তোমার মতে একজন শিক্ষকের কী কী গুণ থাকা উচিত ?

by - March 06, 2022

তোমার মতে একজন শিক্ষকের কী কী গুণ থাকা উচিত ?




অ্যারিস্টটল বলেছেন '' শিক্ষকেরা যাঁরা শিশুদের প্রকৃত শিক্ষা দেন তাঁরা পিতা মাতার থেকে বেশি সন্মানীয়। কেননা , প্রতিটি শিশুর সুস্থ ও সভ্য জীবন বিকাশে সাহায্য করেন শিক্ষক সমাজ। '' 
কোঠারি কমিশনের রিপোর্টেও বলা হয়েছে শিক্ষার অন্যান্য সকল উপাদানের মধ্যে শিক্ষকদের গুণাবলীর , যোগ্যতার ও দায়িত্ববোধের গুরুত্ব অপরিসীম। 


শিক্ষকের ব্যাক্তিগত গুণ বা যোগ্যতা :-


ব্যাক্তিগত গুণ বলতে সাধারণতঃ সেই গুণ বা বৈশিষ্টগুলিকেই বোঝানো হয়ে থাকে যেগুলো শিক্ষকের নিজস্ব ব্যাক্তিসত্তার অধীন। এই গুণগুলি শিক্ষককে শিক্ষাক্ষেত্রে সহায়তা করে। শিক্ষকের নিজস্ব এই গুনগুলোর কিছু অর্জিত ও কিছু জন্মগত। এই গুনগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হলো তাঁর ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন আদর্শ। এই জন্যই বলা হয় একজন সুশিক্ষক আদর্শ ব্যাক্তিত্বের অধিকারী হবেন। 

প্রথমতঃ -ডক্টর কে এল ক্লাপ আদর্শ ব্যাক্তিত্বের ১০ টি গুনের কথা উল্লেখ করেছেন যেমন - (১) উত্তম শরীর , (২) আশাবাদ , (৩) সংযত চরিত্র , (৪) উৎসাহ , (৫) ন্যায় পরায়ণতা , (৬) সততা , (৭) সহানুভূতি , (৮) প্রাণধর্মিতা , (৯) বিদ্যাবত্তা ও (১০) ছাত্রপ্রীতি। বস্তুতঃ এই সকল ব্যাক্তিগত গুণগুলি একজন সুশিক্ষকের পক্ষে আবশ্যক। 

দ্বিতীয়তঃ - আদর্শ শিক্ষকের পক্ষে তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও বিচরশৈলী একান্ত প্রয়োজন। ব্যাগলে ( Bagley ) ও কিথ (Keith)  বিভিন্ন ব্যাক্তিগত গুণের সঙ্গে সাংগঠনিক কৌশল , বিচক্ষণতা , উত্তম কণ্ঠস্বর ও নেতৃত্বদানের ক্ষমতার কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছেন। বস্তুতঃ শিশুদের আচরণকে মনোবিজ্ঞানসম্মত পথে পরিচালনা একজন সুশিক্ষকের উপরোক্ত গুণগুলি অপরিহার্য। 


তৃতীয়ত :- একজন সুশিক্ষকের দায়িত্ববোধ ( Sense of responsibility ) বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একজন দায়িত্বশীল শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের মধ্যে দায়িত্ববোধ জাগরিত করতে পারেন। 

চতুর্থতঃ - সুশিক্ষক হবেন প্রগতিশীল চিন্তার গ্রাহক , ধারক , বাহক ও রক্ষক। প্রকৃতপক্ষে তিনি নিত্য প্রবহমান ও পরিবর্তনশীল জীবনধারার প্রতীকস্বরূপ এবং এই ভাবধারা শিক্ষার্থীদের মধ্যেও সঞ্চারিত করবেন। 

পঞ্চমতঃ - সুশিক্ষকের একটি গুন হচ্ছে তাঁর প্রক্ষোভমূলক জীবনের পরিণমন যা সাধারণত তাঁর প্রক্ষোভিক ভারসাম্য থেকেই জন্মায়। 

ষষ্ঠত :- সুশিক্ষকের একটি মূল্যবান গুন হল উন্নত জীবনাদর্শবোধ। অধ্যাপক রাস্ক ( Rusk ) বলেছেন - একজন সুশিক্ষকের পক্ষে একটি সুস্পষ্ট জীবন দর্শনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। 

সপ্তমতঃ - সুশিক্ষকের জীবনের অপর বৈশিষ্ট হলো তাঁর স্বাধীন ও নিরপেক্ষ চিন্তার ক্ষমতা। বস্তুতঃ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই ক্ষমতা জাগাতে হলে সর্বাগ্রে শিক্ষককে সেই ক্ষমতার অধিকারী হতে হবে। 

অষ্টমতঃ - শিক্ষকের মধ্যে ত্যাগ ও সেবার মনোভাব থাকা একান্ত প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ এ সম্পর্কে বলেছেন - '' তবুও নানাপ্রকার প্রতিকূল অবস্থা স্বত্তেও অনেক শিক্ষক আছেন যাঁহারা দেনাপাওনার সম্পর্ক ছাড়াইয়া ওঠেন নিজেদের মাহাত্মগুনে। ''

নবমতঃ - সুশিক্ষকের জীবনের আর একটি বৈশিষ্ট হলো তাঁর জ্ঞানপিপাসা। তিনি অনন্ত জ্ঞানপিপাসু হয়ে বুদ্ধিদীপ্ত জ্ঞানের ভান্ডার বা জ্ঞানের উজ্জ্বল ধ্রুবতারা হিসেবে নিজেকে ভাস্বর করে তুলবেন। 
  
দশমত :- শিক্ষক হবেন সদা আনন্দময় ও স্বতঃস্ফূর্ততার প্রতীক।Sense of humor  হবে তাঁর চরিত্রের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট। এই বৈশিষ্ট শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃত মানুষ হওয়ার লক্ষ্যে অনুপ্রাণিত করবে।


শিক্ষকের পেশাগত গুণ বা যোগ্যতা :-


ব্যাক্তিগত গুণাবলী ছাড়াও একজন শিক্ষকের পেশাগত বৃত্তিতে স্বতন্ত্র বেশ কিছু গুন অর্জন করা খুবই প্রয়োজন। যেমন -

প্রথমতঃ - একজন সুশিক্ষকের পান্ডিত্য ও জ্ঞানই তাঁকে নিজস্ব বৃত্তিতে সাফল্য এনে দেয়। শুধু জ্ঞান থাকলেই চলে না - এর সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান সঞ্চালন দক্ষতাও একজন সুশিক্ষকের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজন। এজন্য একজন সুশিক্ষকের আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক মনোবিজ্ঞানসম্মত গতিশীল পদ্ধতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখা প্রয়োজন। 

দ্বিতীয়তঃ - একজন সুশিক্ষকের আর একটি বৈশিষ্ট হলো তাঁর পরীক্ষণলব্ধ শিক্ষন পদ্ধতি গ্রহণের ও ব্যবহারের মনোভাব। তিনি কেবল গতানুগতিক শিক্ষাপদ্ধতি অনুসরণ করবেন না , তিনি নিজস্ব বৃত্তিতে তাঁর প্রতিষ্ঠাকে স্থায়ী করার জন্য পরিস্থিতি অনুসারে শিক্ষাপদ্ধতি র পরিবর্তন ও পরিমার্জন করতেও সক্ষম হবেন। 

তৃতীয়তঃ - শিক্ষাপদ্ধতিকে বাস্তবধর্মী , মনোমুগ্ধকর , শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ও পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার তাগিদে সুশিক্ষককে বিভিন্ন ধরণের পদ্ধতি ও সহায়ক পদ্ধতিগুলি সম্পর্কে জ্ঞান রাখতে হবে। আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতির মূল কথা , Teach through the senses মেনে একজন সুশিক্ষককেই বিমূর্ত জ্ঞানকে ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য করে তুলতে পারেন।
 
চতুর্থতঃ - একজন সুশিক্ষকের মূল্যায়ন সম্পর্কেও জ্ঞান থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। শিশুদের বিকাশের ক্রমিক ধারা অনুশীলন করার জন্য কিভাবে সর্বাত্মক পরিচয়লিপি ব্যবহার করতে হবে সে সম্পর্কেও বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। 

পঞ্চমতঃ - একজন সুশিক্ষকের পক্ষে সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী সম্পর্কেও জ্ঞান রাখা প্রয়োজন। এই সমস্ত সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা অর্জন করার মধ্যেই একজন সুশিক্ষকের বৈশিষ্ট লুকিয়ে থাকে। 

ষষ্ঠত :- শিক্ষকের অন্যতম পেশাগত বৈশিষ্ট হিসেবে তাঁর উদার দৃষ্টিভঙ্গি , পক্ষপাতহীনতা , ব্যেক্তিপার্থক্য বুঝে শিক্ষাপ্রণালী রচনা করার যোগ্যতা , অর্থবহ উপদেশ প্রদান - ইত্যাদি গুণগুলি থাকা বাঞ্চনীয়।
 
পরিশেষে বলা যায় , শিক্ষার্থীর প্রকৃত পথপ্রদর্শক হিসেবে একজন সুশিক্ষক সর্বদা শিক্ষালয় ও শিক্ষা প্রক্রিয়াকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার কাজে সচেষ্ট থাকেন এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে  কাম্য ও বাঞ্ছিত আচরণধারা মূর্ত করে তুলতে সদাব্যস্ত থাকেন।  

You May Also Like

0 comments