জাতি কী ? তুমি কি মনে করো যে , সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় গ্রামীণ সমাজে জাতিপ্রথা পরিবর্তিত হচ্ছে ? উপযুক্ত উদাহরণসহ আলোচনা কর।

by - January 28, 2022

জাতি কী ? তুমি কি মনে করো যে , সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় গ্রামীণ সমাজে জাতিপ্রথা পরিবর্তিত হচ্ছে ? উপযুক্ত উদাহরণসহ আলোচনা কর।  


জাতি : ধারণা ও সংজ্ঞা :- 


জাতি বা Caste কথাটির উৎপত্তি স্প্যানীয় শব্দ Casta থেকে। এর অর্থ হল জাতি , কূল - প্রভৃতি। ভারতের জাতিব্যবস্থার বিষয়টিকে বোঝাবার জন্য পর্তুগিজগন প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। 

কুলি : যখন কোনো শ্রেণী সুদৃঢ়ভাবে বংশানুক্রমিক তখন তাকে বলা যেতে পারে জাতি। 

ম্যাকাইভার ও পেজ : যখন ব্যক্তিবর্গ কোনো পূর্বনির্ধারিত মর্যাদা গোষ্ঠীতে জন্মগ্রহণ করে এবং সেটি পরিবর্তনের কোনো আশা থাকেনা , তখন সেই শ্রেণীকে বলা হয় জাতি। 

মজুমদার ও মদন : জাতি হল এক বদ্ধ গোষ্ঠী। 

আরনল্ড গ্রীন : জাতি হল সামাজিক স্তরবিন্যাসের এক ব্যবস্থা , যাতে মর্যাদা সিঁড়িতে ওপর - নীচ ওঠানামা বিষয়টি প্রায় দেখা যায়না। 

শ্রীনিবাস : জাতিপ্রথা হল এক সর্বভারতীয় প্রথা , যার মধ্যে সকলের স্থান জন্মসূত্রে নির্ণীত হয়। 


ভারতীয় গ্রামীণ সমাজে জাতি ব্যবস্থায় সাম্প্রতিক পরিবর্তন :- 


জাতিভেদ প্রথার বৈশিষ্ট্যগুলি পর্যালোচনা করলে একে একটি অনড় , অচল ও বদ্ধ প্রথা হিসাবে মনে করা হয়। তবে বিভিন্ন সমীক্ষা ও গবেষণাকার্যে দেখা গেছে , এই প্রথা কোনোকালেই একটি সম্পূর্ণ নিশ্চল ব্যবস্থা ছিলনা ; বরং এর পরিবর্তনের বীজটি প্রথম থেকেই সুপ্ত অবস্থায় ছিল , যত দিন গড়িয়েছে তার বিকাশ ঘটেছে। অর্থাৎ পরিবর্তন ক্রমশ তার ব্যাপ্তিলাভ করেছে। যে বিষয়গুলির দ্বারা ভারতীয় গ্রামীণ সমাজে জাতিভেদপ্রথার পরিবর্তন সূচিত হয় , সেগুলি হল - 

১. ধর্মীয় ব্যাখ্যায় :- 
জাতিভেদ প্রথার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর সাথে সংযুক্ত ধর্মীয় ধারণাটি। বর্তমানে এ জাতীয় ধারণাটি আর নেই। আসলে বর্তমানের বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ এই কথার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা খুঁজে পাননি।  ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণের কিংবা পা থেকে শুদ্রের উৎপত্তি - এজাতীয় ধর্মীয় বিশ্বাস আজ আর সেই রূপে গ্রামীণ সমাজেও স্বীকৃত নয়। 

২. খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রে :- 
খাদ্যাভাসের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি এখন আর নেই বললেই চলে। পাক্কা ও কাচ্চা খাদ্যের মধ্যে যে পার্থক্য ছিল তাও উধাও। গ্রামীণ সমাজে নিতান্ত গোঁড়া ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্যান্য সকলেই পেঁয়াজ , রসুন , মাছ , মাংস , ডিম - ইত্যাদি আমিষ খাদ্য গ্রহণ করে থাকেন। স্বপাক খাওয়ার বিষয়টিরও  খুব কষ্টসাধ্য প্রমাণ মেলে। খাদ্যাভাস বর্তমানে ব্যক্তিগত রুচি ও অর্থনৈতিক সামর্থের উপর নির্ভরশীল। 


৩. পেশাগ্রহণের ক্ষেত্রে :- 
বর্তমানে কোনো ব্যক্তির পেশা গ্রহণের বিষয়টি জাতি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত নয়। বাস্তবে গ্রামীণ সমাজগুলিতে পূজার্চ্চনার বিষয়টিতে এখনো ব্রাহ্মণদের একাধিপত্য থাকলেও বহু ব্রাহ্মণ অন্যান্য পেশাতেও যুক্ত।তাছাড়া ক্ষত্রিয়ের রাজ্য শাসন বা বৈশ্যদের ব্যবসা - বাণিজ্য - এগুলির আর তেমন গুরুত্ব ভারতীয় গ্রামীণ সমাজগুলিতেও নেই। 

৪. বিবাহের ক্ষেত্রে :- 
জাতি এখন আর সেই অর্থে অন্তর্বিবাহ গোষ্ঠী নয়। বর্তমানে কোনো কোনো সনাতন হিন্দু পরিবার গুলোতে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও গ্রামীণ সমাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর নির্বাচনের সময় এটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহ অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল , কিন্তু বর্তমানে ভারতীয় গ্রামীণ সমাজের রোমান্টিক বিবাহ ব্যবস্থায় স্ববর্ণে বিবাহ বিষয়টি বেশ উপেক্ষিত। তাছাড়া স্বগোত্র ও স্বপিন্ড বিবাহের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আজ প্রায় মানা হয়না বললেই চলে। 

৫. অসাম্যের ক্ষেত্রে :- 
জাতিভেদ প্রথায় উচ্চতম স্থানে অবস্থিত ব্রাহ্মণগণ যেভাবে বিভিন্ন সামাজিক সুযোগ - সুবিধা লাভ করত কিংবা নিম্নবর্গের মানুষজন যেভাবে উপেক্ষিত হত , আজ তার ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। গ্রামীণ সমাজে ব্রাহ্মণদের দেখে কেউ কেউ প্রণাম জানালেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই আচরণটি পালন করা হয় না। আবার শুদ্র বলে কাউকে জোর করে দূরে সরিয়ে দেওয়াটাও আর খুব বেশি দেখা যায় না।  অযৌক্তিক ও সাম্যনীতির পরিপন্থী এই জাতীয় আচরণ আজ আইনের চোখে দন্ডনীয় অপরাধ। 

৬. জাতি পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রে :- 
গ্রামীণ এলাকায় জাতি পঞ্চায়েত জাতির বৈশিষ্ট্যগুলি ও জাতিগত নিয়মবিধি যথার্থরূপে পালিত হয় কি'না সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখত। কিন্তু বর্তমানে জাতি - পঞ্চায়েত নামক প্রতিষ্ঠানটি একেবারেই অচল হয়ে পড়েছে। গ্রামাঞ্চলের কোনো কোনো সমাজের উপর এর প্রাধান্য ও  প্রভাব থাকলেও বেশিরভাগ গ্রামীণ অঞ্চলে এর কোনো ভূমিকা নেই। 


৭. অস্পৃশ্যতার ক্ষেত্রে :- 
জাতিভেদ প্রথার সঙ্গে সংযুক্ত অস্পৃশ্যতার বিষয়টি ক্ষেত্রেও বহু পরিবর্তন ঘটেছে। শুদ্ধাশুদ্ধি , ছোঁয়াছুয়িকে কেন্দ্র করে যে সামাজিক সম্পর্কের অবনতি হতে দেখা যেত , তা আজ অনেকখানি বিলুপ্ত। সংবিধানের ভূমিকার পাশাপাশি আধুনিক ,  শিক্ষিত , যুক্তিনির্ভর , গণতান্ত্রিক মানবতাবাদে বিশ্বাসী মানুষএই নক্কারজনক বিষয়টির অবলুপ্তি ঘটনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। 

৮. পবিত্রতা রক্ষার ক্ষেত্রে :- 
জাতিভেদ প্রথার সাথে যুক্ত ধর্মীয় আচরণ বা পবিত্রতা রক্ষার বিষয়ে ক্রিয়া-কলাপ ও পদ্ধতিরও ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। গ্রামাঞ্চলগুলিতেও কোনো জাতি আজ শাস্ত্র নির্ধারিত বিধান পদ্ধতি হুবহু পালন করেনা। 

৯. পদবির ক্ষেত্রে :- 
পদবি দেখে জাতি চেনা এখন খুবই শক্ত। কারণ কোনো ব্যক্তি ইচ্ছা করলে কোর্টে গিয়ে নাম - পদবি  পরিবর্তন করে নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে কোনো শুদ্র যদি ব্রাহ্মণের পদবী ধারণ করে তখন তাকে শুদ্র  বলে চেনা যায়না। ভারতের গ্রামাঞ্চলগুলিতেও বর্তমান সময়ে পদবিভিত্তিক মর্যাদা প্রদানের বিষয়টিও আজ উপেক্ষিত। 

সর্বোপরি , আধুনিক সমাজ - ব্যবস্থায় কোনো ব্যক্তির স্থান নির্ধারিত হয় তার অর্জিত মর্যাদার উপর ভিত্তি করে , জাতির মত আরোপিত মর্যাদার উপর ভিত্তি করে নয়। এই বিষয়টি ভারতীয় গ্রামসমাজ গুলিতেও  জাতিভেদ প্রথার প্রধান পরিবর্তন সূচিত করে। 


You May Also Like

0 comments