ভিয়েনা সম্মেলনের নীতিগুলি আলোচনা কর।

by - January 18, 2022

ভিয়েনা সম্মেলনের নীতিগুলি আলোচনা কর।  

Discuss the principles of the Vienna Conference. ( In Bengali ) 



ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত নীতি :- 


নেপোলিয়নের চূড়ান্ত পতনের পর বিজয়ী রাষ্ট্রবর্গ ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দের নভম্বের মাসে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা নগরীতে এক সম্মেলনে মিলিত হন। ১৮১৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত সম্মেলনটি চলে। এই সম্মেলনে ইউরোপের বিভিন্ন শক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করলেও মূলতঃ চার বিজয়ী রাষ্ট্র - অস্ট্রিয়া , রাশিয়া , প্রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের ভূমিকাই ছিল প্রধান। এই চার রাষ্ট্রকে একত্রে Big Four বলা হত। তৎকালীন ইউরোপের প্রধান রাজনৈতিক চালিকা শক্তি এই চার রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ছিল। এই সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যতে ফ্রান্সের আক্রমণাত্মক নীতি থেকে ইউরোপকে রক্ষা করা। এই সম্মেলনে যোগদানকারী নেতৃবর্গের মধ্যে প্রধান ছিলেন - অস্ট্রিয়ার রাজা প্রথম ফ্রান্সিস , প্রাশিয়ার রাজা তৃতীয় ফ্রেডারিক উইলিয়াম ও রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার। তবে এই সম্মেলনের মূল নিয়ন্ত্রক ও নীতি নির্ধারক ছিলেন অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স মেটারনিখ। 


ভিয়েনা সম্মেলনে মূলতঃ তিনটি নীতি গৃহীত হয়। এই তিনটি নীতি ছিল - 
(1) ন্যায্য অধিকার নীতি ,
(2) ক্ষতিপূরণ নীতি ও 
(3) শক্তি সাম্য নীতি। 

(1) ন্যায্য অধিকার নীতি :- 

ন্যায্য অধিকার নীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লব পূর্ববর্তী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ফ্রান্স তথা ইউরোপকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। এই নীতির প্রস্তাব করেছিলেন তাঁলেরা। পূর্বতন রাজতন্ত্রের সমর্থক , প্রতিক্রিয়াশীল ও বিপ্লব বিরোধী মেটারনিখ এই প্রস্তাব গ্রহণ করে বিপ্লব পরবর্তীকালে নেপোলিয়ন কর্তৃক গৃহীত সকল ব্যবস্থাকে অবৈধ বলে ঘোষনা করেন। ঘোষণা করা হয় যে , প্রাক নেপোলিয়ন যুগের সকল বংশানুক্রমিক রাজারা , যারা নেপোলিয়ন কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন তাদের সিংহাসন ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এই নীতি অনুসারে ইউরোপের পুরোনো রাজবংশগুলি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁদের পুরোনো অধিকার ফিরে পায়। যেমন - 
(i) এই নীতির প্রয়োগের মাধ্যমে ফ্রান্সের রাজনৈতিক ক্ষমতা পূর্বতন বুরবোঁ রাজবংশের হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং ষোড়শ লুইয়ের ভ্রাতা অষ্টাদশ লুইকে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসানো হয়। 
(ii) অরেঞ্জ রাজবংশকে হল্যান্ডের সিংহাসন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। 
(iii) সার্ডিনিয়া - পীয়েডমন্টে স্যাভয় পরিবারের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। 
(iv) পোপকে তাঁর মধ্য ইতালির রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া হয়। 
(v) উত্তর ইতালি ও জার্মানিতে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। 
(vi) সিসিলি ও নেপলস -এ অযোগ্য ফার্দিনান্দকে অধিকার দেওয়া হয়। 
(vii) স্যাক্সনির একাংশ প্রাশিয়াকে প্রদান করা হয় - ইত্যাদি। 
তবে ন্যায্য অধিকার নীতি সকলক্ষেত্রে কার্যকর করা হয়নি। যেমন ভেনিস ও জেনোয়ার রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য বিনষ্ট করা হয়েছিল। 


(2) ক্ষতিপূরণ নীতি :- 

নেপোলিয়নের রাজত্বকালে ইউরোপের বহু রাষ্ট্র ; যেমন - সুইডেন , ইংল্যান্ড , প্রাশিয়া , রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ক্ষতিপূরণ নীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল এই সকল ক্ষতিগ্রস্থ রাষ্ট্রগুলিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের লক্ষ্যে ফ্রান্সের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয় ও ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলির কিছু অংশ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ার নীতি গ্রহণ করে। এই নীতি অনুসারে - 
(i) ফ্রান্সের কাছ থেকে ৭০ কোটি ফ্রাঁ ক্ষতিপূরণ দাবী করা হয়। 
(ii) নেপোলিয়ন যেসকল মূল্যবান সামগ্রী বিভিন্ন দেশ থেকে ফ্রাসে নিয়ে এসেছিলেন - সেগুলি ফেরৎ দিতে হয়। 
(iii) ফিনল্যান্ড , পোল্যান্ডের কিছু অংশ এবং বেসারবিয়া রাশিয়াকে প্রদান করা হয়। 
(iv) স্যাক্সনির অর্ধেকাংশ , ওয়েস্টফেলিয়ার কিছু অংশ , পোল্যান্ডের কিছু অংশ , ডানজিগ ও থর্ন - প্রাশিয়াকে দেওয়া হয়। 
(v) বেলজিয়ামে হল্যান্ডের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। 
(vi) ভেনেসিয়া , লোম্বার্ডি লাভ করে অস্ট্রিয়া। 
(vii) হেলিগোল্যান্ড , মাল্টা ও আইওনিয়ান দ্বীপপুঞ্জ - ইত্যাদির অছি ক্ষমতা লাভ করে ইংল্যান্ড। 
(viii) এছাড়াও মরিশাস , সিংহল , ত্রিনিদাদ - ইত্যাদির উপরেও ইংল্যান্ডের আধিপত্য প্রতিষ্টিত হয়। 
(ix) ডেনমার্ক থেকে নরওয়েকে বিচ্ছিন্ন করে তা সুইডেনকে প্রদান করা হয়। ইত্যাদি। 


(3) শক্তিসাম্য নীতি :- 

শক্তিসাম্য নীতির দ্বারা ইউরোপীয় শক্তিগুলি যাতে পুনরায় বল প্রদর্শনে লিপ্ত না হতে পারে সেজন্য ইউরোপীয় শক্তিবর্গকে বিপ্লব পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। মূলতঃ ফ্রান্সের শক্তি চরমভাবে বিনষ্ট করাই ছিল শক্তিসাম্য নীতির উদ্দেশ্য। শক্তিসাম্য নীতি বাস্তবায়ন করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় ; যেমন - 
(i) ফ্রান্সের সেনাবাহিনী ভেঙে দেওয়া হয়। 
(ii) ফ্রান্সে পাঁচ বছরের জন্য মিত্রপক্ষের সেনা মোতায়েন করা হয়। 
(iii) মিত্রপক্ষের সেনার ভার ফ্রান্সের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। 
(iv) ফ্রান্স যাতে পুনরায় শক্তিশালী না হতে পারে বা ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলিকে আক্রমণ না করতে পারে সেজন্য ফ্রান্সের চতুর্দিকে মিত্রপক্ষের বেষ্টনী রচিত হয়। 
(v) বেলজিয়ামকে হল্যান্ডের সাথে যুক্ত করে অরেঞ্জ বংশকে শক্তিশালী করা হয়। 
(vi) সার্ডিনিয়া - পিডমন্টকে জেনোয়া প্রদান করে ফ্রান্সের দক্ষিণ - পশ্চিম সীমান্তে শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। 
(vi) উত্তর - পশ্চিম জার্মানিতে প্রাশিয়ার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। 
(vii) দক্ষিণ জার্মানিতে ও উত্তর ইতালিতে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। 

পরিশেষে বলা যায় , ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত নীতিগুলি সমালোচনার উর্দ্ধে নয়। ভিয়েনা সম্মেলনের প্রধান নেতৃবর্গ , বিশেষকরে মেটারনিখ ছিলেন চরম প্রতিক্রিয়াশীল ও রক্ষণশীল। ভিয়েনা সম্মেলনের সকল নীতির একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপকে বিপ্লব পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। প্রকৃতপক্ষে ভিয়েনা সম্মেলন ইউরোপকে প্রগতিশীলতার পরিবর্তে পশ্চাদমুখী করে তোলে।   

   

You May Also Like

0 comments