সামাজিক অসাম্যের প্রকৃতি , বিভিন্ন ধরণের সামাজিক অসাম্য :-

by - April 20, 2022

সামাজিক অসাম্যের প্রকৃতি আলোচনা কর। 

বিভিন্ন ধরণের সামাজিক অসাম্য সম্পর্কে আলোচনা কর। 

Nature and different types of Social Inequality . ( In Bengali ).




সামাজিক অসাম্যের প্রকৃতি :- 

বিভিন্ন ধরণের সামাজিক অসাম্য :- 


১. নীতিগত ক্ষেত্রে অসাম্য :- 
রাষ্ট্র বা সরকার সমাজের জন্য বিভিন্ন প্রকার নীতি প্রবর্তন করে। এই সকল নীতির মধ্যে শাস্তি ও পুরস্কার প্রদানের নীতিও থাকে। মানুষের প্রত্যাশা , জনকল্যাণ - ইত্যাদির জন্য বিভিন্ন নীতি প্রণীত হলেও তা পক্ষান্তরে অসাম্যের জন্ম দেয়। কিন্তু সমাজের যে সকল অংশে উন্নয়ন যথার্থভাবে হয়না - সেই সকল অঞ্চলে জন্ম নেয় অসাম্য এবং এই অসাম্য থেকেই জন্ম নেয় বিচ্ছিন্নতাবাদ - ইত্যাদি রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি। এছাড়াও সরকার নীতি প্রণয়নের সময় সমাজের সকল অংশের কথা মাথায় রেখে নীতি প্রণয়ন করেন না। এই নীতিগত অসাম্য মানুষকে বাধ্য করে বিপ্লব ও আন্দোলনের পথে চালিত হতে। 

২. সামাজিক গতিশীলতার ক্ষেত্রে অসাম্য :- 
সমাজে প্রচলিত বিধি - নিয়মগুলিকে কেউ কেউ মান্য করেন নিজেদের স্বার্থ পূরণের তাগিদে। আবার কেউ কেউ সেগুলিকে অমান্য করেন প্রত্যাশা পূরণ না হলে। সমাজের গতিশীলতা সমাজের সকল অংশে সমানভাবে বাস্তবায়িত হয়না। অনুন্নত , অনগ্রসর সম্প্রদায় - প্রচলিত সমাজ - ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে নতুন সমাজ গড়ে তুলতে চান। সমাজের প্রচলিত নিয়ম - বিধি সমাজের বিশেষ অংশের স্বার্থ পূরণে সক্ষম হলেও সমাজের সকল অংশের গতিশীলতার পক্ষে কার্যকরী হয়না। 


৩. স্বাধীনতা ও অসাম্য :- 
দার্শনিক কান্ট মনে করেন , সামাজিক অসাম্য থেকে সমাজে ইতিবাচক ও নেতিবাচক - উভয় প্রকার শক্তি জন্ম নেয়। প্রতিটি সমাজে অসাম্য থাকে এবং সেই অসাম্যের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধাচারণও থাকে। সমাজের প্রতিটি অসাম্য যন্ত্রনাদায়ক ঠিকই ; কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথে মানুষের সংগঠিত আচরণ সামাজিক গতিশীলতার জন্ম দেয়। 

৪. সমাজের চালিকা শক্তি হিসাবে অসাম্য :- 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সামাজিক অসাম্যকে সমাজের মূল চালিকাশক্তি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে , সমাজে অসাম্য না থাকলে সমাজ গতিহীন হয়ে পড়ত। সামাজিক অসাম্য এক শ্রেণীর স্বার্থ সুরক্ষিত করে অপর শ্রেণীর স্বার্থ বিঘ্নিত করে। ফলে বঞ্চিত মানুষ সেই ব্যবধান দূর করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাই সমাজে অসাম্য আছে বলেই সমাজ সাম্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। 

৫. অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অসাম্য :- 
অর্থনৈতিক অসাম্যের মূলে থাকে উৎপাদন পদ্ধতি ও বন্টন ব্যবস্থা। উৎপাদন সংগঠিত হয় মূলত দুই শ্রেণীর মাধ্যমে। এই দুই শ্রেণী হল - মালিক ও শ্রমিক। মালিক হল অধিকারভোগী শ্রেণী এবং শ্রমিক হল অধিকারহীন শ্রেণী। তাই স্বাভাবিকভাবেই মালিক শ্রেণী শ্রমিকের উপর কর্তৃত্ব আরোপ করে এবং তাদের শোষণ করতে চায়। সাম্রাজ্যবাদের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ধনতন্ত্রবাদের প্রসার ঘটেছে এবং তার ফলে মালিক ও শ্রমিকের মধ্যবর্তি বৈষম্য আরো প্রকট হয়েছে। এছাড়াও রাষ্ট্রীয় নীতি সমাজের আর্থিক দিক দিয়ে দুর্বল মানুষদের আর্থিক সুরক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে কার্যকরী নীতি প্রবর্তন করতে পারেনা। 

৬. রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অসাম্য :- 
রাজনীতির মূল কথা হল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা। তাই , রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল ও সাম্য নীতির প্রতিষ্ঠা উভয়ই বিপরীতমুখী। কোনো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত থাকলেও অসাম্য সর্বদা বিরাজমান। প্রতিনিধি নির্বাচন , নীতি নির্ধারণ , রাষ্ট্র পরিচালনা - সর্বক্ষেত্রেই অসাম্য পরিলক্ষিত হয়। গণতন্ত্র ছাড়াও একনায়ক বা সামরিক শাসনে অসাম্য তীব্ররূপ ধারণ করে। সেখানে সকল ক্ষমতা শুধুমাত্র শাসকের হাতে ন্যাস্ত থাকে ; অন্যান্য সকলকে অনুগত প্রজার ন্যায় আচরণ করতে হয়। ভারতের মত দেশ , যেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত , সেখানেও ক্ষমতাশীল ব্যক্তি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বিস্তর অসাম্য লক্ষণীয়। 


৭. বর্ণগত অসাম্য :- 
বর্ণগত অসাম্য বা বর্ণবিদ্বেষ পৃথিবীর সর্বত্র লক্ষ্য করা যায়। এমনকি প্রথম বিশ্বের আধুনিক দেশগুলিও এর বাইরে নয়। শুধুমাত্র বর্ণের কারণে এক শ্রেণীর মানুষ অপর এক শ্রেণীর সকল প্রকার অধিকার , মর্যাদা , ক্ষমতা , মানবাধিকার - ইত্যদি নস্যাৎ করে দিয়ে তাদের শাসন করতে চান। হিটলারের হেরেনভেক তত্ত্ব , দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গ বিদ্বেষ , ভারতে দলিত সম্প্রদায়ের সামাজিক অধিকারহীনতা - ইত্যাদি বিষয়গুলিকে এপ্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। 

৮. শিক্ষা ও সংস্কৃতিগত ক্ষেত্রে অসাম্য :- 
সমাজের সর্বত্র যেহেতু অসাম্য বর্তমান , তাই শিক্ষা - সংস্কৃতি ক্ষেত্রেও অসাম্যের বিষয়টি প্রকট হয়ে ওঠে। আজও ভারতে পূর্ণাঙ্গ সাক্ষরতা সম্ভব হয়নি। সরকার একগুচ্ছ পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও এক শ্রেণীর মানুষের উদাসীনতা , অসচেতনতা , কিছু সামাজিক বাধ্যবাধকতা - ইত্যাদির জন্য পরিকল্পনাগুলির সম্পূর্ণ সুফল পাওয়া যায়না। ভারতীয় সংস্কৃতি উপাদানগত দিক দিয়ে সমৃদ্ধ হলেও তা আন্তর্জাতিক গুণমান অর্জনে আজও সফল হয়নি। তাই শিক্ষা - সংস্কৃতির রাশ এক শ্রেণীর মানুষ নিজের হাতে রেখে দিয়ে সমাজে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। ফলে সমাজে বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে। 

৯. লিঙ্গগত অসাম্য :- 
নারী ও পুরুষের মধ্যে লিঙ্গগত বৈষম্য সামাজিক বিবর্তনের প্রতি স্তরে লক্ষ্য করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তীকাল পর্যন্ত পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই সামাজিক , অর্থনৈতিক - ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীদের অধিকারকে সংকুচিত করে রাখা হয়েছিল। তার পর থেকে , বিশেষ করে ৭০-এর দশকে ব্যপক নারী আন্দোলনের ফলে নারীদের কিছু কিছু অধিকার প্রতিষ্টিত হলেও আজও নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। যেমন কর্মক্ষেত্রে নারীদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলেও - যৌন নির্যাতন , গৃহবধূদের সুরক্ষায় বিভিন্ন আইন প্রবর্তিত হলেও আজও প্রতিদিন বধূ নির্যাতনের খবর পাওয়া যায়। 

পরিশেষে বলা যায় , সমাজে সাম্য ও অসাম্য একই সাথে অবস্থান করে। সমাজে বিভিন্ন অসাম্য থেকেই সাম্যের পথ চলা শুরু হয়। এটি একটি প্রক্রিয়া যা সমাজ বিবর্তনের পথে অনিবার্যভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এইভাবে সমাজে এক একটি ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর হয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।     


  

You May Also Like

0 comments