কুষাণ শাসনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব ; political and cultural significance of kushana dynasty .
ভারতে কুষাণ শাসনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব আলোচনা করো।
ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে পার্থিয়া বা পল্লবদের পরাস্ত করে কুষানরা উক্ত অঞ্চলে প্রাধান্য স্থাপন করে। ভারতীয় জনজীবনে কুষাণদের প্রভাব সম্পর্কে পুরাণ ও মহাকাব্যে কিছু উল্লেখ পাওয়া যায়। কুষাণদের আগমনে ভারতীয় সংস্কৃতি এক ভিন্ন মাত্রা লাভ করে। এই সময় থেকেই ভারতীয় সংস্কৃতি মিশ্র সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে , মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর সমগ্র ভারত জুড়ে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল , কুষাণ সম্রাটরা সেই রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করেন এবং রাজশক্তিকে শক্তিশালী ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেন।
The Kushana period marks as important approach in Indian History . - Dr Dinesh Chandra .
কুষাণযুগ সম্পর্কিত ঐতিহাসিক উপাদান :-
কুষাণ রাজত্বকাল সম্পর্কে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য উপাদান হল চৈনিক গ্রন্থাদি। চৈনিক গ্রন্থাদি থেকে ইয়ো - চি জাতির ভারত আগমনের বিবরণ পাওয়া যায়। কুষাণ আমলের মুদ্রা কুষাণ রাজাদের কালনিরূপন ( Chronology ) ও তাঁদের ধর্ম সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। যেমন - ( ক ) দ্বিতীয় কদফিসেসের মুদ্রা থেকে জানা যায় যে তিনি শিবের উপাসক ছিলেন। ( খ ) কণিষ্কের মুদ্রায় বহু দেবদেবীর ছবি থেকে প্রমাণিত হয় ধর্ম সম্পর্কে তিনি ছিলেন উদার।
পান - কু রচিত ' প্রথম হান বংশের ইতিহাস ' , ফ্যান - ই রচিত ' হোউ - হান - সু ' , তোয়ান লিনের রচিত ' বিশ্বকোষ ' - প্রভৃতি চৈনিক গ্রন্থাদি কুষাণ বংশের ইতিহাস জানার প্রধান উপাদান।
এছাড়াও , নাগার্জুন রচিত ' মধ্যমিকা সূত্র ' , অশ্বঘোষ রচিত ' বুদ্ধচরিত ' - ইত্যাদি গ্রন্থগুলি থেকেও কুষাণ সাম্রাজ্যের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়।
কুষাণদের রাজনৈতিক পরিচয় : -
শক - পহ্লবদের পরে কুষাণরা ভারতে রাজ্য স্থাপন করেন। কুষাণদের মোট পাঁচটি শাখা সম্পর্কে জানা যায় - 1. হিউ - মি , 2. কুই সাং , 3. হি - থুম , 4. চুং - মো , 5. কাও - ফু। কিন্তু ভারতে কুষাণরা ইয়ো - চি নামে পরিচিত হয়ে যাযাবর জাতি হিসেবে ভারতে প্রবেশ করে। ইয়ো - চি দের আদিম বাসভূমি ছিল চিনের কান - সু প্রদেশ।
অক্ষু - উপত্যকায় বসতি স্থাপন করার প্রায় একশো বছর পরে , প্রথম শতকে , কুষাণ নায়ক কুজুল কদফিসেস অন্যান্য শাখাগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে ' ওয়াং ' অর্থাৎ রাজা উপাধি ধারণ করেন। এইভাবে ভারতে কুষাণ সাম্রাজ্যের ভিত্তি রচিত হয়।
রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা :-
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। তীব্র রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ভারতীয় ঐক্য বিনষ্ট করে। কিন্তু কুষাণ সম্রাটরা এই অনিশ্চয়তা দূর করে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। যেহেতু কুষাণ যুগে রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর হয় , সেহেতু , এইযুগেই সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা হয়। শিক্ষা , শিল্পকলা , স্থাপত্য , ধর্ম - ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে উৎকর্ষতার বিস্তার ঘটে।
The age of the great Kushanas is of great cultural signification in the history of India . - B. G. Gokhle .
রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমন্বয় :-
কুষাণ যুগে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের ধারা দেশের সীমা অতিক্রম করে রোম , দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়া ও দূরপ্রান্তে প্রসারিত হয়। কুষাণ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে ভারতীয় সভ্যতার মিলন ঘটে। ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে কুষাণ সংস্কৃতির মেলবন্ধন এক উদার ও সমন্বয়ী সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল।
কুষাণ সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট ছিল সাঙ্গীকরণ। বিভিন্ন ধর্ম - বর্ণের মানুষকে তারা একই সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিল। ফলে , সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সমন্বয় সাধিত হয়। কুষাণ সাম্রাজ্যের অবসানের পরও সেই ধারা অব্যাহত থাকে।
সাম্রাজ্যের বিস্তার :-
কুষাণ বংশের সম্রাটগণ বিশেষ করে কণিষ্ক একের পর এক নতুন রাজ্য জয় করেন।
(ক ) কলহন রচিত ' রাজতরঙ্গিনী ' গ্রন্থ থেকে জানা যায় , কাশ্মীর কুষাণ সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল।
(খ ) হিউয়েন সাং এর মতে , গান্ধার কুষাণ সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল।
(গ ) চিনা ও বৌদ্ধ মতে , অযোধ্যা , পূর্ব - ভারত , পাটলিপুত্র - ইত্যাদি কণিষ্কের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল।
(ঘ ) আলবিরুনির মতে , আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার বহু অঞ্চল কণিষ্কের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল।
(ঙ ) শক - ক্ষত্রপ নহপানকে পরাজিত করে কণিষ্ক সৌরাষ্ট্র ও মালবের উপর আধিপত্য বিস্তার করেন।
(চ ) তিনি মধ্য এশিয়ার কাশগড় , খোটান , ইয়ারখন্দ , সমরখন্দ - জয় করেন।
সাম্রাজ্যের পরিধি :-
ভারতের এক বিরাট অংশে কুষাণরা রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন। কণিষ্কের সাম্রাজ্য উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বত ; পশ্চিমে সিন্ধুনদ থেকে পূর্বে বিহার পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। ভারতের বাইরে অক্ষু উপত্যকা , কাবুল , কান্দাহার , বেলুচিস্তান , আফগানিস্তান - কণিষ্কের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। তাঁর রাজধানী ছিল পুরুষপুর বা পেশোয়ার।
বহির্বিশ্ব ও ভারতের সাংস্কৃতিক আদান - প্রদান :-
কুষাণ আমলে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম কণিষ্ক মধ্য এশিয়ার কাশগড় , খোটান , চিন , জাপান প্রভৃতি দেশে ভারতীয় সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মধ্য এশিয়ায় ভারতীয় উপনিবেশের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে। কুষাণ রাজাদের উদ্যোগেই মধ্য এশিয়ার উপজাতীয় মানুষ বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে ভারতীয় সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসতে পারে। কুষাণ সম্রাটদের উদ্যোগেই মধ্য ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ গড়ে ওঠে।
শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা :-
কণিষ্ক শিল্প ও সাহিত্যের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর আমলে বহু উৎকৃষ্ট গ্রন্থাদি রচিত হয়। তাঁর রাজসভায় বহু পন্ডিত ব্যক্তি অবস্থান করতেন। যেমন - '' বুদ্ধচরিত '' এর রচয়িতা অশ্বঘোষ , বৈজ্ঞানিক নাগার্জুন , চরক - প্রমুখ। এই যুগেই রচিত হয়েছিল বুদ্ধচরিত , সূত্রালঙ্কার , বজ্রসূচি , মহাভিভাষ্য - ইত্যাদি জ্ঞানসমৃদ্ধ গ্রন্থগুলি। এই সকল মনীষী ও তাঁদের রচনা সাহিত্য ক্ষেত্রে এক যুগান্তর এনেছিল।
কণিষ্কের আমলে শিল্প - স্থাপত্য উৎকৃষ্টতার শিখরে পৌঁছেছিল। এই যুগে গ্রিক - রোমান - বৌদ্ধ শিল্পকলার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছিল যা '' গান্ধার শিল্প '' নামে পরিচিত। অমরাবতী , কৃষ্ণা প্রভৃতি নদীর উপত্যকায় প্রাপ্ত স্থাপত্য স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের নিদর্শন , মথুরায় প্রাপ্ত কণিষ্কের মস্তকবিহীন মূর্তি , তক্ষশীলা ও কাশ্মীরের নিকটে কণিষ্কপুর প্রভৃতি নগর - সে যুগের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলে বিবেচিত হয়।
0 comments