যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের / শাসন ব্যবস্থার সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট :-

by - February 19, 2022

যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা কাকে বলে ? যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর। 

যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার কাকে বলে ? যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর। 

What is the federal system ? Discuss the features of the federal system . ( In Bengali ) 




যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার ধারণা ও সংজ্ঞা :- 


যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার ধারণা প্রসঙ্গে K.C. Wheare বলেছেন , যুক্তরাষ্ট্র হল কেন্দ্রীয় সরকার ও অঙ্গরাজ্যের সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বন্টনের পদ্ধতিকে বোঝায়। ক্ষমতা বন্টনের পদ্ধতি অনুযায়ী প্রতিটি সরকার নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীন এবং স্বাতন্ত্র্যসম্পন্ন। 

A.V. Dicey বলেছেন , যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হল এমন এক ধরণের রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে জাতীয় ঐক্য ও ক্ষমতার সঙ্গে অঙ্গরাজ্যগুলির ক্ষমতা ও অধিকারের সমন্বয়সাধন করা হয়। 

Finer বলেছেন , যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বন্টন করা হয় কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক সরকারগুলির মধ্যে। 

তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ প্রদত্ত সংজ্ঞাগুলির মধ্যে Birch কর্তৃক প্রদত্ত সজ্ঞাটিকে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সর্বোৎকৃষ্ট সংজ্ঞা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেছেন , যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা হল এমন এক ধরণের শাসন ব্যবস্থা যেখানে একটি সাধারণ সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকার এবং কতকগুলি আঞ্চলিক সরকারের মধ্যে এমনভাবে ক্ষমতা বন্টিত হয় যে তারা পরস্পরের পরিপূরক রূপে কাজ করে এবং তাদের প্রত্যেকেই নিজেদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণকে শাসন করে। 


যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট :- 

যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈশিষ্ট :- 


১. কেন্দ্রীয় সরকার ও অঙ্গরাজ্যের সরকারের উপস্থিতি :-  যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে এখানে যৌথ সরকারের অস্তিত্বকে উল্লেখ করা যেতে পারে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় দুই ধরনের সরকারের উপস্থিতি থাকে তাই এই ধরনের সরকারকে '' দ্বৈত সরকারি ব্যবস্থা '' বলে। একদিকে কেন্দ্রে একটি সাধারণ বা কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং অন্যদিকে প্রত্যেকটি অঙ্গরাজ্যের জন্য ভিন্ন ভিন্ন রাজ্য সরকার গঠিত থাকে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ জাতীয় সংহতি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় স্বার্থ পূরণের লক্ষ্যে ভূমিকা পালন করা এবং অন্যদিকে অঙ্গরাজ্যের সরকারগুলি আঞ্চলিক স্বার্থ , দাবি ইত্যাদির প্রতি যত্নশীল থাকে। 

২. কেন্দ্র প্রবণতা :- যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় যৌথ সরকারি ব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকলেও কেন্দ্রীয় প্রবণতা এর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। যেহেতু প্রত্যেকটি অঙ্গরাজ্যে সংস্কৃতি , রাজনীতি , ভাষা ইত্যাদি বিভিন্ন বৈচিত্র থাকে সেজন্য জাতীয় স্বার্থ পূরণ ও প্রতিরক্ষার দাবি - ইত্যাদির জন্য সকলকেই কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। এইভাবে জাতীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থের সংরক্ষণ , প্রতিরক্ষা , আন্তর্জাতিক সম্পর্ক - ইত্যাদির জন্য যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় একটি কেন্দ্রাতিগ প্রবণতা সৃষ্টি হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্র সরকার , রাজ্য সরকার - উভয়ই স্বাধীন থাকলেও বিভিন্ন বিষয়ে রাজ্য সরকারের কেন্দ্রীয় প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। 


৩. সংবিধানের প্রাধান্য :-  যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় সংবিধানের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। সংবিধানের প্রাধান্য বলতে বোঝায় সেই দেশে সংবিধান হল সর্বোচ্চ আইন এবং সকল ক্ষমতার উৎস। সংবিধানের মাধ্যমে সকল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে বা বন্টিত হয়। সংবিধান লংঘন করা কেন্দ্র সরকার , আঞ্চলিক সরকার বা অন্য কোনও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব নয়। সকলকে সংবিধানের অধীনে থেকে কাজ করতে হয়। এছাড়াও সরকারগুলি নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করলে তার প্রতিরোধের ব্যবস্থাও সংবিধানে উল্লিখিত থাকে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় সংবিধান হল ক্ষমতার প্রধান উৎস এবং সংবিধানের প্রাধান্য প্রশ্নাতীত। 

৪. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ :- যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে। এখানে ক্ষমতা এককেন্দ্রিক সরকারের মতো একটি সরকারের হাতেই সীমাবদ্ধ না থেকে ভিন্ন ভিন্ন রাজ্য সরকার ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা গুলির হাতে বন্টিত হয়। ফলে এই ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে প্রশাসনিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ থাকে এবং জনসাধারণের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণের অধিক সুযোগ থাকে। 

৫. আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ :- যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার মধ্যে আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষিত হয়। একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার সাধারণত বৃহৎ জনসংখ্যাভুক্ত দেশগুলিতে প্রতিষ্ঠিত থাকে। বৃহৎ জনসংখ্যা এবং বৃহৎ আয়তনভুক্ত দেশগুলিতে সাধারণত ভাষা , সংস্কৃতি , অর্থনীতি , রাজনীতি - ইত্যাদি বিভিন্ন দিক দিয়ে বৈচিত্রপূর্ণ হয় এবং তাদের এই বৈচিত্র্যময় দাবি-দাওয়া ও স্বার্থ পূরণের লক্ষ্যে আঞ্চলিক সরকারগুলি যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। অন্যদিকে জাতীয় ঐক্য ও সুরক্ষার বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকার যথাযোগ্যভাবে পরিচালিত করতে পারে। সুতরাং আঞ্চলিক ও জাতীয় দুই ক্ষেত্রেই স্বার্থ এবং স্বতন্ত্রতা রক্ষা হয় ও জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। 

৬. লিখিত সংবিধানের উপস্থিতি :- যে সকল রাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রচলিত থাকে সেই সকল রাষ্ট্রগুলিতে সংবিধান সাধারণত লিখিত হয়। কেননা যেহেতু এই ধরনের শাসন ব্যবস্থায় বিভিন্ন সরকারের উপস্থিতি থাকে যথা কেন্দ্র সরকার , রাজ্য সরকার , স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা সমূহ - ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন সরকারি কর্তৃপক্ষের উপস্থিতির ফলে লিখিত সংবিধান আবশ্যক হয়ে পড়ে। ক্ষমতার নির্দিষ্ট বন্টনের মাধ্যমে যথাযথ ভূমিকা পালনের নির্দেশ ইত্যাদি লিখিত সংবিধানের মাধ্যমে প্রযুক্ত হওয়া সম্ভব। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সাধারণত লিখিত থাকে এবং সংবিধানের মাধ্যমে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গুলির মাধ্যমে মধ্যে ক্ষমতা বন্টিত হয়। 


৭. দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান :- যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান সাধারণত দুষ্পরিবর্তনীয় হয়। যেহেতু এখানে কেন্দ্রীয় সরকারের একক ক্ষমতা স্বীকৃত নয় - এখানে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার যৌথভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করে।  তাই যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয় হয়। যাতে কোনো একটি সরকার তাদের নিজেদের ইচ্ছা ও খেয়ালখুশি মত সংবিধান পরিবর্তন করতে না পারে। উভয় ধরনের সরকারের সম্মতিতে সংবিধান পরিবর্তন করতে হয়। 

৮. দ্বৈত নাগরিকত্ব :- যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় দ্বৈত নাগরিকত্ব পরিলক্ষিত হয়। দ্বৈত নাগরিকত্ব হল -   একদিকে ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এবং অন্যদিকে সেই ব্যক্তি অঙ্গরাজ্যের নাগরিক। প্রায় প্রতিটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় দ্বৈত নাগরিকত্ব স্বীকৃত। অর্থাৎ ব্যক্তি একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এবং অন্যদিকে তিনি যে অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা সেই অঙ্গরাজ্যের নাগরিক। তবে এক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা স্বীকৃত থাকলেও এখানে দ্বৈত নাগরিকত্ব স্বীকৃত নেই। 

৯. দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা :- যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় আইনসভা সাধারণত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হয়। এই দুটি কক্ষ হল নিম্নকক্ষ এবং উচ্চকক্ষ। নিম্নকক্ষে জনগণ কর্তৃক সরাসরি নির্বাচিত প্রতিনিধিরা স্থান লাভ করেন এবং উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্বমূলক সদস্যরা সুযোগ লাভ করেন। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই দুই কক্ষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে এবং ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ক আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে রাজ্য আইনসভা এবং কেন্দ্রীয় আইনসভা উভয়ের ভূমিকাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। 

১০. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত :- যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের অস্তিত্ব চোখে পড়ে। বলা যেতে পারে যে , যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত ব্যবস্থা ব্যতীত যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করা সম্ভব নয়। কেননা , এখানে যেহেতু বিভিন্ন ধরণের সরকারের অস্তিত্ব থাকে সেহেতু বিভিন্ন সরকারের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে বিরোধিতার সূত্রপাত হওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এক বা একাধিক রাজ্য সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার সরকারের , একটি রাজ্য সরকারের সঙ্গে অপর একটি রাজ্য সরকারের , একটি রাজ্য সরকারের সঙ্গে একাধিক রাজ্য সরকার সরকারের বিরোধ প্রতিষ্ঠিত হলে তা সুচিন্তিতভাবে সমাধানের জন্য একটি নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষ হিসাবে বিচার বিভাগ তার ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়াও আইন বিভাগ কর্তৃক জারি করা বিভিন্ন আইন আদেশ-নির্দেশ ইত্যাদির বৈধতা বিচার করতে পারে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত। এছাড়া সংবিধানের ব্যাখ্যা কর্তা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। 

১১. স্বতন্ত্র্য রাজস্ব ব্যবস্থা :-  যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় রাজস্ব ব্যবস্থা সাধারণত স্বতন্ত্র অবস্থায় থাকে।  এখানে উভয় সরকার যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন হয়। কেননা কেন্দ্র বা রাজ্য প্রত্যেকটি সরকার যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন না হলে তার পক্ষে সরকার পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সেজন্যই প্রত্যেকটি সরকার স্বতন্ত্র রাজস্ব ব্যবস্থার অধিকারী। 

১২. স্বতন্ত্র্য সংবিধান :- প্রচলিত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় স্বতন্ত্র সংবিধানের অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করা যায়।  যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গরাজ্যগুলিতে ভিন্ন-ভিন্ন ও স্বতন্ত্র সংবিধান প্রচলিত আছে। অবশ্য অঙ্গরাজ্যের প্রত্যেকটি সংবিধানকে জাতীয় সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হয়। তবে এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা স্বীকৃত হলেও অঙ্গরাজ্যগুলির জন্য আলাদা আলাদা সংবিধানের কোনো স্বীকৃতি নেই বা অস্তিত্ব নেই। ভারতে একটি মাত্র সংবিধান এবং সারাদেশে একই সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হয় এবং সকল ক্ষমতার উৎস সংবিধান। 


You May Also Like

0 comments