সুফিবাদ কাকে বলে ? সুফিবাদের উদ্ভব ও প্রসার আলোচনা কর।

by - January 26, 2022

সুফিবাদ কাকে বলে ? সুফিবাদের উদ্ভব ও প্রসার আলোচনা কর। 

অথবা , সুফিবাদ সম্পর্কে লেখ।  




সুফিবাদ :- 

সুলতানি যুগে ইসলামীয় সংস্কার আন্দোলন ' সুফি আন্দোলন ' নামে পরিচিত। সুলতানি যুগে উত্তর ভারতের ধর্মীয় ইতিহাসে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সুফি মতবাদের উদ্ভবের পেছনে বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত আছে। 
ইউসুফ হোসেন - এর মতে , সুফিবাদ হল ইসলামের রূপান্তর। ইসলাম ধর্মের সূচনা পর্বেই সুফিবাদের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। হজরত মহম্মদের ইসলাম ধর্ম প্রচারকালে একদল জ্ঞানী ও ভাববাদী মানুষ এই ধর্মমত গ্রহণ করেন। কোরানের শিক্ষা ও হজরত মহম্মদের জীবন তাঁদের মূল আদর্শ হলেও , তাঁরা ইসলাম নির্দিষ্ট ধর্মপালন পদ্ধতি ও আচার - অনুষ্ঠানের বিরোধী ছিলেন। বাহ্যিক অনুষ্ঠানের পরিবর্তে তাঁরা ঈশ্বরের করুণা লাভের জন্য অন্তরের পবিত্রতার ওপর জোর দিতেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে , পবিত্র অন্তরের মধ্যেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্ভব। প্রেম ও ভক্তিই ঈশ্বর লাভের প্রধানতম উপায় এবং সর্বভূতে ঈশ্বরের সাথে মিলন সম্ভব। 


ভারতীয় ঐতিহাসিকদের মতে , এই মতবাদের উপর বৌদ্ধ প্রভাব বিদ্যমান। মধ্য এশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তারলাভ করেছিল এবং এই অঞ্চলের মানুষেরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলে ইসলাম ধর্মের উপর বৌদ্ধ প্রভাব পড়ে। হিন্দু ও বৌদ্ধদের অহিংসা , ত্যাগ , বৈরাগ্য , ঈশ্বরের প্রতি আত্মসমর্পণ , উপবাস , যোগসাধনা - প্রভৃতি আদর্শের প্রভাব সুফিবাদের ওপর পড়ে। তাই বলা যায় , বৌদ্ধ ধর্ম , হিন্দু বেদান্ত দর্শন ও অন্যান্য নানা ধর্মীয় আদর্শের সমন্বয়ে সুফিবাদের উৎপত্তি। 

'' সুফি '' কথাটির ব্যাখ্যা :- 

'' সুফি '' শব্দটিকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। 
(i) '' সাফা '' বা পবিত্রতা থেকে সুফি কথাটি এসেছে। সুফিবাদীরা দেহ , মন ও আচরণের পবিত্রতার ওপর জোর দিতেন। তাই তাঁরা সুফি নামে পরিচিত। 
(ii) '' সাফ '' বা সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান মানুষের মধ্যে শীর্ষ বা প্রধান কথাটি থেকে সুফি কথাটি এসেছে। আল্লাহের কাছে উপনীত হওয়ার জন্য তাঁর ভক্তদের মধ্যে শীর্ষে আছেন সুফিরা। এজন্যই তাঁরা সাফ বা সুফি। 
(iii) '' সুফা '' থেকে সুফি কথাটির উৎপত্তি। এইসকল সাধকেরা তাঁদের পবিত্র ও ধর্মীয় জীবনের জন্য হজরত মহম্মদের অতি বিস্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ সহচর '' অসাব - উল - সুফ '' - এর সমকক্ষ ছিলেন। তাই তাঁরা সুফি নামে পরিচিত। 
(iv) '' সুফ '' কথার অর্থ হল পশম। সুফিরা মোটা পশমের বস্ত্র দ্বারা নিজেদের আচ্ছাদিত রাখতেন বলে তাঁদের সুফি বলা হত। 
প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠন :- 
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের সময় থেকে ভারতে সুফিধর্মের প্রসার শুরু হয়। ইসলাম ধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবেই সুফিবাদের উতপত্তি হয়। অন্যান্য ভারতীয় ধর্মের মতই সুফিবাদেও গুরু - শিষ্যের সম্পর্ক ছিল গুরুত্বপূর্ণ। গুরুকে বলা হত '' পীর '' বা '' শেখ '' বা '' খাজা '' । পীরের কর্মকেন্দ্রকে বলা হত '' দরগা '' বা '' খানকা '' । সুফি ধর্মের অনুগামীদের বলা হত '' ফকির '' বা '' দরবেশ '' ।  গুরুকে কেন্দ্র করেই সুফি সন্যাসীর জীবন আবর্তিত হয়। গুরুর প্রতি অখন্ড আনুগত্য , সকল জীবের প্রতি অকৃত্তিম প্রেম , ঈশ্বরের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ - এগুলি ছিল সুফিবাদের মূল আদর্শ। 


সুফি সাধনার দশটি স্তর :- 

সুফিবাদীদের মতে , সাধনার দশটি স্তর অতিক্রম করতে পারলে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করা যায়। এই দশটি স্তর হল - 
(i) তওবা অর্থাৎ অনুশোচনা ,
(ii) ওয়ারা বা তৃষ্ণা দমন ,
(iii) ফকর বা আনন্দের সঙ্গে দারিদ্র বরণ ,
(iv) সরব বা সহনশীলতা অর্জন ,
(v) শুকর বা কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন ,
(vi) খুফ বা অন্যায় ও পাপকে ভয় করা , 
(vii) রজা বা আল্লাহর করুণা লাভের আকাঙ্খা ,
(viii) তওয়াকুল বা ভালো - মন্দ সবকিছুকে হৃষ্টমনে গ্রহণ ,
(ix) রিজা বা ঈশ্বরের প্রতি আত্মসমর্পণ ,
(x) জুহুদ বা নৈতিক নিয়মবিধি পালন। 

চিস্তি সম্প্রদায় :- 

দ্বাদশ শতকের মধ্যেই এদেশে সুফিরা অন্তত চৌদ্দটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। খাজা মইনুদ্দিন চিস্তি হলেন ভারতে চিস্তি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। দ্বাদশ শতকের শেষ দিকে তিনি আজমিরে বসবাস শুরু করেন এবং সেখানে চিস্তি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিম্নবর্গের হিন্দুদের মধ্যে ধর্মপ্রচার করতেন। তাঁর অন্যতম ব্যক্তিত্ব ও ধর্মভাবে আকৃষ্ট হয়ে হিন্দু - মুসলিম নির্বিশেষে বহু মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। 
মইনুদ্দিন চিস্তির অন্যতম শিষ্য শেখ কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকি ইলতুৎমিসের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিলেন। এই সম্প্রদায়ের অপর উল্লেখযোগ্য সন্ত ছিলেন নিজামউদ্দিন আউলিয়া। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন - আমির খসরু , লেখক আমির হাসান এবং ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরণী। স্বয়ং সুলতান আলাউদ্দিন খলজিও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ভারতে ধর্ম সমন্বয়ের ইতিহাসে নিজামুদ্দিন আউলিয়ার অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর শিষ্য নাসিরউদ্দিন চিরাগ '' চিরাগ - ই - দিল্লি '' বা দিল্লির আলো বলে পরিচিত ছিলেন। 


সুহরাবর্দি সম্প্রদায় :- 

সুহরাবর্দি সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রবক্তাগণ ছিলেন - শেখ শিহাবউদ্দিন সুহরাবর্দি ও হামিদউদ্দিন নাগোরি। এই মতবাদীদের কার্যকলাপ মূলত উত্তর - পশ্চিম ভারতের পাঞ্জাব , মুলতান ও বাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। চিস্তি সম্প্রদায়ের সাথে সুহরাবর্দি সম্প্রদায়ের আদর্শগত পার্থক্য ছিল। 
প্রথমতঃ চিস্তি সম্প্রদায়ের মানুষ ধর্মকর্ম নিয়ে দিনপালন করতেন এবং অতি সাধারণ জীবনযাত্রা করতেন। কিন্তু সুহরাবর্দি সম্প্রদায় আড়ম্বর ও আভিজাত্যপূর্ণ জীবনযাত্রায় বিশ্বাসী ছিলেন। 
দ্বিতীয়তঃ চিস্তি সম্প্রদায় রাজনীতি ও সরকারি কাজকর্ম থেকে নিজেদের বিরত রাখত। কিন্তু সুহরাবর্দিরা প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। 

অন্যান্য সম্প্রদায় :- 
খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকের মধ্যে ভারতে আরো পাঁচটি সুফি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। যথা - 
(i) কাদিরি , 
(ii) ফিরদৌসি 
(iii) শাত্তারি 
(iv) নকশবন্দী 
(v) মাদরি - সম্প্রদায়। 
ফিরদৌসি গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সমরখন্দের শেখ বদরুদ্দীন। দিল্লিতে প্রথম এই সিলসিলা গড়ে উঠলেও পরে তা বিহারেও প্রসার লাভ করে। ওপর একটি গোষ্ঠী কাদিরি যা ছিল মরমিয়া গোষ্ঠী। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শাহ নিয়ামাতুল্লাহ। তবে সৈয়দ মখদুম গিলানি দৃঢ়ভাবে এই সিলসিলাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সকল সম্প্রদায়ই সাধারণভাবে শরিয়ত - বিধিকে মান্য করত। তবে অপর একটি গোষ্ঠী , যা কালন্দর নামে পরিচিত , তারা শরিয়তকে অগ্রাহ্য করত।


You May Also Like

0 comments