নগরায়ণের বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর।

by - January 25, 2022

নগরায়ণের বৈশিষ্টগুলি আলোচনা কর। 

Discuss the features / characteristics of urbanization ( In Bengali ) . 




নগরায়ণের বৈশিষ্ট :- 


১. Lewis Wirth কর্তৃক প্রদত্ত নগরায়ণের বৈশিষ্ট :- Lewis Wirth নগরায়ণের কয়েকটি বৈশিষ্টের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন - 
(i) নগর অঞ্চলের সামাজিক সম্পর্কগুলি স্বল্পস্থায়ী হয়। প্রয়োজনের ভিত্তিতে তাঁরা অন্যের সাথে অল্প সময়ের জন্য সম্পর্ক গড়ে তোলেন। 
(ii) প্রতিবেশীদের সাথে সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা , সামাজিক গোষ্ঠীগুলিতে অংশগ্রহণ করা - ইত্যাদি বিষয়গুলি নগরজীবনে উপেক্ষিত থাকে। 
(iii) শহরকেন্দ্রিক মানুষ খুব অল্পসংখ্যক মানুষের সাথে মিথস্ক্রিয়া গড়ে তোলেন। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক এখানে আনুষ্ঠানিক। 
(iv) নগরবাসীদের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্পর্কের গভীরতা থাকেনা। 
(v) নগরজীবনে ব্যক্তিবর্গ ব্যক্তিস্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। 


২. Ruth Glass কর্তৃক প্রদত্ত নগরায়ণের বৈশিষ্ট :- রুথ গ্লাস নগরায়ণের কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হিসেবে - সচলতা , অনামিয়তা , ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ , আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক , সামাজিক পৃথকীকরণ , ক্ষণস্থায়িত্ব , সামাজিক ঐক্যের জৈবিক প্রকৃতি - ইত্যাদিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। 

৩. K. Dewis কর্তৃক প্রদত্ত নগরায়ণের বৈশিষ্ট :- K. Dewis নগরায়নের মোট ৮ টি বৈশিষ্টের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল - (i) সামাজিক বিষমতা , (ii) গৌণ প্রতিষ্ঠানসমূহ ,  (iii) সামাজিক সচলতা ,  (iv) ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ , (v) সামাজিক সহনশীলতা , (vi) গৌণ নিয়ন্ত্রণবিধি , (vii) স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানসমূহ  - ইত্যাদি। 

৪. S.C. Dube কর্তৃক প্রদত্ত নগরায়ণের বৈশিষ্ট :- S.C. Dube তাঁর '' Indian Society '' শীর্ষক গ্রন্থে নগরায়ণের কয়েকটি বৈশিষ্টের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল - 
(i) নাগরিক জীবনধারায় সাবেকি সমাজ কাঠামো শিথিল হয়ে পড়ে এবং সামাজিক অনুশাসনসমূহ হীনবল হয়ে পড়ে। 
(ii) মানবিক সম্পর্কসমূহ প্রকৃতিগতভাবে আনুষ্ঠানিক হয়ে পড়ে। 
(iii) সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য পেয়ে থাকে। 
(iv) সনাতন আচার অনুষ্ঠান এবং আত্মীয় স্বজন সম্পর্কিত দায়বদ্ধতা হ্রাস পেতে থাকে। 
(v) অর্থনৈতিক স্বার্থ ও ব্যক্তিস্বার্থের কাছে জাতপাত ও সাম্প্রদায়িক বিচার গুরুত্ব হারায়। ফলে ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশের সূচনা হয়। 
(vi) নগরায়ণের ফলে শ্রমবিভাজনের বৈচিত্র বৃদ্ধি পায়। 
(vii) স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহ বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কর্মে অংশগ্রহণ করে। 
(viii) নগরায়ণের সাথে সাথে শিক্ষা , সংস্কৃতি ,বিনোদন - ইত্যাদির ব্যাপক প্রসার ঘটে এবং সেগুলি প্রাতিষ্ঠানিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। 
(ix) আধুনিকীকরণ নগরায়ণের একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট। 


৫. যান্ত্রিক জীবনযাত্রা :- নগরজীবনে ব্যক্তি সম্পর্কগুলি আনুষ্ঠানিক হওয়ায় তাদের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা খুব কম থাকে। ফলে মানুষ অন্তঃসারশুন্য সামাজিক সম্পর্ক অতিবাহিত করতে থাকে। সম্পর্কগুলি মোটামুটিভাবে ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে পরিচালিত হয়। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড , সামাজিক ক্রিয়াকলাপ - ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই যান্ত্রিকতা লক্ষ্য করা যায়। 

৬. আচরণগত এবং কার্যপ্রনালীগত বিশেষজ্ঞতা :- বিরাট সংখ্যক জনসংখ্যার অভ্যন্তরীণ অসদৃশ্যতা বিশেষীকরণকে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। বিশেষীকরণ বহুমুখী জীবনধারা গড়ে তোলে। বহুমুখী পেশাভিত্তিক জীবনধারা , বহুমুখী স্বার্থ ও জীবনদর্শন - এই অসদৃশ্যতাকে পাথেয় করে গড়ে ওঠে। এই বিশেষজ্ঞতার সহজলভ্যতার ফলে মানুষের সামনে নানাবিধ সুযোগ সৃষ্টি হয়। এইভাবে শহরাঞ্চলে গড়ে ওঠে অসদৃশ্য জনসংখ্যা এবং বৈচিত্রপূর্ণ আচরণ। 

৭. অনামিয়তা ও নৈর্ব্যক্তিকতা :- উচ্চ ঘনবসতিযুক্ত জীবন প্রণালীতে ব্যক্তি পরিচিতিকে এড়িয়ে চলে। এরফলে পারস্পরিক সহাবস্থানের ধারণাটি অনুপস্থিত হয়ে পড়ে। এর ফল হিসেবে সামাজিক দায়বদ্ধতা হ্রাস পায় এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র বৃদ্ধি পায়। মানুষ আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থে পরিচালিত হতে থাকে। এই নৈর্ব্যক্তিকতার ফলে ব্যক্তি উচ্চাকাঙ্খী ও উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠে এবং নগরায়নের সুবিধাগুলিকে পাথেয় করে সেই উচ্চাকাঙ্খা চরিতার্থ করতে সচেষ্ট হয়। 

৮. সাংস্কৃতিক পরিবর্তন :- নগরায়ণ প্রক্রিয়ার প্রসারের সাথে সাথে সনাতন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টগুলির পরিবর্তন ঘটে। মানুষ চিরাচরিত সংস্কৃতিকে ধারণ ও বহন করার পরিবর্তে আধুনিক ভোগবাদের স্রোতে ভেসে যেতে অধিক স্বচ্ছন্দবোধ করে। এমনকি নগরজীবনের সাংস্কৃতিক গতিধারা ব্যক্তিস্বার্থে পরিচালিত হয়। ফলে সনাতন সাংস্কৃতিক জীবনের মৃত্যু ঘটে। 

৯. আধুনিকতা ও ভোগবাদের বিকাশ :- নগরায়ণের সাথে সাথে আধুনিকতা ও ভোগবাদের বিকাশ গতিলাভ করে। ভোগবাদের আধুনিক পণ্যগুলিকে নিজেদের করায়ত্ত করতে মানুষ ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মানুষের জীবন যন্ত্রনির্ভর ও প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে ওঠে। প্রযুক্তির ব্যবহার একদিকে মানুষের জীবনকে যেমন সরল করে তোলে , তেমনি অন্যদিকে বহুজাতিক বাণিজ্য সংস্থাগুলি তাদের পণ্যের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করে ও মানুষকে পণ্যের দাসে পরিণত করে। 

১০. বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া ও নগরায়ণ :- বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া গ্রামাঞ্চলের তুলনায় নগরাঞ্চলে অধিক প্রসার লাভ করে। ফলে সনাতন সংস্কৃতি , জাতীয়তাবোধ - ইত্যাদির পরিবর্তে আধুনিক পাশ্চাত্যবাদী চিন্তা ভাবনা দ্বারা মানুষ অধিক প্রভাবিত হয়। এর ইতিবাচক ফল হিসেবে বিশ্বমানবতার আদর্শের প্রসার ঘটে। 

পরিশেষে বলা যায় , নগরকেন্দ্রিক বৈশিষ্টগুলির মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক , প্রাথমিক গোষ্ঠী এবং সামাজিক নৈকট্য বিশেষ প্রাধান্য পায়নি। কৃত্রিমভাবে গড়ে ওঠা কতকগুলি ব্যক্তিস্বার্থভিত্তিক সংগঠন ব্যক্তির চলার পথকে সচল করে তুললেও ব্যক্তিকে একটি কৃত্রিম ও প্রতিযোগিতামূলক জীবন উপহার দেয়। কিন্তু তা স্বত্তেও বলা যায় , প্রাথমিক গোষ্ঠীগুলির গুরুত্ব নাগরিক জীবনে এখনো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। তাই কে এম কাপাডিয়া , রামকৃষ্ণ মুখার্জি - প্রমুখেরা গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে , গ্রামীণ মানুষ শহরমুখী হয়ে গ্রাম ত্যাগ করলেও সনাতন রীতিনীতি , ঐতিহ্য , সংস্কৃতি - ইত্যাদি প্রাথমিক গোষ্ঠীগুলিতে আজ বিদ্যমান আছে। 

Book Reference :- 
১. ভারতীয় সমাজ - অনাদিকুমার মহাপাত্র। 
২. ভারতীয় সামাজিক সমস্যা - বাণী প্রকাশন।  


You May Also Like

0 comments