বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা

by - January 16, 2022

বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা আলোচনা করো। 

বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা :- 



বাংলা গদ্য সাহিত্যের আকাশে এক অসাধারণ পুরুষ , আধুনিকতার অগ্রদূত , ভারতীয় জীবনচেতনার উন্মেষস্বরূপ হলেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি সম্পূর্ণ সংস্কারবিহীন হয়ে হিন্দু , মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে স্বকীয় চিন্তায় ও মননে , লেখনীর দ্বারা যুক্তি গ্রাহ্য বিশ্লেষণে ভারতের সংস্কার আন্দোলনে ও গদ্য সাহিত্যের বিকাশে এক নতুন যুগের সূচনা করেন। 


রাজা রামমোহন রায় বাংলা গদ্যের বিকাশে লেখনী ধারণ করেননি। বাংলা গদ্যে তাঁর অংশগ্রহণের মূল কারণ ছিল সমাজ সংস্কার ও সমাজ সচেতনতা। তাঁর প্রধান পরিচয় - তিনি একজন সমাজ সংস্কারক , নবজাগরণের অগ্রদূত।সতীদাহ প্রথা নিবারণকল্পে তাঁর প্রধান অস্ত্র ছিল বাংলা গদ্য ভাষা। বহুবছর ধরে লালিত শাস্ত্রাদির বাংলা গদ্যে রূপান্তর ও সমালোচনা দ্বারা সনাতন ব্রাহ্মণ্য - দম্ভের মূলে কুঠারাঘাতের মধ্যে দিয়ে তাঁর সমাজ সংস্কারের প্রথম নান্দীপাঠ। তারপর শুরু হয় বিধবা বিবাহ আন্দোলন। এক্ষেত্রেও তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজের বিরুদ্ধে লেখনীকেই তিনি প্রধান অস্ত্ররূপে ব্যবহার করেছিলেন। ''সম্বাদ কৌমুদী '' নামে তাঁর প্রকাশিত একটি পত্রিকাতে নিজ মত সমর্থনে তিনি নানা যুক্তি ও তর্কের উপস্থাপনা করেন। এই তর্ক-বিতর্ক এবং স্বাধীন যুক্তি - যুক্ত মতামত প্রকাশ ও উত্তর - প্রত্যুত্তরের মাধ্যমে সদ্যোজাত বাংলা গদ্য যেন শৈশব থেকে যৌবনে উত্তীর্ণ হলো।   


রামমোহনের সাহিত্য সৃষ্টি :-


 রামমোহনের সাহিত্য কীর্তির প্রধান উদাহরণ হলো সম্বাদ কৌমুদী। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি রক্ষণশীল সমাজের মূলে কুঠারাঘাত করেছিলেন। এছাড়াও ছিল - বেদান্ত গ্রন্থ (১৮১৫) ; বেদান্তসার (১৮১৫) ; বিভিন্ন উপনিষদের অনুবাদ - ইত্যাদি।

সমাজ সংস্কার সম্পর্কিত বিতর্কমূলক রচনাগুলি রামমোহনের সাহিত্যকীর্তিগুলির মধ্যে অন্যতম। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল -

উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশের সহিত বিচার ; 
ভট্টাচার্যের সহিত বিচার ;
গোস্বামীর সহিত বিচার ;
সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক - নিবর্তক সম্বাদ ;
কবিতাকারের সহিত বিচার ;
ব্রাহ্মণ সেবধি ;
পথ্য প্রদান ; 
সহমরণ বিষয়ক - ইত্যাদি। 
এছাড়াও তিনি কতকগুলি ব্রহ্মসংগীত রচনা করেছিলেন এবং '' গৌড়ীয় ব্যাকরণ '' নামে একখানি ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন - যা তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছিল। 



রামমোহনের গদ্য সাহিত্য পর্যালোচনা :-


রামমোহনের রচনা শৈলী ও বৈশিষ্ট সম্পর্কে কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন - '' দেওয়ানজী (রামমোহন ) জলের ন্যায় সহজ ভাষায় লিখিতেন , তাহাতে কোনো বিচার ও বিবাদঘটিত বিষয় লেখায় মনের অভিপ্রায় ও ভাবসকল অতিসহজ স্পষ্টরূপে প্রকাশ পাইত , এজন্য পাঠকেরা অনায়াসেই হৃদয়ঙ্গম করিতেন , কিন্তু সে লেখায় শব্দের বিশেষ পারিপাট্য ও তাদৃশ মিষ্টতা ছিল না। 

রামমোহনের গদ্য ভাষায় ঋজুতা থাকলেও মিষ্টতা ছিল না - একথা সত্য। তার কারণ তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজ সংস্কার ও সমাজ সচেতনতা। এজন্য তিনি সাহিত্য ক্ষেত্রে শব্দের পারিপাট্যের প্রতি মনোযোগী হতে পারেননি। তবে বাংলা গদ্যের বিকাশে রামমোহনের প্রধান অবদান ছিল তিনি বাংলা গদ্যকে প্রাঞ্জল , স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল করে তুলেছিলেন।  

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পন্ডিত - মুনশিরা বাংলা গদ্যকে কাহিনী ও গল্প প্রকাশের বাহন করে তুলেছিলেন। কিন্তু রামমোহন তাকে যুক্তিতর্কের নিরিখে বিশ্লেষণ করে এবং গভীর আত্মসংযমের মধ্যে দিয়ে বিষয়কে উপস্থাপিত করেছিলেন। 

তাঁর সাহিত্য কীর্তি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন - '' কী রাজনীতি , কী বিদ্যাশিক্ষা, কী সমাজ , কী ভাষা - আধুনিক বঙ্গদেশে এমন কিছুই নাই রামমোহন রায় স্বহস্তে যাহার সূত্রপাত করিয়া যান নাই। ''

এছাড়াও রামমোহন ইংরেজির অনুকরণে বাক্যে ছেদচিহ্নের ব্যবহার করেছিলেন। আচার্য সুকুমার সেন বলেছিলেন - '' তিনিই আমাদের প্রথম লিঙ্গুয়িস্ট। ''

শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায় বলেছেন - ''.......... স্বাধীন চিন্তার প্রকাশে তাঁহার জুড়ি নাই। ............... তাঁহার গদ্য লালিত মধুর না হইলেও মননদীপ্ত ও ভাবের সমুন্নতিতে মর্যাদাময়। ''   

  

You May Also Like

0 comments