ভার্সাই সন্ধি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য কতটা দায়ী ছিল ?

by - January 10, 2022

ভার্সাই সন্ধি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য কতটা দায়ী ছিল ? 

How far was the treaty of Versailles responsible for the Second World War ? ( In Bengali ) 



দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ভার্সাই সন্ধির দায়িত্ব :- 

আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলির মধ্যে ভার্সাই চুক্তি ছিল একটি অন্যতম বিতর্কিত চুক্তি। এর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হল যে , ভার্সাই চুক্তি পরোক্ষভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী। ঐতিহাসিকেরা একে জবরদস্তিমূলক সন্ধি বা A dictated peace বলে অভিহিত করেছেন। এই চুক্তির মধ্যে দিয়ে জার্মান জাতির প্রতি যে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছিল তা পরোক্ষভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দেয়। ঐতিহাসিক রাইকার মন্তব্য করেছেন - No great nation like Germany can submit indifferently to discrimination in the matter of armament and other things. প্রকৃতপক্ষে ভার্সাই সন্ধির মূল উদ্দেশ্য ছিল জার্মানিকে রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক সব দিক দিয়ে দুর্বল করে দিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তাকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া। এই সন্ধির মধ্যে দিয়ে জার্মান জাতির প্রতি যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ উদ্রেক করা হয়েছিল তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে হিটলারের উত্থানের পরবর্তীকালের ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে।


১. ভার্সাই সন্ধির প্রণেতাদের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাব :- ভার্সাই সন্ধি স্থাপনের বহু পূর্ব হতেই ইউরোপীয় নেতৃত্ব জার্মানির উপর ঘৃণা ও বিদ্বেষের মনোভাব পোষণ করতেন। ফলে সন্ধিকালে পরাজিত জার্মানিকে কোনোরূপ সৌজন্য প্রদর্শন তাঁরা করেননি। সন্ধি রূপায়ণের কোনো অংশেই জার্মানির কোনো ভূমিকা ছিল না। এই রাজনৈতিক অদূরদৃষ্টি ভার্সাই সন্ধিকে একটি পক্ষপাতমূলক সন্ধিতে পরিণত করে। 

২. জার্মানির প্রতি অসম্মানজনক ব্যবহার :- ভার্সাই সন্ধি মূলতঃ দুটি নীতির ওপর ভিত্তি করে রচিত হয় - (ক ) যুদ্ধের জন্য জার্মানিকে এককভাবে দায়ী করে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং (খ ) ভবিষ্যতে জার্মানি যাতে কোনোরূপ আক্রমণাত্মক ভূমিকা না গ্রহণ করতে পারে - তা নিশ্চিত করা। এই দুই নীতির পরিপ্রেক্ষিতে সন্ধির সকল শর্ত জার্মানিকে পঙ্গু করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে রচিত হয়। এই প্রতিশোধাত্মক মনোভাব ও অপমানজনক ব্যবহার জার্মান জাতির মনে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করে। হিটলারের উত্থানের মধ্যে দিয়ে সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল মাত্র। 


৩. জার্মানির উপর অনৈতিক ও অযৌক্তিক ক্ষতিপূরণের বোঝা :- ভার্সাই সন্ধিতে জার্মানির উপর যে সকল শর্তগুলি আরোপ করা হয়েছিল তা ছিল অনৈতিক ও অযৌক্তিক। যুদ্ধে জার্মানি তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলেও তার উপর যে বিরাট অংকের ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপানো হয় - তা কোনোভাবেই জার্মানির পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব ছিল না। সন্ধির প্রণেতাগণ সন্ধি রূপায়নকালে সকল প্রকার আন্তর্জাতিক নীতি ও নৈতিকতা বর্জন করেছিলেন। 

৪. অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক শর্তগুলির প্রভাব :- জার্মানির কাছ থেকে তার সকল সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলি কেড়ে নেওয়া হয়। বিভিন্ন খণিজগুলির উপরেও জার্মানির কোনো অধিকার অস্বীকার করা হয়। জার্মানির প্রধান শিল্পসমৃদ্ধ সার অঞ্চল কেড়ে নেওয়া হয়। জার্মানির অধিকাংশ অঞ্চল ও উপনিবেশ কেড়ে নিয়ে তা মিত্রপক্ষের শাসনাধীনে আনা হয়। এই কঠোর ও জবরদস্তিমূলক শর্তগুলির ফলে জার্মান জাতির পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও ইউরোপীয় শক্তিবর্গের প্রতি প্রতিশোধের মনোভাব তৈরী হওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল। 

৫. ইউরোপের পুনর্গঠনের নীতিতে জার্মানির প্রতি বৈষম্য :- ভার্সাই সন্ধিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের পুনর্গঠন করা হলেও এক্ষেত্রে জার্মানির প্রতি তীব্র বৈষম্য করা হয়। জার্মানির বহু অংশকে পোল্যান্ড ও চেকোশ্লোভাকিয়ার সাথে সংযুক্ত করা হয়। এই জবরদস্তিমূলক সংযুক্তি পরবর্তী কালে বহু আন্তর্জাতিক সমস্যার জন্ম দেয়। 

৬. উইলসন কর্তৃক প্রণীত জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বৈষম্য :- ভার্সাই সন্ধিতে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা বলেছিলেন। কিন্তু এই আদর্শ জার্মানির উপর প্রযুক্ত হয়নি। জার্মান জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত ছিল। সন্ধির জার্মানির সার্বভৌমত্ব তীব্রভাবে ক্ষুন্ন করা হয়। ফলে পরবর্তীকালে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে জার্মান জাতি পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবী জানাবে - তা অস্বাভাবিক ছিল না। 


৭. সামরিক শর্তগুলির প্রভাব :- ভার্সাই সন্ধি অনুসারে ইউরোপের সকল রাষ্ট্র যুদ্ধাস্ত্র হ্রাস করার নীতি গ্রহণ করে। কিন্তু বিজয়ী শক্তিবর্গ কোনো অবস্থাতেই নিজেদের শক্তি হ্রাস করেনি। কিন্তু এই নীতি জার্মানির উপর কঠোরভাবে প্রযুক্ত হয়েছিল। জার্মানির সেনাদল ও নৌ শক্তি ভেঙে দেওয়া হয় , জার্মানিতে মিত্রপক্ষের সেনা মোতায়েন করা হয়। এই বৈষম্যমূলক নীতি অধিককাল স্থায়ী হওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে হিটলারের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ১৯৩৬ সালে জার্মানি ভার্সাই চুক্তিকে অমান্য করে। 

৮. জার্মান জাতিকে দমন করে রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা :- জার্মানির উপর যে বিরাট অংকের ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপানো হয়েছিল তা একদিকে যেমন জার্মানির পক্ষে প্রদান করা সম্ভব ছিল না ; তেমনি বিজয়ী শক্তিবর্গের পক্ষে তা আদায় করাও সম্ভব ছিল না। জার্মানির রাইন অঞ্চলসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মিত্রপক্ষের সেনা মোতায়েন করলেও তা জার্মানির পুনরুত্থাপনের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো বাধা তৈরী করতে পারেনি। 

৯. পোল্যান্ড ও বেলজিয়াম নীতি দ্বারা জার্মানির জাতিগত মর্যাদায় আঘাত :- সন্ধির শর্তগুলির দ্বারা পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র বেলজিয়ামকে জার্মানির থেকে অধিক শক্তিশালী করা হয়েছিল। জার্মানির বিভিন্ন সমৃদ্ধ অঞ্চল পোল্যান্ডের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছিল। উপরন্তু জার্মানির ভিতর দিয়ে '' পোলিশ করিডর '' নির্মাণ করে সন্ধির প্রণেতাগণ জার্মান জাতির মর্যাদায় আঘাত হেনেছিলেন। নিজেদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের তত্ত্বে বিশ্বাসী জার্মানরা তাই দ্রুত নিজেদের উত্থান ঘটাতে চেষ্টা করেছিল। এরই ফল ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। 

১০. ব্রিটেন ও ফ্রান্সের তোষণ নীতি :- সন্ধির পরবর্তীকালে এক দশকের মধ্যে হিটলারের উত্থান ঘটলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স রাজনৈতিক স্বার্থে জার্মান তোষণ শুরু করে। এর ফলে জার্মানি ১৯৩২ সালে ক্ষতিপূরণ প্রদান বন্ধ করে দিলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। এরপর ১৯৩৬ সালে রাইন অঞ্চল থেকে সন্ধির সকল শর্ত বাতিল করে। ১৯৩৮ সালে হিটলার অস্ট্রিয়া দখল করে। এইভাবে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের তোষণ নীতি জার্মানিকে অপ্রতিরোধ্য ভূমিকা গ্রহণ করতে উৎসাহিত করে। 

পরিশেষে বলা যায় , সন্ধির শর্তগুলির দ্বারা সাময়িকভাবে জার্মানিকে দুর্বল করে রাখলেও স্থায়ীভাবে তাকে পদানত করে রাখা সম্ভব ছিল না। কেননা একদিকে ছিল জার্মান জাতির জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস ও অন্যদিকে ছিল হিটলারের উত্থান। এই দুয়ের প্রভাবে পরবর্তী এক দশকের মধ্যেই জার্মানি কর্তৃক প্রতিশোধের সুপ্ত সম্ভাবনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এরই চরম বহিঃপ্রকাশ হল হিটলার কর্তৃক পোল্যান্ড আক্রমণ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা। 


You May Also Like

0 comments