প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে হান্টার কমিশনের সুপারিশ। hunter commission

by - July 25, 2021

প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে হান্টার কমিশনের সুপারিশ। 



1882 খ্রিস্টাব্দের 3 ফেব্রুয়ারী তদানীন্তন ভাইসরয় লর্ড রিপন তাঁর কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য স্যার উইলিয়াম উইলসন হান্টার - কে সভাপতি নিযুক্ত করে প্রথম ভারতীয় শিক্ষা কমিশন বা হান্টার কমিশন গঠন করেন। 1854 - 1882 পর্যন্ত এদেশে প্রাথমিক প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার অত্যন্ত ধীরগতিতে হওয়ায় হান্টার কমিশন প্রাথমিক শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে। কমিশনের মতে , প্রাথমিক শিক্ষা হল জনশিক্ষা সম্প্রসারণের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। তাই প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ সম্পর্কে কমিশন কতকগুলি মূল্যবান সুপারিশ উপস্থাপন করেন। সুপারিশগুলি হল - 


১. শিক্ষানীতি :- 
(i) প্রাথমিক শিক্ষা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শিক্ষাস্তর হিসেবে বিবেচিত হবে। এটিকে কখনোই মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমের প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে গণ্য করা চলবে না। 
(ii) প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে দেশের জনগণের জন্য ন্যুনতম শিক্ষার ব্যবস্থা করা। 
(iii) দেশের যেসব ক্ষেত্রে নিরক্ষর ব্যক্তিদের নিয়োগ করার ব্যবস্থা চালু আছে , সেইসকল ক্ষেত্রে ন্যুনতম শিক্ষিতদের নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের কাজ অনেক বেশি সহজ হবে। 
(iv) প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতি ও প্রসারের প্রতি সরকারকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। 

২. প্রাথমিক শিক্ষার প্রশাসন :- 
(i) প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব ও পরিচালনার ভার জেলা বোর্ড ও মিউনিসিপ্যাল বোর্ডগুলির ওপর ন্যাস্ত থাকবে। 
(ii) এই ধরণের স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলি নিজ নিজ এলাকায় একটি করে শিক্ষাবোর্ড গঠন করে তার ওপর নতুন বিদ্যালয় স্থাপন করার এবং দেশীয় বিদ্যালয়গুলিকে সাহায্য করার দায়িত্ব প্রদান করবে।(iii) সরকার পরিচালনাধীন প্রাথমিক বিদ্যালগুলির দায়িত্বও এই শিক্ষাবোর্ড গ্রহণ করবে। 


৩. আর্থিক সুপারিশ :- 
(i) প্রত্যেক জেলাবোর্ড এবং মিউনিসিপ্যাল বোর্ডকে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য একটি পৃথক তহবিল গঠন করতে হবে। 
(ii) স্থানীয় এবং প্রাদেশিক রাজস্ব থেকে প্রাপ্ত অর্থের একটা বড় অংশ প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ব্যয় করতে হবে। 
(iii) শিক্ষাখাতে বরাদ্দ অর্থের ওপর প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রাধিকার ও অধিকতর দাবি থাকবে। 
(iv) সরকারকেও শিক্ষাখাতের সামগ্রিক বরাদ্দের অর্থ থেকে এক - তৃতীয়াংশ প্রাথমিক শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করতে হবে। 
(v) বিদ্যালয় পরিদর্শন ও নর্মাল স্কুল পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় খরচ প্রাদেশিক সরকারকে বহন করতে হবে। 
(vi) দরিদ্র ছাড়া অন্যান্যদের কাছ থেকে বেতনগ্রহনের ব্যবস্থা করতে হবে। 
(vii) পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বিদ্যালগুলিকে অনুদান দিতে হবে। 

৪. পাঠক্রম সংক্রান্ত সুপারিশ :- 
(i) প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হবে আঞ্চলিক ভাষা বা মাতৃভাষা। 
(ii) প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার পাঠক্রম সারা ভারতে এক ধরণের হবে না। বরং বিষয়বস্তু নির্বাচনের সময় স্থানীয় মানুষের প্রয়োজনের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করতে হবে। 
(iii) প্রাথমিক স্তরের পাঠক্রমে থাকবে দেশীয় গণিত , হিসাবশিক্ষা , জরিপ , ভৌতবিজ্ঞান , স্বাস্থ্য বিজ্ঞান , শিল্পকলা , কৃষিবিজ্ঞান - ইত্যাদি বিষয়সমূহ। 
(iv) বিদ্যালয়গুলির জন্য পাঠ্যপুস্তক নির্বাচনের ব্যাপারে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা পরিচালকবৃন্দকে স্বাধীনতা দান করতে হবে। 
(v) প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের দৈহিক , মানসিক ও চারিত্রিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা , ব্যায়াম , স্কুল ড্রিল - ইত্যাদি বিষয়গুলিকে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। 

৫. শিক্ষক - শিক্ষন সংক্রান্ত সুপারিশ :- 
(i) প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতিকল্পে শিক্ষক - শিক্ষন ব্যবস্থা সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।  
(ii) শিক্ষক - শিক্ষনের জন্য সারা দেশে বহু সংখ্যক নর্মাল স্কুল স্থাপন করতে হবে। প্রাদেশিক সরকারগুলোকে এর ব্যয়ভার ও দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। 


প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কিত হান্টার কমিশনের সুপারিশগুলির মূল্যায়ন :- 


১. কমিশন তাঁর রিপোর্টে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাকে জনসাধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যুনতম শিক্ষা হিসেবে বিবেচনা করার সুপারিশ করেছিল। এটিকে বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত না দিলেও , প্রাথমিক শিক্ষা যে জনকল্যাণের জন্য বিশেষে প্রয়োজন , তা পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল। 

২. কমিশন প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ স্তর হিসেবে সংগঠিত করার সুপারিশ করেছিল। আজ যেকোনো উন্নয়নশীল দেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ স্তর হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। 

৩. কমিশন প্রাথমিক শিক্ষার পরিচালনার ভার স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠানের ওপর অর্পণ করার সুপারিশ করেছিল। এই নীতিটিও বর্তমানে বিভিন্ন দেশে অনুসৃত হচ্ছে। আমাদের দেশে কোনো কোনো রাজ্যে - যেমন - পশ্চিমবঙ্গ , ত্রিপুরা , কেরালা ইত্যাদি রাজ্যে পঞ্চায়েত ও পৌরসভাগুলির হাতে একেবারে নীচু স্তরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির পরিচালনার জন্য বেশ কিছু দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। 

৪. কমিশন প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রমকে সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছিল। এই নীতিটিও আধুনিককালের শিক্ষাবিদরা সমর্থন করেন। 

৫. শিক্ষক - শিক্ষণ ও বিদ্যালয় পরিদর্শন বিষয়ে কমিশন যে মূল্যবান সুপারিশ করেছিল , আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় সেগুলিও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। 

এককথায় বলা যায় , বর্তমানে আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় যেসকল নীতি অনুসৃত হয় , তার মধ্যে অনেককগুলি নীতিই হান্টার কমিশনে অন্তর্ভুক্ত ছিল।   

   

You May Also Like

0 comments