ভার্সাই সন্ধির বিভিন্ন শর্তগুলো আলোচনা কর।

by - January 09, 2022

ভার্সাই সন্ধির বিভিন্ন শর্তগুলো আলোচনা কর। 

Discuss the various terms of the Treaty of Versailles. ( In Bengali ) 



ভার্সাই সন্ধির বিভিন্ন শর্ত

২৮ শে জুন ১৯১৯ তারিখে বিজয়ী মিত্রবর্গ ও পরাজিত জার্মানির মধ্যে ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আন্তর্জাতিক ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত একটি চুক্তি ছিল ভার্সাই চুক্তি। ভার্সাই চুক্তিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ হিসেবে সমালোচিত হয়। ভার্সাই চুক্তি সম্পর্কে বিতর্কের কারণগুলি তার শর্তাদির মধ্যে নিহিত ছিল। যদিও তৎকালীন অশান্ত ইউরোপে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ও ইউরোপের পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে ভার্সাই চুক্তি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভার্সাই চুক্তির বিভিন্ন শর্তগুলি ছিল - 


১. ইউরোপের পুনর্গঠন সংক্রান্ত শর্ত :- 
(i) আলসাস ও লোরেন ফ্রান্সকে প্রত্যার্পণ করা হয়। 
(ii) মনসেরেট , ম্যালমেডি ও ইউপেন - বেলজিয়ামকে সমর্পন করা হয়। 
(iii) স্লেজউইগ অঞ্চল ডেনমার্ককে দেওয়া হয়। 
(iv) ডানজিগ ও মেসেল বন্দর জার্মানির হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয় ও সকলের ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া হয়।  
(v) জার্মানির খনি সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলির ওপর ১৫ বছরের জন্য ফ্রান্সের অধিকার স্থাপিত হয়।
(vi) এশিয়া ও আফ্রিকায় অবস্থিত জার্মানির উপনিবেশগুলি বিজয়ী শক্তিবর্গ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। 
(vii) জার্মানির রাইন , দানিয়ুব ইত্যাদি নদীগুলির ওপর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। 
(viii) জার্মানির ভিতর দিয়ে '' পোলিশ করিডর '' নির্মিত হয়। 
(ix) পশ্চিম জার্মানিতে ফ্রান্স সংলগ্ন অঞ্চলে ফ্রান্সের নিরাপত্তার স্বার্থে একটি নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরী করা হয়। 
(x) পোল্যান্ডকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। 
(xi) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জার্মানির সমস্ত রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। 
(xii) গণভোটের মাধ্যমে উত্তর স্লেজউইগ ডেনমার্কের সাথে ও দক্ষিণ স্লেজউইগ জার্মানির সঙ্গে যুক্ত করা হয়। 


২. অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন শর্ত :- 
(i) জার্মানিকে এককভাবে যুদ্ধের জন্য দায়ী করে তার উপর বিরাট অংকের ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপানো হয়। এই ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬৬০ কোটি পাউন্ড। 
(ii) জার্মানির কয়লাখনি সমৃদ্ধ অঞ্চলের ওপর ১৫ বছরের জন্য ফ্রান্সের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। 
(iii) '' ক্ষতিপূরণ কমিশন '' গঠনের মাধ্যমে জার্মানির উপর থেকে বিভিন্নভাবে অর্থ ও সম্পদ আদায় করা শুরু হয়। 
(iv) জার্মানির সমৃদ্ধ বন্দরগুলিতে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। 
(v) জার্মানি লোহা সহ অন্যান্য খণিজ পদার্থগুলি ১০ বছরের জন্য ফ্রান্স , ইতালি ও লুক্সেমবার্গকে সরবরাহ করতে বাধ্য থাকবে। 
(vi) মিত্রপক্ষের পণ্য জার্মানিতে বিক্রয়ের অগ্রাধিকার পায়। 
(vi) জার্মানির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জলপথগুলি আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রনাধীনে আনা হয়। 
(vii) জার্মানির বিভিন্ন বাণিজ্য জাহাজগুলি ফ্রান্সের হাতে অর্পণ করা হয়। 
(viii) অন্যান্য দেশে জার্মানির বাণিজ্য ক্ষেত্রে বিশেষ অধিকারগুলি বাতিল করা হয়। 

৩. সামরিক শর্তাবলী :- 
(i) ভার্সাই সন্ধির সামরিক শর্তগুলির মূল উদ্দেশ্য ছিল জার্মানিকে সামরিক দিক দিয়ে সর্বতোভাবে হীনবল করা। 
(ii) জার্মানির সেনাদল ভেঙে দেওয়া হয়। 
(iii) জার্মানি এক লক্ষ স্বেচ্ছাসেবক রাখার অনুমতি পায় এবং এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে ব্যবহার করা যাবে। 
(iv) জার্মানির সামরিক বিমান ব্যবহার নিষিদ্ধ হল। 
(v) জার্মানির নৌবহর গুলির সংখ্যা বহুলাংশে হ্রাস করা হয়। 
(vi) হ্যালিগোল্যান্ডের দুর্গগুলি ধ্বংস করে দেওয়া হয়। 
(vi) রাইন নদীর পূর্ব অংশ থেকে জার্মান সেনা অপসারণ করা হয়। 
(vii) কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম ও সকল জার্মান সেনাপতিদের বরখাস্ত করা হয়। 
(viii) সন্ধির শর্তগুলি বাধ্যতামূলকভাবে জার্মানিকে পালন করানোর জন্য জার্মান খরচেই জার্মানিতে মিত্রপক্ষের একটি সেনাদল মোতায়েন করা হয়। 

৪. আইনমূলক শর্তাবলী :- ভার্সাই সন্ধির ২১৩ নং ধারাতে যুদ্ধ অপরাধীদের শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। এই ধারা অনুসারে কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম ও অন্যান্য সেনাপতিদের প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধের জন্য দায়ী করা হয়। কিন্তু কাইজার হল্যান্ডে আশ্রয় গ্রহণ করলে তাঁর বিরুদ্ধে আর বিচার চালানো সম্ভব হয়নি। এছাড়া জাতিসংঘের বিভিন্ন আইন সংক্রান্ত শর্তগুলিও ভার্সাই সন্ধিতে অন্তর্ভুক্ত হয়। 

পরিশেষে বলা যায় , আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পন্ডিতগণ ভার্সাই সন্ধিকে জবরদস্তিমূলক সন্ধি বলে অভিহিত করেন। প্রকৃতপক্ষে পরাজিত জার্মানির পক্ষে সন্ধির সকল শর্তগুলি মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। সন্ধির শর্তগুলির নির্মাতাদের মধ্যে জার্মানির প্রতি প্রতিশোধাত্মক মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। জার্মানিকে পঙ্গু করে দেওয়ার এই প্রচেষ্টার মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণটি নিহিত ছিল।      


 

You May Also Like

0 comments