বৈদিক সমাজে নারীদের সামাজিক অবস্থান : social position of women in Vedic society

by - June 26, 2021

বৈদিক সমাজে নারীদের সামাজিক অবস্থান আলোচনা করো। পরবর্তী বৈদিক যুগের নারীদের সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে কী কী পরিবর্তন ঘটেছিল ?




Discuss the social position of women in Vedic society. What were the changes in the social status of women in the later Vedic period?


বৈদিক সমাজে নারীদের সামাজিক অবস্থান :-


বৈদিক সমাজ ছিল পুরুষতান্ত্রিক এবং পিতৃপ্রধান। পুরুষ শাসিত সমাজে নারী-পুরুষের সমানাধিকার আশা করা যায় না। সন্দেহ নেই পুরুষদের তুলনায় তাদের ভূমিকা ছিল গৌণ। অনেক ক্ষেত্রেই গৃহস্থের বাইরে তাদের স্বাধীনতা খর্ব করা হতো। বিবাহের পূর্বে তারা পিতা বা ভ্রাতার অধীনে ছিলেন আবার বিবাহ-উত্তর জীবন কাটতো  স্বামী বা পুত্রের অধীনে। আবার বিবাহ করেননি , চিরকুমারী থেকে গেছেন এমন মহিলাও তখনকার দিনে বিরল ছিলনা। 
অভিভাবকহীন তারা ছিলেন না ঠিকই , কিন্তু সীমিত হলেও তাদেরও কিছু অধিকার ছিল। মেয়েদের সাধারণত একটু বেশি বয়সে বিবাহ হত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।  ফলে পতি নির্বাচনে তাদের মতামতের উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। কন্যার স্বেচ্ছায় স্বামী নির্বাচনের অজস্র দৃষ্টান্ত ঋগ্বেদে ছড়িয়ে আছে। 


গৃহস্থালিতে নারীরাই ছিলেন সর্বময় কর্ত্রী। ধর্মীয় কাজে স্ত্রী স্বামীকে সহযোগিতা করতেন। তাই তাদের বলা হত সহধর্মিনী। তারা পর্দানশিন বা গৃহবন্দী ছিলেন না। সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠানে তারা অবাধে যোগ দিতেন। এমনকি অন্তপুরের বাইরেও নারীরা পুরুষদের সহায়তা করতেন। 
সে যুগে নারীরা সামরিক ক্ষেত্রেও অংশগ্রহণ করতেন।  যুদ্ধক্ষেত্রেও বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন এমন বহু দৃষ্টান্ত ঋগ্বেদে পাওয়া যায়। বিশপলা ও মুদগলানির নাম এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

নারীদের উচ্চশিক্ষার অবাধ সুযোগ ছিল। তাদের মধ্যে অবরোধ প্রথা প্রচলিত ছিল না। ঋগ্বেদের যুগে বিশ্ববারা, ঘোষা , অপালা , মমতা - প্রমূখ মহিলারা বিভিন্ন শাস্ত্রে  বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন বলে জানা যায়। এদের মধ্যে কেউ কেউ বহু বৈদিক স্তোত্রের রচয়িত্রী হিসেবেও প্রসিদ্ধা। 
বৈদিক যুগে ধর্ম ও আধ্যাত্মিক চর্চার অধিকার থেকেও নারীদের বঞ্চিত করা হয়নি। নারীরা বৈদিক মন্ত্রও রচনা করেছিলেন। সে যুগে লোমশা , জুহু , পৌলমী ও কামায়নীর মত নারীরা ধর্মীয় সাধনার ক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছিলেন। 


বিবাহের ক্ষেত্রে নারীদের অধিকারের মিশ্র প্রমাণ পাওয়া যায়। এক পুরুষ , এক স্ত্রী - এই ছিল তখনকার দিনের বিবাহ রীতি। পুরুষেরা কোন কোন ক্ষেত্রে বহুপত্নী গ্রহণ করলেও নারীদের বহুপতি গ্রহণের নিদর্শন ঋগ্বেদে নেই। তবে নিঃসন্তান অবস্থায় স্বামী মারা গেলে নারীরা পুনর্বার বিবাহ করতে পারতেন ; সে ক্ষেত্রে নারীরা সাধারণত স্বামীর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বিবাহ করতেন। 
ঋগ্বেদে সতীদাহ প্রথার উপস্থিতির নিদর্শন পাওয়া যায়। সন্তানবতী মহিলারা অনেক সময় স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় প্রাণ বিসর্জন দিতেন। কিন্তু এই সতীদাহ প্রথা কেবলমাত্র সমাজের অভিজাত পরিবারের মধ্যে প্রচলিত ছিল ; সমাজের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েনি। 


বিবাহে পণপ্রথা প্রচলিত ছিল তবে তা বর্তমান যুগের তুলনায় ছিল ভিন্নধর্মী। বিবাহকে নর-নারীর মধ্যে পবিত্র বন্ধন বলে মনে করা হতো। পণপ্রথা প্রচলিত থাকলেও সাধারণত সে পণ পেতেন কন্যার পিতা। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও ছিল। কন্যা প্রতিবন্ধী হলে বা অন্য কোনো বিশেষ কারণে কন্যার পিতা বরপণ প্রদান করতে বাধ্য হতো। 
ঋক - বৈদিক সাহিত্যিক উপাদান গুলি থেকে জানা যায় সে যুগে নারীদের নৈতিক চরিত্রের মান উন্নত ছিল। পরকীয়া , বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক - ইত্যাদির কোন উল্লেখ বৈদিক সাহিত্যে নেই। গণিকাবৃত্তি প্রচলিত থাকলেও তারাও নৈতিক চরিত্রের অধিকারীনি ছিলেন এবং সামাজিক সম্মানের অধিকারীনি ছিলেন। 


পরবর্তী বৈদিক যুগের নারীদের মর্যাদাগত পরিবর্তন :-


পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীদের মর্যাদা বিশেষভাবে ক্ষুন্ন হয়। অধিকাংশ পিতামাতা কন্যার জন্মকে সানন্দে গ্রহণ করতেন না ,তারা পুত্র কামনা করতেন। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে স্পষ্টই বলা হয়েছে কন্যা পরিবারের দুঃখ নিয়ে আসে ; পুত্র পরিবারকে রক্ষা করে। অথর্ববেদে কন্যার জন্ম কে দুর্ভাগ্যজনক বলা হয়েছে। কন্যা পিতার বংশধারা রক্ষা করতে পারে না। তিনি তার পিতৃপুরুষদের জলও দিতে পারেন না। কন্যা যা পারেন না পুত্র অনায়াসে তা সম্পন্ন করতে পারেন ; উপরন্ত কন্যার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে পিতা-মাতার দুশ্চিন্তা থেকেই যায়। কন্যার জন্মের প্রতি পিতা-মাতার অনীহা পিছনে এই কারণগুলি নিহিত রয়েছে। এছাড়া নারীর সামাজিক অবমূল্যায়নের পিছনে কিছু অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ ছিল। কৃষির  বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে জীবিকার ক্ষেত্রে পুরুষের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় থেকেই নারীরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেন। তাদের পুরুষ নির্ভর জীবন শুরু হয়। আর্য পুরুষদের অনেকেই অনার্য নারীকে বিবাহ করতেন। এ ধরনের বিবাহকে সমাজ পরিপূর্ণ স্বীকৃতি দেয়নি। এর ফলে সাধারণভাবে সমাজে নারীর মর্যাদা হ্রাস পায়। মৈত্রায়ণী সংহিতায় নারীদের মদ ও পাশার মতো সর্বনাশা বলে নিন্দা করা হয়েছে। 

পরবর্তী বৈদিক যুগেও মেয়েদের সাধারণত একটু বেশি বয়সে বিবাহ হত। গৃহ্যসূত্র ও ধর্মসূত্রাদি গ্রন্থে বাল্য বিবাহের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এই গ্রন্থগুলির খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের পূর্ববর্তী নয়। তবে পুরুষ মহলে বহু বিবাহের প্রচলন নিঃসন্দেহে নারীজাতির সামাজিক মর্যাদাহানির  একটা প্রধান কারণ ছিল। মৈত্রায়ণী সংহিতায় মনুর দশ পত্নীর উল্লেখ আছে। রাজপরিবারে বহুবিবাহ প্রথা খুবই জনপ্রিয় হয়। সাধারণত একজন রাজার  কম করেও চারজন রানী ছিলেন। তাদের মধ্যে যিনি প্রধান তাকে মহিষী বলা হতো। যিনি স্বামীর প্রিয়তমা ছিলেন তিনি বাবাতা বলে গণ্য হতেন। যিনি অবহেলিত তিনি পরিবৃক্তি ও  চতুর্থ রানী পালাগলী নাম পরিচিতা হতেন। 
ঋকবেদের যুগে যেমন তেমনই এ যুগের প্রথমদিকে নারীকে স্বামীগৃহে মুখ্যত দুটি ভূমিকায় দেখা যেত --একদিকে যেমন তিনি পত্নীরূপে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় কাজে স্বামীকে সহায়তা করতেন ; অন্যদিকে তেমনি জায়ারূপে দাম্পত্যজীবনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন। কিন্তু পরবর্তী বৈদিক যুগে তার সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকারের পরিধি ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসে। গৃহের যে সকল ধর্মীয় কাজকর্ম একদিন তারই পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হতো সেসব কাজের দায়িত্ব ক্রমশঃ পুরোহিতের হাতে চলে যায়। মৈত্রায়ণী সংহিতায় বলা হয়েছে এই যুগে নারীরা সভায় যোগ দিতে পারতেন না। সভায় রাজনীতি , বিচারকার্য ও সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে আলাপ আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হত। সভায় যোগদানের অধিকার হারিয়ে ফেলায় নারীদের আর ঘরের বাইরে বৃহত্তর জীবনে কিছু করার থাকল না। ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য পরিবারের ছেলেদের উপনয়ন হতো। উপনয়ন মধ্য দিয়ে তারা দ্বিতীয় জন্ম লাভ করতেন এবং "দ্বিজ ''  বলে গণ্য হতেন। মেয়েরা উপনয়নের অধিকারী ছিলেন না। পুত্র ও কন্যা উভয়ের জন্যই জাতকর্ম , অন্নপ্রাশন -  ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। কিন্তু এক্ষেত্রেও  পুত্র ও কন্যাদের মধ্যে বৈষম্য করা হতো। পুত্রদের ক্ষেত্রে এই অনুষ্ঠানাদিতে বৈদিক মন্ত্র পাঠ হত , কিন্তু কন্যাদের ক্ষেত্রে মন্ত্র পাঠ নিষিদ্ধ ছিল। 

প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সে যুগে কয়েকজন নারী জ্ঞান ও গৌরবের উচ্চতম শিখরে আরোহণ করেছিলেন। এদের মধ্যে মৈত্রেয় ও গার্গি বাচক্লবীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গার্গী যাজ্ঞবল্কের সঙ্গে বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সূক্ষ্ম ও অন্তর্ভেদী প্রশ্ন তুলে তিনি যাগ্যবল্ক কে বিব্রত করেছিলেন। '' যেনাহং নামৃতা স্যাম কিমহং তেন  কুর্যাম '' অর্থাৎ যা আমাকে অমৃত দেবে না তা দিয়ে আমি কী করব -- যাজ্ঞবল্কের প্রতি মৈত্রেয়ীর এই উক্তি আজও বিখ্যাত হয়ে আছে।  ধনসম্পত্তি প্রত্যাখ্যান করে স্বামীর নিকট ব্রক্ষ্মজ্ঞান লাভের জন্যই প্রার্থনা জানিয়েছিলেন তিনি । তৈত্তিরীয় সংহিতা , মৈত্রায়ণী সংহিতা ও অথর্ববেদে সে যুগের নারীদের নৃত্যগীত অনুশীলনের কথা আছে। অথর্ববেদে সতীপ্রথার উল্লেখ আছে। তবে সে কালে বিধবা বিবাহেরও বিধান ছিল ফলে সতীপ্রথা সমাজে খুব একটা জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল বলে মনে হয় না। 




You May Also Like

0 comments