নগরায়ণের সংজ্ঞা দাও। নগরায়ণের কারণগুলি লেখ।

by - January 25, 2022

নগরায়ণের সংজ্ঞা দাও। নগরায়ণের কারণগুলি লেখ। 

Define Urbanization . Discuss the causes of Urbanization ( In Bengali ) .  




নগরায়ণের ধারণা ও সংজ্ঞা :- 


নগরায়ণ হল একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা গ্রামাঞ্চলের নগরে রূপান্তরকরণ ঘটে। সাধারণভাবে যে জনসমাজের ৭৫% কর্মক্ষম পুরুষ কৃষি ছাড়া অন্যান্য বৃত্তিতে নিযুক্ত থাকেন - সেই জনসমাজকে নাগরিক জনসমাজ বলা হয়। সমাজবিজ্ঞানী Biersted তাঁর '' Social Order '' শীর্ষক গ্রন্থে নগরায়ণকে একটি Process বা প্রক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করেছেন। 


অধ্যাপক S.C. Dube বলেছেন - নগর বা শহর সমাজ কাঠামোর অপরিহার্য অঙ্গসমূহের উপর প্রভাব বিস্তার করে। নাগরিক সভ্যতার নিজস্ব ও পৃথক প্রকৃতির প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক বৈশিষ্ট বর্তমান। 

অধ্যাপক কিংসলে ডেভিস তাঁর '' Human Sociology '' গ্রন্থে বলেছেন , নগরায়ণের ফলাফল বা প্রভাব - প্রতিক্রিয়া নগরের সীমাকে অতিক্রম করে যায় এবং পরোক্ষভাবে অন্যান্য অঞ্চলের নগরায়ণের প্রক্রিয়াকে তরান্নিত করে। 

Horton ও Hunt তাঁদের  '' Sociology '' শীর্ষক গ্রন্থে নগরায়ণের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেছেন - '' ..... urbanization brings certain inescapable social consequences - population density , anonymity , impersonality , regimentation , segmentation of personality.'' 

Lewis Wirth নগর সভ্যতা প্রসঙ্গে বলেছেন - বৃহত্তর , ঘন জনবসতিপূর্ণ এবং সমাজগতভাবে বিষম জাতি - বর্ণ মিশ্রিত ব্যক্তিসমষ্টি হল নগরসভ্যতা।   


নগরায়ণের কারণ :- 


১. নগরায়নের প্রবণতা :- বিশ্বের প্রতিটি জনসমাজের মধ্যেই নতুন নতুন অঞ্চলকে নগরে পরিণত করার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে এই প্রবণতা অতি দ্রুতগতিসম্পন্ন হয়ে উঠেছে। মূলতঃ গ্রামীণ জীবনের সুযোগ সুবিধার অভাব , বেকারত্ব - ইত্যাদি কারণে মানুষ স্বভাবগতভাবে নগরায়নের পক্ষপাতী। 

২. অর্থনৈতিক সুবিধা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ :- গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক সমাজে কর্মসংস্থানের সুযোগ তুলনামূলকভাবে খুব কম। কিন্তু নগরাঞ্চলে মানুষ নিজের যোগ্যতা , বিদ্যা - ইত্যাদি দ্বারা নিজের পছন্দমত কর্মে অংশগ্রহণ করতে পারেন। সরকারি ও বেসরকারি চাকরির সুযোগ নগরাঞ্চলে অনেক বেশি থাকে। এছাড়াও নতুন উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রেও শহরাঞ্চলের পরিকাঠামো সহায়ক হয়। 

৩. উচ্চশিক্ষার সুযোগ :- গ্রামীণ জনজীবনে বিদ্যালয়ের গন্ডি পার হলেই পরিকাঠামোর অভাবে শিক্ষার্থীরা শহরে চলে আসতে বাধ্য হয়। শহরে মহাবিদ্যালয় , বিশ্ববিদ্যালয় - ইত্যাদি উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলি যথেষ্ট সংখ্যায় থাকার ফলে শহরাঞ্চলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ - সুবিধা অনেক বেশি পরিমানে বর্তমান। এছাড়াও ভিন্নধর্মী বিভিন্ন রকম শিক্ষা - যেমন - কারিগরি শিক্ষা , ইঞ্জিনিয়ারিং , মেডিক্যাল - ইত্যাদি শিক্ষার ক্ষেত্রে একমাত্র শহরাঞ্চলেই প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়। 

৪. গ্রামীণ ক্ষেত্রে পেশাগত সচলতার অভাব :- গ্রামীণ সমাজে শ্রমবিভাজন বদ্ধ প্রকৃতির। তাই  পেশাগত সচলতার পথ বন্ধ থাকার জন্য মানুষ নাগরিক জীবনের অভিমুখী হয়ে ওঠেন। শহরাঞ্চলে শ্রমবিভাজনের বৈচিত্রের কারণে মানুষ সেখানে সহজেই নিজের পেশাগত লক্ষ্য পূরণ করতে পারে। 

৫. সরকারি নীতি :- সরকারের উন্নয়নমূলক ব্যয় - বরাদ্দের অধিকাংশই শহরের উন্নয়নমূলক প্রকল্পে ব্যয় করা হয়। কর্মসংস্থান , যোগাযোগ , নাগরিক জীবনের উন্নয়ন - ইত্যাদি বহু ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য সরকার সর্বদা সজাগ থাকেন। সরকারি নীতি ব্যাপকভাবে শহরের উন্নয়নকল্পে ব্যবহৃত হলে গ্রাম্য জীবন অবহেলিত হয় এবং মানুষ বাধ্য হয়ে শহরাভিমুখী হয়ে ওঠেন। 


৬. সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণ :- অনেক সময় সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণ গ্রামীণ জীবনের অবক্ষয়ের প্রধান কারণ হয়ে ওঠে এবং শহরাঞ্চলের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। যেমন সরকার খাদ্যশস্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করেন। এর ফলে শহরের মানুষ সস্তায় খাদ্য পণ্য লাভ করলেও গ্রামীণ কৃষক সমাজ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পক্ষান্তরে সরকার কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় বীজ , সার - ইত্যাদির মূল্য নিয়ন্ত্রণে ততটা আগ্রহ দেখান না। এইপ্রকার সরকারি নীতি গ্রামাঞ্চলের স্বার্থ বিঘ্নিত করে কিন্তু অপরদিকে নাগরিক জীবন সমৃদ্ধ হয়। 

৭. প্রশাসনিক কেন্দ্র :- কোনো রাষ্ট্র এবং সেই রাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যের প্রশাসনিক কেন্দ্রগুলি স্বাভাবিক কারণেই নগরে পরিণত হয়। এছাড়াও রাজ্যের অন্তর্গত বিভিন্ন জেলাগুলির জেলাসদর প্রশাসনিক কেন্দ্র হওয়ার কারণে তা শহরে পরিণত হয়। প্রত্যেক প্রশাসনিক কেন্দ্রে বিপুল পরিমান মানুষের যোগাযোগ , অংশগ্রহণ , প্রত্যাশা পূরণ - ইত্যাদি কারণে প্রশাসনিক কেন্দ্রগুলি মানুষের স্বার্থ ও উদ্দেশ্য পূরণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। 

৮. রাজনৈতিক কর্মকেন্দ্র :- রাজনৈতিক কর্মকান্ড বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শহরাঞ্চলকে কেন্দ্র করেই সংঘঠিত হয়। যেমন ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ছিল - কলকাতা , ঢাকা , বোম্বাই , অমৃতসর - ইত্যাদি শহরগুলি। আধুনিক সময়কালেও বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন , গণতান্ত্রিক দাবীতে আন্দোলন - ইত্যাদি শহরাঞ্চলকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। ফলে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের প্রধান কেন্দ্রগুলি নগরে পরিণত হয়। 

৯. নাগরিক জীবনের সুখ - স্বাচ্ছন্দ :- শহরাঞ্চলে যেরূপ পার্থিব সুখ - স্বাচ্ছন্দ্যের উপস্থিতি দেখা যায় , গ্রামাঞ্চলে তা দেখা যায়না। বিলাস , মনোরঞ্জন , আধুনিক ভোগ্যপণ্য , পাশ্চাত্য সংস্কৃতির তীব্র আকর্ষণ , বৈচিত্রময় শ্রমবিভাজন - ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে মানুষ নাগরিক জীবনকেই অধিক শ্রেয় বলে মনে করেন এবং এই কারণেই গ্রামাঞ্চলগুলিও ধীরে ধীরে শহরাভিমুখী হয়ে উঠছে। 

১০. গ্রামীণ সমাজের বিভিন্ন সমস্যা :- গ্রাম সমাজের বিভিন্ন সমস্যাগুলোও পক্ষান্তরে শহরের বিকাশে সহায়তা করছে। গ্রামীণ জনজীবনে বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। যেমন - জাত প্রথার কড়াকড়ি , বদ্ধ শ্রমবিভাজন , বিভিন্ন কুসংস্কার , বর্ণভেদের অভিশাপ , উচ্চবর্গের শোষণ , অবহেলিত গ্রামোন্নয়ন ও শিক্ষা - ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়গুলি মানুষের স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক জীবনের পরিপন্থী। এই সমস্যাবহুল পরিবেশকে মানুষ তাই সহজেই শহরাঞ্চলে পরিণত করার বা শহরাভিমুখী হয়ে ওঠার প্রয়াস করতে থাকে। 

পরিশেষে বলা যায় , নগরায়নের কারণগুলি দেশ - কাল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তবে পৃথিবীর সমস্ত দেশে , সমস্ত কালে যে সকল নগরায়ন ঘটেছে তার জন্য উপরোক্ত কারণগুলি সাধারণ কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। উপরোক্ত কারণগুলি ছাড়াও আরো কিছু কারণ নগরায়নের জন্য দায়ী। যেমন - ঐতিহাসিক , সাংস্কৃতিক , ধর্মীয় , শিক্ষামূলক - প্রধান ও বিখ্যাত কেন্দ্র গুলি সহজেই নগরে পরিণত হয়। এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বিশ্বায়ন ও পাশ্চাত্যের প্রভাবও নগরায়নের জন্য দায়ী। 

Book Reference :-
ভারতীয় সমাজ : অনাদিকুমার মহাপাত্র। 
ভারতের সামাজিক সমস্যা - বাণী প্রকাশন। 

   

You May Also Like

0 comments