শিশু শ্রমিক সমস্যার কারণগুলি লেখ।

by - April 18, 2022

শিশু শ্রমিক সমস্যার কারণগুলি লেখ।  

ভারতে শিশু শ্রমিক প্রথার কারণগুলি আলোচনা কর। 

Causes of Child Labour in India. ( In Bengali ). 




ভারতে শিশু শ্রমিক সমস্যার কারণ :- 


ভারতের প্রায় ২৬ % মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করেন। যদিও সরকার প্রদত্ত এই তথ্য সঠিক নয় বলে অনেকে মনে করেন। ভারতে শিশু শ্রমিক বৃদ্ধির মূলে আছে এই দারিদ্রতা। বিশ্বের মোট শিশু শ্রমিকের ৩৩% বা এক - তৃতীয়াংশ ভারতে বাস করে এবং এই সংখ্যা প্রায় ১২৫ মিলিয়ন। এর মধ্যে ৭৯% গ্রামীণ এবং ২১% শহর এলাকার অন্তর্ভুক্ত। শিশু শ্রমিকের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলা যায় , যেসকল ঝুঁকিপূর্ণ , বিরক্তিকর কাজ বয়স্ক ব্যক্তিরা করতে চান না , সেই সকল কাজকে শিশুদেরকে দিয়ে অত্যন্ত সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে করিয়ে নেওয়া হয়। সাধারণতঃ ৬ - ১৪ বছর বয়স্ক শ্রমে নিযুক্ত শিশুদের শিশু শ্রমিক বলা হয়। শিশু শ্রমিকেরা সাধারণত যে সকল কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে সেগুলি হল - গৃহস্থালির কাজ , ইঁট ভাটা ও পাথর ভাঙার কাজ , চায়ের দোকান - হোটেল - রেস্তোরা - ইত্যাদির শ্রমসাধ্য কাজ , রাস্তায় খাবারের দোকানে কাজ , কুলি - হকার ইত্যাদির কাজ , বাজি তৈরী , কাঁচের ফ্যাক্টরিতে কাজ , মাদক - বাহক - ইত্যাদি বিভিন্ন কাজের সঙ্গে তাদের যুক্ত করা হয়। ভারতে শিশু শ্রমিকের বৃদ্ধি পাওয়ার বিভিন্ন কারণগুলি নীচে উল্লেখ করা হল - 


১. দারিদ্রতা :- 
ভারতে শিশু শ্রমিক বৃদ্ধির সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কারণ হল দারিদ্রতা। দারিদ্রতার অসহায়তা থেকে মুক্তি পেতে কেউ কেউ শিশু শ্রমিকের জীবন বেছে নেয় আবার অনেক ক্ষেত্রে দারিদ্রতার তাড়নায় অভিভাবকরাই তাঁদের সন্তানদেরকে শিশু শ্রমিক হতে বাধ্য করেন। কিন্তু দারিদ্রতার কারণে শিশুরা শ্রমের পথ বেছে নিলেও তাদের অবস্থার উন্নতি হয়না ; এবং তারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে প্রবাহিত হয়। 

২. নিরক্ষরতা :- 
ভারতে নিরক্ষরতা দূর করতে বহু কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও ভারতের বহু মানুষ আজও নিরক্ষরতার অন্ধকারে তলিয়ে আছেন। দেখা যায় যে , যেসকল শিশুরা শ্রমের সঙ্গে যুক্ত , তাদের অভিভাবকেরা সাধারণত নিরক্ষর হন। ফলে , নিরক্ষর অভিভাবকেরা শিক্ষালাভের তুলনায় আর্থিক রোজগারকেই অধিক যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন। তাই তাঁরা নিজেদের সন্তানকে শিক্ষালাভের পরিবর্তে বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত করেন। 


৩. জনসংখ্যা বৃদ্ধি :- 
ভারতে অত্যন্ত দ্রুত হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটছে। এই পরিস্থিতিতে দরিদ্র পরিবারগুলিতে একাধিক শিশু জন্ম নিলে সেই সকল শিশুর লালন - পালন অভিভাবকদের পক্ষে সম্ভব হয়না। তখন এই সমস্ত পরিবারের শিশুরা একটু বড় হলেই বা ৫/৬ বছর বয়স হলেই নিজেদের জীবিকার সাথে যুক্ত করছে বা অন্যান্য উপার্জনমুখী কর্মে নিযুক্ত করছে। 

৪. সরকারের দায়িত্ব :- 
সরকার দেশে প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কর্মসূচী গ্রহণ করেন ;কিন্তু বলা বাহুল্য যে এই সকল শিক্ষা পরিকল্পনাগুলি আশানুরূপ সফলতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। সরকার তার বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও রিপোর্টে শিক্ষার প্রসারের কথা বললেও বাস্তব অন্য কথা বলে। আজও ভারতে যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তাদের মধ্যে ৫০% শিশু প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি পার করতে পারেনা। 

৫. শিশু শ্রমিক প্রতিরোধ আইনের ব্যর্থতা :- 
ভারতীয় সংবিধানের ৪৫ নং ধারায় বলা হয়েছে ৬ - ১৪ বছর বয়সী শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক। এর পরিপ্রেক্ষিতে আরেকটি আইন প্রবর্তিত হয় এবং তাতে বলা হয় ১৪ বছর বয়সের বা তার নীচের শিশুদের কর্মে নিয়োগ করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। বাধ্যতামূলক শিক্ষার আইন কিছুটা কার্যকরী হলেও শিশু শ্রমিক প্রতিরোধ আইন সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এর প্রধান কারণ হল সরকারি উদাসীনতা। 


৬. অভিভাবকদের মানসিকতা  :- 
শিশু শ্রমিক সমস্যা দূর করতে সরকার যেসকল নীতি ও কর্মসূচী গ্রহণ করেন তার ব্যর্থতার একটি অন্যতম কারণ হল অভিভাবকদের মানসিকতা। যেসকল পরিবারগুলোতে মাথা পিছু গড় আয় কম সেই সকল পরিবারের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের কর্মে নিযুক্ত থাকাকেই লাভজনক বলে মনে করেন। বাধ্যতামূলক শিক্ষা বা অন্যান্য উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলি সম্পর্কে তারা ততটা আগ্রহ দেখান না। 

৭. সরকারি নীতি ও প্রকল্পের সীমাবদ্ধতা :- 
শিশু শ্রমিক সমস্যা দূর করতে সরকার কর্তৃক গৃহীত প্রকল্পগুলি প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। এইসকল প্রকল্পগুলিকে বাস্তবায়ন করতে যে পরিমান অর্থের প্রয়োজন হয় , তা'ও সঠিকভাবে বরাদ্দ হয়না। এছাড়া এইসকল কর্মূসূচিগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরীক্ষামূলক ; সেগুলির কোনো বিজ্ঞান সম্মত ভিত্তি নেই। আবার রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ সেগুলিকে সফল ভাবে বাস্তবায়ন করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। 

৮. প্রভাবশালী দুষ্টচক্র :- 
শিশু শ্রমিকদের নিয়োগ ও তাদের কর্মে লিপ্ত রাখার তাগিদে এক শ্রেণীর অসাধু দুষ্টচক্র সর্বদা ক্রিয়াশীল। নিজেদের স্বার্থে এই দুষ্টচক্র শিশুদেরকে সমস্তরকম ঝুঁকিপূর্ণ নিযুক্ত করতে পিছপা হননা। তাই অনেক সময় শিশুশ্রমিকেরা এই অতল অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেও - তা সম্ভব হয়না। এই দুষ্টচক্র - রাজনৈতিক নেতা , পুলিশ , আধিকারিক ও অন্যান্য সকল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অশুভ সম্পর্ক তৈরী করে শিশু শ্রমের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখে। 

পরিশেষে বলা যায় , ভারতে শিশু শ্রমিক সমস্যাটি আর্থ - সামাজিক পরিকাঠামোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। তাই এই সমস্যাটি ভারতীয় জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। সরকার ও চিন্তাশীল সমাজ শিশু শ্রমিকের সমস্যা দূর করতে চাইলেও , শিশু শ্রমিক ও তার পরিবার সমস্যাটি নিয়ে আদৌ ততটা চিন্তিত নন। তাই শিক্ষার বিস্তার ও সচেতনতার মাধ্যমেই ধীরে ধীরে সমস্যাটির সমাধান সম্ভব।      

       

You May Also Like

0 comments