছু এক শ্রেণির মানুষের হস্তগত হয় এবং এক বিরাট অংশের মানুষ সেগুলি থেকে বঞ্চিত থাকে। ফলে সমাজে তীব্র বৈষম্য ও দারিদ্রতা সৃষ্টি হয়। 

১১. অপর্যাপ্ত আর্থিক নীতি :- ভারতে দারিদ্রতা দূরীকরণে যেসকল আর্থিক নীতি গৃহীত হয় তা সামগ্রিক পরিস্থিতির বিচারে পর্যাপ্ত নয়। এছাড়াও সেইসকল নীতিগুলি যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয়না। এছাড়াও স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন ভ্রান্ত ও সাম্রাজ্যবাদী নীতি ভারতীয় অর্থনীতিকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর আজ এত বছর পার হয়ে গেলেও তীব্র জনসংখ্যা বৃদ্ধি , রাজনৈতিক অসাধুতা - ইত্যাদির কারণে দারিদ্রতা মোচনের জন্য কোনো যথার্য ও কার্যকরি নীতি প্রবর্তন করা সম্ভব হয়নি। 

১২. ব্যক্তিগত কারণ :- দারিদ্রতার ব্যক্তিগত কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলি হল - শ্রমবিমুখতা , অমিতব্যয়িতা , নৈতিক অবনমন , ঋণগ্রস্থতা , অসুস্থতা , বিভিন্ন দুর্ঘটনা , অসুস্থতা , মানসিক রোগ ইত্যাদি। এইসকল ব্যক্তিগত কারণগুলির ফলে মানুষ উৎপাদনশীলতা হারিয়ে ফেলেন এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারেন না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দারিদ্রতা বৃদ্ধি পায়। 

এছাড়াও , অনুপ্রবেশ , যুদ্ধ - বিগ্রহ , রাজনৈতিক অস্থিরতা , রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি , জাতিভেদ প্রথা , ধর্মীয় বিশ্বাস , বিচ্ছিন্নতাবাদ - ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়গুলি ভারতীয় সমাজে দারিদ্রতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।    

   

You May Also Like

0 comments