জাতি - ব্যবস্থার সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট :-

by - January 23, 2022

জাত - ব্যবস্থার সংজ্ঞা দাও। জাতি - ব্যবস্থার বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর।  

Definition and features of Caste System ( In Bengali ) . 

জাতি - ব্যবস্থার সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট :- 




জাতি ব্যবস্থার ধারণা ও সংজ্ঞা :- 


ভারতীয় হিন্দু সমাজের অতিপ্রাচীনকাল থেকে চলে আসা একটি প্রথা বা সামাজিক প্রতিষ্ঠান হল জাতি ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা জন্মসূত্রে নির্ধারিত এবং এর সকল প্রকার মর্যাদা আরোপিত। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক এম এন শ্রীনিবাস '' কর্মের ধারণা '' ও '' ধর্মের ধারণা '' - বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন। এই দুই ধারণার বশবর্তী হয়ে ভারতে জাতিভেদ প্রথার উৎপত্তি বলে শ্রীনিবাস মনে করেন। ভারতের জাতিভেদ বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করার জন্য পোর্তুগিজরা সর্বপ্রথম Caste শব্দটি ব্যবহার করেন। Caste শব্দটির উৎপত্তি স্প্যানীয় Casta শব্দ থেকে। এর অর্থ হল জাতি বা কুল। 


মজুমদার ও মদন :- জাত হল একটি বদ্ধ , অন্তর্বৈবাহিক ও বংশানুক্রমিক গোষ্ঠী। 

অধ্যাপক এন কে দত্ত : জাত বিন্যাস হল জন্মসূত্রে নির্ধারিত একটি ক্রমোচ্চ বিভাজন এবং ব্যক্তিকে আজীবন অতিবাহিত করতে হয় একই জাতের মধ্যে। 

C.H. Cooley : When a class is somewhat strictly hereditary we may call it a caste. 

আঁদ্রে বেতে : জাত হল একটি প্রথা। এই প্রথার ভিতর বর্তমান থাকে বিভিন্ন নামে পরিচিত এক একটি জনগোষ্ঠী। প্রতিটি জনগোষ্ঠী অন্তর্বৈবাহিক রীতি , বংশগত সদস্যপদ - ইত্যাদি অনুসরণ করে চলে। 

ম্যাকাইভার ও পেজ : ব্যক্তি কোনো না কোনো পূর্ব নির্ধারিত মর্যাদা গোষ্ঠীতে জন্মগ্রহণ করে এবং এই মর্যাদার পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা থাকে না। এই মর্জাদাগোষ্ঠীকে বলে জাতি। 

আরনল্ড গ্রীন : জাতি হল একটি সামাজিক স্তরবিন্যাস - যাতে মর্যাদা সিঁড়ির সচলতা থাকেনা। 

এম এন শ্রীনিবাস : জাতিভেদ প্রথা হল সর্বভারতীয় এবং এতে জন্মসূত্রে মর্যাদা নির্ধারিত হয়। 

জাতি প্রথার বৈশিষ্টসমূহ :- 


অধ্যাপক জি এস ঘুরে মোট তিনটি গ্রন্থে জাতি প্রথার বৈশিষ্টগুলি আলোচনা করেছেন। এই তিনটি গ্রন্থ হল - (i) Caste and class in India , (ii) Caste, class and occupation , (iii) Caste and Race in India . জাতিভেদ প্রথার বৈশিষ্টগুলি হল - 

১. বংশানুক্রমিতা :- জাতের সদস্যপদ বংশানুক্রমিকভাবে আরোপিত হয়ে থাকে। তাই জাত ব্যবস্থা হল জন্মভিত্তিক। এই জন্মভিত্তিক আরোপিত মর্যাদা পরিবর্তনের কোনো আশা থাকে না। ব্যক্তির শ্রেণীগত মর্যাদা পরিবর্তিত হলেও তার জাতিগত মর্যাদা কোনোভাবেই পরিবর্তিত হয়না। 

২. অন্তর্বৈবাহিকগোষ্ঠী :- জাত ব্যবস্থার মধ্যে অন্তর্বিবাহ প্রচলিত। এখানে জাতের সঙ্গে সঙ্গে স্বগোত্র , স্বপিন্ড - ইত্যাদি বিষয়েও যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই ব্যবস্থার মূলকথা হল একই জাতের মধ্যে বিবাহরীতি। তবে বর্তমানে স্বজাতির মধ্যে বিবাহের বিষয়টি তেমন প্রাধান্য না পেলেও এর অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়ে যায়নি। এখনো ব্রাহ্মণ সন্তানের বিবাহ ব্রাহ্মণ পরিবারেই উপযুক্ত বলে মনে করা হয়। 


৩. সামাজিক সচলতার অভাব :- জাতি ব্যবস্থার মধ্যে সামাজিক সচলতার বিষয়টিকে লক্ষ্য করা যায়না। ব্যক্তি যে মর্জাদাগোষ্ঠীতে জন্মগ্রহণ করে তাকে সেই আরোপিত মর্যাদা সারাজীবন ধরে বহন করতে হয়। সুতরাং , ব্যক্তির সঙ্গে তার জাতের সম্পর্ক আমৃত্যু অতিবাহিত হয়। ব্যক্তি নিজের যোগ্যতা ,শিক্ষা ইত্যাদি দ্বারা নিজের সামাজিক অবস্থানগত মর্যাদার পরিবর্তন ঘটাতে পারলেও নিজের জাতিগত মর্যাদার পরিবর্তন ঘটাতে পারেনা। 

৪. ক্রমোচ্চ বিভাজন :- জাতিভেদ ব্যবস্থায় ক্রমোচ্চ বিভাজন বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। এই মর্যাদা সিঁড়িতে সবার উপরে থাকেন ব্রাহ্মণরা এবং সবার নীচে থাকেন শূদ্ররা। তবে শূদ্র ছাড়াও যেসকল জাতি বহির্ভুত মর্যাদা গোষ্ঠী আছেন তারা মর্যাদা সিঁড়ির সবার নীচে অবস্থান করেন। এরা অস্পৃশ্য বা হরিজন নামে পরিচিত। 

৫. জাতিগত বিভিন্ন বিধি ও প্রথা :- প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব কিছু প্রথা ও রীতি থাকে। জাতিগোষ্ঠীভুক্ত মানুষেরা নিজেদের এই বিধি - ব্যবস্থা সংরক্ষণে বিশেষ সচেতন থাকেন। এই বিধি - নিয়মের প্রকাশ সর্বাধিক ঘটে থাকে বিবাহ , পারিবারিক অনুষ্ঠান - ইত্যাদির ক্ষেত্রে। তবে বর্তমানে জাতিগত নিয়মগুলি শিথিল হয়ে আসছে। 

৬. খাদ্যাভ্যাসে বিধিনিষেধ :- ভিন্ন ভিন্ন জাতিতে খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু বিধিনিষেধ আরোপিত থাকে। যেমন - উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণগণ অন্য জাতের মানুষের কাছে শুধুমাত্র ঘি দ্বারা প্রস্তুত পাক্কা খাদ্য গ্রহণ করতে পারবে। কিন্তু ব্রাহ্মণ দ্বারা প্রস্তুত খাদ্য যেকেউ গ্রহণ করতে পারবে। বর্তমানে এই নিয়ম তার কার্যকারিতা হারালেও তার অস্তিত্ব আজও বর্তমান। 

৭. বৃত্তিগত বিভাগ :- অধিকাংশ জাতই হল বৃত্তিভিত্তিক। এই বৃত্তিভিত্তিক জাতির বৃত্তি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বংশানুক্রমিক। যেমন ব্রাহ্মণদের কাজ পূজা আর্চা , বিদ্যাচর্চা। ক্ষত্রিয়দের কাজ শাসন ও দেশরক্ষা। বৈশ্যদের কাজ উৎপাদন। শূদ্রদের কাজ উপরোক্ত তিন শ্রেণীর সেবা প্রদান করা। তবে বর্তমানে এই বৃত্তিগত বিভাগের প্রভাব সমাজে খুব সামান্য। বৃত্তির সাথে বংশানুক্রমিকতার কঠোরতাও ক্রমহ্রাসমান। 

৮. জাতসূচক পদবি :- নির্দিষ্ট পদবীর ভিত্তিতে নির্দিষ্ট ব্যক্তির জাতের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন চক্রবর্তী , ভট্টাচার্য , ব্যানার্জি , মুখার্জি - ইত্যাদি পদবি ব্রাহ্মণদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আবার সেনগুপ্ত , দাসগুপ্ত - ইত্যাদি পদবি বদ্যিদের জাতসূচক। আবার বিভিন্ন জাতের মধ্যে বৃত্তিসূচক পদবি পরিলক্ষিত হয়। যেমন - কর্মকার , বণিক , গোপ - ইত্যাদি। 


৯. বিশেষ জাতির জাতিগত সুযোগ সুবিধা ও কর্তৃত্ব :- ভারতীয় সমাজে বিশেষ বিশেষ জাতির বিশেষ বিশেষ সুযোগ সুবিধা ও কর্তৃত্বের বিষয়টি লক্ষ্যনীয়। যেমন দীর্ঘকাল ধরে ব্রাহ্মণরা শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে সমাজের সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করে এসেছেন। আজও শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে তাদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়নি। ক্ষত্রিয়রা নিজেদের জাতিগত মর্যাদার ফলে দেশ শাসন ও পরিচালনার অধিকার পেয়ে এসেছেন। 

১০. জাতি - পঞ্চায়েত :- প্রত্যেক জাতি তার নির্দিষ্ট আচরণ করছে কি'না এবং আরোপিত বিধিনিয়মগুলি রক্ষিত হচ্ছে কি'না তা দেখার জন্য জাতি পঞ্চায়েত নামক একপ্রকার সংগঠনের অস্তিত্ব ছিল। আরোপিত বিধিনিষেধগুলি উল্লঙ্ঘন করলে জাতি পঞ্চায়েত কর্তৃক শাস্তির বিধান ছিল। 

১১. আরোপিত মর্যাদা :- একজন ব্যক্তি নিজের জাত ব্যবস্থায় যে মর্যাদা লাভ করে তা আরোপিত প্রকৃতির। এই ব্যবস্থা জন্মসূত্রে নির্ধারিত হয় এবং এই মর্যাদা কোনোভাবেই পরিবর্তন করা সম্ভব নয় বা মর্যাদা সিঁড়িতে ওঠানামা করা সম্ভব নয়। 

১২. সমপাঙক্তেয়তা :- এই রীতি অনুযায়ী উচ্চজাতির ব্যক্তিবর্গ শুধুমাত্র নিজেদের জাতিগোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের সাথেই সম্পর্ক স্থাপন করবে ও পংক্তি ভোজন করবে। উচ্চশ্রেনীর ব্রাহ্মণ কখনই নীচু শ্রেনীর মানুষদের সাথে পংক্তিভোজন করবে না। 

১৩. বিশেষ বিশেষ জাতির সামাজিক ও ধর্মীয় অক্ষমতা :- ভারতে কোনো কোনো জাতিগোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের মনে করা হত অপবিত্র ও অশুচি। তাই তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে কোনোরূপ ক্ষমতা ও অধিকার স্বীকৃত হত না। যেমন - পেশোয়া রাজত্বকালে মহাড় ও মঙ - রা পুনা গেটে সকাল ৯ টার আগে ও বিকাল তিনটার পর প্রবেশ করতে পারতো না। এছাড়াও হরিজনেরা বহুদিন ধরে মন্দির , বিদ্যালয় - ইত্যাদি স্থানে প্রবেশ করতে পারতো না। 

১৪. সামাজিক নিয়ন্ত্রণ :- অধ্যাপক দুবে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে জাত ব্যবস্থার ভূমিকার কথা বলেছেন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের নিজস্ব রীতি , বিধি নিষেধ - ইত্যাদির দ্বারা মানুষের জীবন পরিচালিত হত। মানুষের বিভিন্ন সমস্যা ও বিবাদ - ইত্যাদির সমাধান ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে জাত ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। 

পরিশেষে বলা যায় , বর্তমান ভারতে জাত প্রথার প্রভাব ক্রমশঃ শিথিল হয়ে এলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার প্রভাব আজও বর্তমান। তবে সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণের ক্ষেত্রে জাত প্রথার তুলনায় মানুষের দক্ষতা , যোগ্যতা - ইত্যাদি বিষয়গুলি বর্তমানে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। 

Book Reference :- 
১. ভারতীয় সমাজ - অনাদিকুমার মহাপাত্র। 
২. উচ্চমাধ্যমিক সমাজতত্ত্ব - অরুনাংশু প্রধান। 


You May Also Like

0 comments