খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের কারণ ।

by - June 26, 2021

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের কারণগুলি লেখ। Write the reasons for the protest religion movement of the sixth century BC.
অথবা ,  বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থানের পটভূমি আলোচনা করো। 
Or, discuss the background to the rise of Buddhism and Jainism.
অথবা , খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রতিবাদী ধর্মীয় আন্দোলনের পেছনে অন্যান্য কারণ সমূহের সাথে অর্থনৈতিক কারণ কতটা যুক্তিযুক্ত বলে তুমি মনে কর ? 





এই ওয়েবসাইটের সমস্ত প্রশ্নোত্তরের তালিকা / সূচীপত্রের জন্য এখানে CLICK করো।

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের কারণ ।


খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক ভারতের রাজনীতি ও ধর্মীয় বিবর্তনের ইতিহাসে দিকচিহ্ন হিসেবে পরিচিত। এইসময় একদিকে মগধকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয় , অন্যদিকে ধর্মীয় ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।   

বৈদিক যুগের শেষদিকে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম জটিল কর্মকান্ডে পরিণত হয়। সরল ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তে বাহ্যিক ধর্মীয় আচার আচরণ বৃদ্ধি পায়। এর পাশাপাশি ধর্মীয় ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্য শ্রেণীর একছত্র প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বভাবতই সাধারণ জনগণ ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপের প্রতি বিরাগভাজন হয়। তারা সহজ সরল ধর্ম বিশ্বাসের পথ খুঁজতে থাকে। উপনিষদে যে সহজ সরল ধর্মীয় চিন্তার অবতারণা করা হয়েছিল তারই সূত্র ধরে প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন গড়ে ওঠে। 

প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের দুটি ধারা পরিলক্ষিত হয় - (১) নাস্তিকতামূলক ও (২) একেশ্বরবাদী। প্রথম ধারায় সমস্ত বৈদিক দেবদেবীকে অস্বীকার করা হয়। দ্বিতীয় ধারায় একেশ্বরবাদী চিন্তাধারার সমর্থন পাওয়া যায় এবং তারা ভক্তিকে ঈস্বরলাভের একমাত্র পথ বলে বিবেচিত করেন। এইভাবে - বৌদ্ধ , জৈন , শৈব ও বৈষ্ণব - এই চারটি ধর্মীয় ধারার উদ্ভব ঘটে। শৈব ও বৈষ্ণব সম্প্রদায় বৈদিক দেবতা শিব ও বিষ্ণুকে কেন্দ্র করে গঠিত হয়। তাই তারা সংস্কারবাদী নামে পরিচিত। কিন্তু বৌদ্ধ ও জৈন সম্প্রদায় প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনরূপে আত্মপ্রকাশ করে। 

Dr.A.L. Basam প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের উৎপত্তি প্রসঙ্গে বলেছেন -
'' বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক আলোড়নের মধ্যে দিয়ে ভারতে এক যথার্থ ইতিহাসের আবির্ভাব হয় এই যুগে। ''

ঐতিহাসিক Dr. R. S. Sharma  প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের উৎপত্তির কারণ হিসেবে কিছু ধর্মীয় কারণকে দায়ী করেছেন। তবে ঐতিহাসিকগণ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের প্রতিবাদী আন্দোলনের কারণ হিসেবে বহুবিধ বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। যেমন -


সামাজিক কারণ -

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে সামাজিক পরিমন্ডলে পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। এই সময় উত্তর পূর্ব ভারতে দ্বিতীয় নগরায়নের সূত্রপাত ঘটে। এর পূর্বে উত্তর পশ্চিম ভারতে হরপ্পা অঞ্চলে প্রথম নগরায়নের আগমন ঘটেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় নগরায়নের ক্ষেত্রে লোহা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। 
দ্বিতীয় নগরায়ন গঙ্গা উপত্যকায় কেন্দ্রীভূত ছিল। এই সময়ের প্রধান প্রধান নগরগুলি ছিল - রাজগৃহ , বারাণসী , কোসাম্বি , শ্রাবস্তী , চম্পা - ইত্যাদি প্রতিটি নগর - নগরী গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত ছিল অধ্যাপক H. Kulke  মনে করেন - বৌদ্ধধর্ম নতুন গঙ্গা কেন্দ্রিক সভ্যতার প্রতিবিম্ব ছিল। 
[ This new Gangetic civilization found its spiritual expression in a reform movement , which was a reaction to the Brahmin - kshatriya alliance of the Later Vedic Age .]

বৈদিক যুগের শেষদিকে সমাজব্যবস্থা অনমনীয় হয়ে উঠেছিল। ব্রাহ্মণদের সামাজিক প্রতিপত্তি , মর্যাদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিলো। ক্ষত্রিয়দেরও মর্যাদা ছিল ব্রাহ্মণদের নীচে। বৈশ্যদের প্রতিপত্তি বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছিল। ফৌজদারি  বিচারেও জাতিভেদ প্রথা ব্যবহার করা হত। শুদ্রদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত হীন। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের এই কঠোর জাতিভেদ প্রথা , ও আধিপত্য সাধারণ মানুষকে বিচলিত করে তুলেছিল। এই পরিস্থিতি ধর্মীয় আন্দোলনের আত্মপ্রকাশে সহায়ক হয়েছিল। 


ধর্মীয় কারণ : বুদ্ধের বৈপ্লবিক আদর্শ -

প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের অন্যতম কারণ ছিল ধর্মীয় গোঁড়ামি , কুসংস্কারাচ্ছন্নতা ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রবল প্রতাপ। অন্যদিকে গৌতম বুদ্ধের নতুন ধর্মীয় আদর্শ , উদারতা , সরলতা , আড়ম্বরহীন ধর্মীয় ব্যবস্থা - ইত্যাদি সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। বুদ্ধ সমাজে আর্থিক বৈষম্য ও শ্রেণী সংঘাত সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণ শ্রেণীর সামাজিক প্রতিপত্তি সম্পর্কে বিরাগভাজন ছিলেন ; অন্যদিকে তিনি সামাজিক ধনসম্পদ উৎপাদনের সাথে যুক্ত বৈশ্য ও শুদ্র শ্রেণীর প্রতি অধিক সহানুভূতিশীল ছিলেন। এই অবস্থায় তিনি এমন এক পথের সন্ধান দেন যা মানুষকে এই দুঃখ দুর্দশার হাত থেকে মুক্তি দিতে পারবে। এই উদ্দেশ্যে তিনি যে ধর্ম আন্দোলনের সূচনা করেন , তা একদিকে ছিল আচার অনুষ্ঠান পীড়িত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে এবং অন্যদিকে ছিল ভোগ , সুখ ও কৃচ্ছসাধন সংক্রান্ত চরম মতবাদের বিরুদ্ধে। তাঁর প্রদর্শিত পথ সকলের গ্রহনযোগ্য হওয়ায় সাধারণ মানুষ নির্দ্বিধায় এই মতাদর্শে বিশ্বাস করে। 

রাজনৈতিক কারণ -

ক্ষত্রিয়রা ছিল শাসক ও রক্ষক। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তারা উপলব্ধি করে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় ক্ষত্রিয়দের সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ। তাই কালক্রমে তারাও ব্রাহ্মণদের বিরোধী হয়ে ওঠে এবং তারা বিকল্প মতবাদে উৎসাহী হয়ে ওঠে। তৎকালীন রাজন্যবর্গ যথা - চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য , অশোক - প্রমুখের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধ ধর্ম অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে সাথে দক্ষিণ - পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তা ছড়িয়ে পরে। 

দার্শনিক কারণ -

উপনিষদের নতুন তত্ত্ব প্রচারের ফলে সাধারণ মানুষ উপনিষদের তত্ত্ব গুলি সম্পর্কে জানতে পেরেছিল এবং তার সাথে সাথে প্রচলিত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অসাড়তা সম্পর্কে অবগত হতে পেরেছিল। তারা নতুন আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশে উৎসাহী হয়ে উঠেছিল। বস্তুতঃপক্ষে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের সময়কালে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম সনাতন হিন্দু ধর্মের মূল আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছিলো। আধ্যাত্মিক উপলব্ধির পরিবর্তে ধর্ম হয়ে উঠেছিল আচার সর্বস্ব ব্যবস্থা। কিন্তু নতুন দার্শনিক চিন্তার আবির্ভাব , উপনিষদের যথার্থ ব্যাখ্যা - ইত্যাদির ফলে মানুষ ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পেরেছিল এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। 

অর্থনৈতিক কারণ -

তদানীন্তন অর্থনৈতিক পরিবর্তনশীলতার কারণে প্রতিবাদী আন্দোলনের উদ্ভব ঘটেছিলো বলে ঐতিহাসিক ডক্টর রোমিলা থাপার ও ডক্টর রামসরণ শর্মা মনে করেন। ডক্টর ডি এন ঝাঁ মনে করেন , কৃষকের হাতে উদ্বৃত্ত সম্পদ হতে থাকাই হলো প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের কারণ। 
ডক্টর আর এস শর্মার মতে , শ্রেষ্ঠী বণিকরা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম অপেক্ষা বৌদ্ধ ধর্মকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলো। ফলে বৌদ্ধ ধর্মের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিলো। 
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর ও পূর্ব ভারতে অর্থনৈতিক রূপান্তর ঘটে। এই অর্থনৈতিক পরিবর্তন প্রতিবাদী ধর্মীয় আন্দোলনের আত্মপ্রকাশে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। এই সময় উত্তর - পূর্ব গাঙ্গেয় সমভূমিতে কৃষি অর্থনীতির বিকাশ ঘটে। কৃষিকার্য ও ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসারের ফলে নতুন শ্রেষ্ঠী সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। প্রভূত ধন সম্পদের অধিকারী হয়েও এদের সামাজিক মর্যাদা ছিলনা। স্বভাবতই তারা বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। 

ঐতিহাসিক Romila Thapar মনে করেন The Buddha had greater success among the cities of the monarchial kingdom ‘’। 

অন্যদিকে ডক্টর ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতে , সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল। এক শ্রেণীর হাতে প্রচুর ধনসম্পদ থাকলেও সাধারণ মানুষের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। 

প্রতিবাদী আন্দোলনের অর্থনৈতিক কারণের যৌক্তিকতা আলোচনা করতে গিয়ে তদানীন্তন ভারতে প্রচলিত অর্থনৈতিক অবস্থা প্রতিবাদী আন্দোলনের পথকে প্রশস্ত করেছিল বলে ঐতিহাসিক ডক্টর রোমিলা থাপার ও ডক্টর রামসরণ শর্মা মনে করেন। 


উপসংহার -

Smith - এর মতে , উত্তর ও উত্তর - পূর্ব ভারতে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থান তথা প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের একটি বড় কারণ ছিল যে , এই অঞ্চলের শাসকেরা প্রকৃতপক্ষে আর্য ছিলেন না। তাঁরা মঙ্গোলীয় জাতিগোষ্ঠীভুক্ত ছিলেন এবং তারা বৈদিক ধর্ম সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করতে পারেন নি। এই কারণেই অপেক্ষাকৃত আর্য প্রভাবমুক্ত উত্তর ও উত্তর -পূর্ব ভারতে , গঙ্গা উপত্যকা ও বিহার অঞ্চলে প্রতিবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। 
যাই হোক , খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের প্রকাশ কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিলনা। এই আন্দোলনকে নিছক ধর্মীয় বলাটাও যুক্তিযুক্ত নয়। প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন এক ব্যাপক সামাজিক বিপ্লবের নামান্তর ছিল এবং বৈষয়িক ও মানসিক পটভূমির থেকে উদ্ভুত এক আন্দোলন ভারতের জাতীয় জীবনের বিবর্তনে এক বিবর্তন সৃষ্টি করেছিল।   


You May Also Like

0 comments