কণিষ্কের কৃতিত্ব :- Achievement of Kanishka .

by - July 26, 2021

কণিষ্কের কৃতিত্ব :- 


কণিষ্কের সিংহাসনারোহনকাল :-   
কণিষ্কের সিংহাসনারোহন কাল সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে মতভেদ রয়েছে। যেমন - 
(i)  ফ্লিটের মতে , কণিষ্ক কদফিসেস রাজাদের পূর্বেই রাজত্ব করেছিলেন এবং তিনিই ৫৮ শকাব্দের প্রবর্তক।
(ii) কণিষ্কের মুদ্রায় রোমান মুদ্রার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় এবং এই মুদ্রা খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে প্রবর্তিত হয়। কদফিসেস রাজারা যে রোমান অনুকরণে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেছিলেন - সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। সুতরাং , কদফিসেস রাজাদের পরেই কণিস্ক সিংহাসনারোহন করেছিলেন - একথা বললে ভুল করা হবে না। 
(iii) ভান্ডারকরের মতে , কণিষ্ক ২৭৮ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনারোহন করেন। 
(iv) মার্শাল ও স্মিথের মতে , কণিষ্ক ১২৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনারোহন করেন। 
(v) তবে , টমাস ও র‍্যাপশন , ডক্টর বি এন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ঐতিহাসিকদের মতামত অধিকতর গ্রহণযোগ্য। তাঁদের মতে , কণিষ্ক ৭৮ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনারোহন করে একটি সম্বৎ প্রচলন করেন। এই সম্বৎ ' শকাব্দ ' নামে পরিচিত। 


১. সাম্রাজ্যবিস্তার :- 
কণিষ্কের সিংহাসনারোহনের সময় আফগানিস্তান , সিন্ধুর এক বিরাট অংশ , পাঞ্জাব এবং পার্থিয়া ও ব্যাকট্রিযার কিয়দংশ কুষাণ সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। কণিষ্ক বহু রাজ্য জয় করে এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হন। তিনি কাশ্মীর জয় করে তা নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। কলহন রচিত রাজতরঙ্গিনী থেকে জানা যায় , কাশ্মীরে তিনি কণিষ্কপুর নামে একটি শহরের পত্তন করেন। 
চৈনিক ও তিব্বতীয় কিংবদন্তী অনুসারে কণিষ্ক মগধ আক্রমণ করে পাটলিপুত্র দখল করেন। 
কণিষ্কের মুদ্রা থেকে জানা যায় , গাজীপুর ও গোরখপুর পর্যন্ত তাঁর রাজ্য প্রসারিত ছিল। এছাড়াও কণিষ্ক পার্থিয়ার রাজাকেও পরাজিত করেছিলেন। 
হিউয়েন সাং - এর বিবরণী থেকে জানা যায় যে , গান্ধার কণিষ্কের রাজ্যভুক্ত ছিল এবং তাঁর রাজধানী ছিল পুরুষপুর বা পেশোয়ার। 


২. চিনের সাথে যুদ্ধ :- 
ভারতের বাইরে কণিষ্ক চিন সাম্রাজ্যের সাথেও যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তিনি তুর্কিস্থানের অন্তর্গত কাশগড় , খোটান ও ইয়ারকন্দ জয় করেন। কিন্তু , চিন সম্রাট হো - তি - র রাজত্বকালে চিন সেনাপতি পান - চাও - এর নিকট কণিষ্ক পরাজিত হন। এর কিছুকাল পরে কণিষ্ক অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য চিন সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন এবং চিন সম্রাটের এক পুত্রকে প্রতিভুস্বরূপ নিজ রাজ্যে নিয়ে আসেন। হিউয়েন সাং এর বিবরণীতে এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। 

৩. বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ ও ধর্মীয় উদারতা :- 
বৌদ্ধ গ্রন্থ থেকে জানা যায় , কণিষ্ক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। এর পূর্বে তিনি বহু দেব দেবীতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর পূর্ব প্রচারিত মুদ্রাগুলিতে এর প্রমান পাওয়া যায়। সম্ভবতঃ সিংহাসনারোহনের কিছুকাল পরেই তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। কেননা , তাঁর পরবর্তী মুদ্রাগুলিতে বুদ্ধের মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। অনেকের মতে , বৌদ্ধ দার্শনিক অশ্বঘোষের প্রভাববশতঃ কণিষ্ক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।   
বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করলেও কণিষ্ক অন্য ধর্মের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁর মুদ্রায় গ্রিক , পারসিক - প্রভৃতি দেব - দেবীর মূর্তি অঙ্কিত দেখতে পাওয়া যায়। 

৪. বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রসার :- 
কণিষ্ক পুরোনো বৌদ্ধ মঠগুলির সংস্কারসাধন করেন। বহু নতুন বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ভরণপোষণের জন্যও তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। পেশোয়ারে তিনি একটি বিশাল বৌদ্ধমঠ স্থাপন করেন। এই মঠটি সেই যুগে বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। 
কণিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধ ধর্ম মধ্য - এশিয়া ও চিনে প্রচারিত হয়েছিল। তিনি গান্ধার শিল্পের পরম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর আমলে ভাস্কর ও চিত্রশিল্পীরা বৌদ্ধধর্মের প্রসারে সহায়তা করেন। 


৫. মহাযান ও হীনযান বৌদ্ধ ধর্মমত :- 
কণিষ্কের সময় বৌদ্ধ সমাজ ' মহাযান ' ও ' হীনযান ' - এই দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পরে। কণিষ্ক গান্ধার বা জলন্ধরে চতুর্থ বা শেষ বৌদ্ধ সঙ্গীতি আহ্বান করেন। বসুমিত্র ও অশ্বঘোষ এই সঙ্গীতির পরিচালনা করেন। এই সভায় বৌদ্ধ গ্রন্থাদি পুনর্বিবেচিত হয় এবং ত্রিপিটকের ওপর অসংখ্য টীকা প্রস্তুত করা হয়। এইগুলি একত্রে '' মহাভিভাষ্য '' নামে পরিচিত হয়। বৌদ্ধ দর্শন সম্পর্কে মহাভিভাষ্য গ্রন্থটি একটি অমূল্য সম্পদ। 

৬. শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা :- 
কণিষ্ক শিল্প ও সাহিত্যের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর আমলে বহু উৎকৃষ্ট গ্রন্থাদি রচিত হয়। তাঁর রাজসভায় বহু পন্ডিত ব্যক্তি অবস্থান করতেন। যেমন - '' বুদ্ধচরিত '' এর রচয়িতা অশ্বঘোষ , বৈজ্ঞানিক নাগার্জুন , চরক - প্রমুখ। এই যুগেই রচিত হয়েছিল  বুদ্ধচরিত , সূত্রালঙ্কার , বজ্রসূচি , মহাভিভাষ্য  - ইত্যাদি জ্ঞানসমৃদ্ধ গ্রন্থগুলি। এই সকল মনীষী ও তাঁদের রচনা সাহিত্য ক্ষেত্রে এক যুগান্তর এনেছিল।    
কণিষ্কের আমলে শিল্প - স্থাপত্য উৎকৃষ্টতার শিখরে পৌঁছেছিল। এই যুগে গ্রিক - রোমান - বৌদ্ধ শিল্পকলার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছিল যা '' গান্ধার শিল্প '' নামে পরিচিত। অমরাবতী , কৃষ্ণা প্রভৃতি নদীর উপত্যকায় প্রাপ্ত স্থাপত্য স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের নিদর্শন , মথুরায় প্রাপ্ত কণিষ্কের মস্তকবিহীন মূর্তি , তক্ষশীলা ও কাশ্মীরের নিকটে কণিষ্কপুর প্রভৃতি নগর - সে যুগের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলে বিবেচিত হয়। 

৭. রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন :- 
কণিষ্কের সাম্রাজ্য পশ্চিমে খোরাসান থেকে পূর্বে বিহার এবং উত্তরে খোটান থেকে দক্ষিণে কোঙ্কন পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। কণিষ্কের পূর্বে কোনো ভারতীয় নৃপতি মধ্য - এশিয়ার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কখনো সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারেনি। এছাড়া , মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল তা দূর করে কণিষ্ক ভারতের এক বিরাট অংশে রাজনৈতিক ঐক্য ও অখন্ডতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 

৮. বিদেশে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসার :- 
অশোকের অসমাপ্ত কার্য কণিষ্ক সমাপ্ত করেন। ভারতের বাইরে রাজ্যজয়ের ফলে মধ্য ও পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি প্রসার লাভ করে। কণিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতায় মহাযান বৌদ্ধ ধর্মমত তিব্বত , চিন ও জাপানে প্রসারিত হয়। জাতিগত ও দেশগত ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও ভারতের সঙ্গে মধ্য এশিয়ার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যোগসূত্র রচিত হয়। 

পরিশেষে বলা যায় , মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে অরাজকতা দেখা দিয়েছিল কণিষ্ক তা দূর করে এক অখন্ড সাম্রাজ্য স্থাপন করেন এবং তার সাথে সাথে কণিষ্কের নেতৃত্বে তৎকালীন ভারতবর্ষ শিল্প , সাহিত্য , ধর্ম - ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রেই উৎকর্ষতার শিখরে পৌঁছেছিল। 



You May Also Like

0 comments