সংসদীয় শাসনব্যবস্থা কাকে বলে ? সংসদীয় শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট।

by - January 16, 2022

সংসদীয় শাসনব্যবস্থা কাকে বলে ? সংসদীয় শাসনব্যবস্থার / মন্ত্রিপরিষদ চালিত শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্টগুলি লেখ। 

Features of parliamentary system ( In Bengali ) 




সংসদীয় শাসনব্যবস্থা :- 


সরকারের মূল তিনটি বিভাগ - আইন , শাসন ও বিচার। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক থাকে। শাসন বিভাগের সদস্যরা আইন বিভাগ থেকেই নির্বাচিত হন এবং তারা আইন বিভাগের নিকট দায়িত্বশীল থাকেন। শাসন বিভাগের স্থায়িত্বও আইন বিভাগের ওপর নির্ভরশীল। 

এই ধরণের শাসন ব্যবস্থায় কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে সংবিধান দ্বারা ক্ষমতার বন্টন করা হয়। কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের সকল ক্ষমতা একজন নিয়মতান্ত্রিক প্রধানের হাতে অর্পিত থাকলেও সরকারের প্রকৃত ক্ষমতা প্রয়োগ করেন প্রধানমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিপরিষদ। তাই সংসদীয় শাসনব্যবস্থাকে মন্ত্রিপরিষদ পরিচালিত শাসন ব্যবস্থাও বলা হয়। 

সংসদীয় বা , মন্ত্রিপরিষদ চালিত বা , ক্যাবিনেট শাসন ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায় ভারত , গ্রেট ব্রিটেন , জাপান , সুইডেন , নিউজিল্যান্ড , অস্ট্রেলিয়া - ইত্যাদি রাষ্ট্রে।    


সংসদীয় শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট :- 


সংসদীয় শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্টগুলি হল - 

১. নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান :- যে সকল রাষ্ট্রে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রচলিত থাকে সেই সকল রাষ্ট্রে নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে তত্ত্বগতভাবে সমস্ত ক্ষমতা অর্পিত থাকে। কেন্দ্রীয় সরকারের সকল কাজ ও নীতি তাঁর নামেই পরিচালিত হয়। বাস্তবে প্রকৃত ক্ষমতা উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিপরিষদ। সরকার রাষ্ট্রপ্রধানের নামে পরিচালিত হলেও তাঁর হাতে সরকার পরিচালনার কোনো ক্ষমতা থাকে না এবং তিনি নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানের ভূমিকা পালন করেন। 

২. সরকারের প্রকৃত প্রধান : প্রধানমন্ত্রী :- সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সরকার পরিচালনার সমস্ত ক্ষমতার প্রয়োগকারী হলেন প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রিসভা গঠন , দপ্তর বন্টন , নীতি নির্ধারণ ও প্রয়োগ , বৈদেশিক সম্পর্ক পরিচালনা , আর্থিক নীতি পরিচালনা - ইত্যাদি সমস্ত ধরণের কার্যাবলী প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়। সুতরাং , সংসদীয় শাসনব্যবস্থার প্রকৃত প্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী। 


৩. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সম্পূর্ণ প্রয়োগ সম্ভব নয় :- ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসারে সরকারের তিনটি বিভাগ - আইন , শাসন ও বিচার কার্যক্ষেত্রে পরস্পরের থেকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকবে। কিন্তু সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সম্পূর্ণ প্রয়োগ সম্ভব নয়। এই ব্যবস্থায় প্রতিটি বিভাগ একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যেমন শাসন বিভাগের সদস্যরা নির্বাচিত হন আইন বিভাগ থেকে। 

৪. আইন ও শাসন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক :- সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় আইন বিভাগের মধ্যে থেকেই শাসন বিভাগ গঠিত হয় এবং শাসনবিভাগ আইনসভার কাছে যৌথভাবে দায়িত্বশীল থাকে। একদিকে শাসন বিভাগের স্থায়িত্ব আইন সভার উপর নির্ভরশীল আবার অন্যদিকে শাসন বিভাগ আইন সভার কার্যাবলীকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করে।    

৫. নিম্নকক্ষের ভূমিকা : - সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ গঠনে নিম্নকক্ষের প্রধান ভূমিকা থাকে। নিম্নকক্ষ একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গঠিত হলেও তার কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নিম্নকক্ষ ভেঙে দেওয়া যায়। যেমন ভারতে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি নিম্নকক্ষ ভেঙে দিতে পারেন। 

৬. মন্ত্রিসভার দ্বৈত দায়িত্ব :- সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় মন্ত্রীগণ দ্বৈত ভূমিকা পালন করে থাকেন। একদিকে তাকে মন্ত্রী হিসেবে নিজের দপ্তর পরিচালনা করতে হয় এবং অন্যদিকে আইন সভার সদস্যরূপেও দায়িত্ব পালন করতে হয়। 


৭. আইনসভার নির্বাচন :- সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় আইনসভা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্বাচিত হয়। যেমন ভারতে লোকসভার কার্যকালের মেয়াদ পাঁচ বছর , গ্রেট ব্রিটেনের কমন্স সভা পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়। 

৮. মন্ত্রিসভার আস্থাশীলতা :- সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় মন্ত্রীপরিষদকে আইনসভার নিকট আস্থাশীল থাকতে হয়। কোনো কারণে একটি দলের কোনো মন্ত্রী নির্দিষ্ট আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হলে তাকে পদত্যাগ করতে হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী আস্থা প্রমাণ না করতে পারলে সম্পূর্ণ মন্ত্রিসভার নীতিগতভাবে পতন ঘটে। 

৯. বিরোধী দলের কার্যকারিতা :- সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় একটি শক্তিশালী ও কার্যকরী বিরোধী দলের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। সরকারের জনবিরোধী নীতির তীব্র সমালোচনা , উপযুক্ত পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকারের জনবিরোধী নীতির বাস্তবায়ন রোধ করা , জনগণের দাবী সরকারের নিকট তুলে ধরা , ঘোষিত কর্মসূচীগুলি সম্পূর্ণ করতে সরকারকে বাধ্য করা - এসকল ভূমিকা বিরোধী দলকে গ্রহণ করতে হয়। 

১০. গণতন্ত্রের সাথে সম্পর্ক :- সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় গণতন্ত্র সুরক্ষিত থাকে বলে মনে করা হয়। যেহেতু এই ধরণের ব্যবস্থায় ক্ষমতা একজনের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকেনা , সেহেতু শাসকের স্বৈরাচারী হওয়ার আশঙ্কা খুব কম থাকে। প্রধানমন্ত্রী কার্যক্ষেত্রে সর্বেসর্বা হলেও তাকেও আইনসভা পদচ্যুত করতে পারে। 

১১. ধনতন্ত্রের সাথে কার্যকারণ সম্পর্ক :- সংসদীয় শাসনব্যবস্থা ধনতন্ত্রের সাথে কার্যকারণ সম্পর্ক স্থাপন করে বলে রজনীপাম দত্ত সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে , সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্রের মূলনীতিগুলিকে তুলে ধরা হলেও কার্যক্ষেত্রে এমন একটি ব্যবস্থার সৃষ্টি হয় , যার ফলে ধনতন্ত্রের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা হয়। 

১২. বহুদলীয় ব্যবস্থা :- সাধারণত সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় একাধিক দলের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যেমন ভারতে জাতীয় ও আঞ্চলিক স্তরে প্রচুর পরিমাণে দলের অস্তিত্ত্ব লক্ষণীয়। বহুদলীয় ব্যবস্থার অস্তিত্বের কারণে সরকার গঠনের সময় অনেক ক্ষেত্রে জোট গঠনের প্রবণতা দেখা যায়। ভারতীয় সংসদীয় রাজনীতিতে এধরণের বহু ঘটনার উদাহরণ রয়েছে। 

পরিশেষে বলা যায় , দেশ ও কালের পরিপ্রেক্ষিতে বৈশিষ্টগুলি পরিবর্তনশীল। যেমন ভারত ও ব্রিটেনে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত থাকলেও উভয় দেশের শাসন ব্যবস্থা হুবহু এক ধরণের নয়। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে মন্ত্রিসভা এবং ক্যাবিনেটের ক্ষমতা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে এবং শাসন ও আইন বিভাগ ধীরে ধীরে ক্যাবিনেটের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে আসছে।     


You May Also Like

0 comments