মার্কসবাদের মূল সূত্রগুলি আলোচনা কর। মার্কসবাদের মৌলিক উপাদানগুলি কী কী ?

by - August 05, 2025

মার্কসবাদের মূল সূত্রগুলি আলোচনা কর। 

মার্কসবাদের মৌলিক উপাদানগুলি কী কী ? আলোচনা কর। 




মার্কসবাদের মূল সূত্র / মৌলিক উপাদান :-


মার্কসবাদের মূল সূত্র বা মৌলিক উপাদানগুলি হল - 
A. দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ 
B. ঐতিহাসিক বস্তুবাদ 
C. উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব 
D. শ্রেণিসংগ্রাম 
E. রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্ব 
F. বিপ্লব সম্পর্কিত তত্ত্ব। 

A. দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ :- 

মার্কসবাদীরা মনে করেন জগৎ দ্বন্দ্ব এবং বস্তুর সমাহার। সমাজের ঘটনাপ্রবাহ , সমাজ বিবর্তন সবকিছুই হল দ্বন্দ্বমূলক এবং বস্তুজগতের ব্যাখ্যা হল বস্তুমূলক। তাই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হল দ্বন্দ্ব ও বস্তুর সমষ্টি। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে দুটি ভাগে আলোচনা করা যেতে পারে - দার্শনিক দিক ও পদ্ধতিগত দিক। 

দার্শনিক দিক : দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের দার্শনিক দিক জগৎকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণ করে। এক্ষেত্রে মার্কসবাদীরা কার্য - কারণ তত্ত্বে বিশ্বাসী। তাঁরা মনে করেন প্রকৃতি বা সমাজের যেকোনো ঘটনার পেছনে নির্দিষ্ট কারণ দায়ী থাকে। আবার , কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা বা পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। প্রাণী ব্যতীত জগৎ সংসারের সবকিছুই মন - নিরপেক্ষ এবং মানুষ এই মন - নিরপেক্ষ বস্তু জগতের সকল তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম। 

পদ্ধতিগত দিক : পরিবেশ ও মানব সমাজের পরিবর্তন ও বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করার জন্য মার্কসবাদীরা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ তত্ত্ব প্রয়োগ করেন। এই পদ্ধতি অনুসারে মার্কসবাদীরা মনে করেন প্রতিটি বস্তু ও মানুষের জন্ম , প্রসার ও ধ্বংস নিশ্চিত ; তাই কোনোকিছুই স্থিতিশীল নয়। বিবর্তন ও দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে সবকিছুরই পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয় এবং এই পরিবর্তনের মূল কারণ হল অন্তর্দ্বন্দ্ব। তাই মার্কসবাদের আলোচনা এই দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। 


B. ঐতিহাসিক বস্তুবাদ :- 

ঐতিহাসিক বস্তুবাদ  সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে সমাজের অন্যতম কাঠামো হিসাবে বিবেচনা করে। মার্কসবাদীরা মনে করেন , অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপরেই দাঁড়িয়ে থাকে রাজনীতি , সংস্কৃতি , শিল্প - সাহিত্য , আইন ও বিচার , ধর্ম - যাবতীয় সবকিছুই। 

মার্কসবাদীরা মনে করেন সমাজ পরিবর্তনের মূল কারণ হল - উৎপাদন শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্ব। আদিম সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তি মালিকানার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু ক্রমে সমাজে ব্যক্তি মালিকানার উদ্ভব ঘটে , সামন্ততান্ত্রিক যুগ শুরু হয় এবং শ্রেণী শোষণের সূচনা হয়। এরপর পুঁজিবাদী সমাজে মালিক ও শ্রমিকের দ্বন্দ্ব সমাজ পরিবর্তনের মূল উপাদান হিসাবে কাজ করে। এইভাবে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সাহায্যে মার্কসবাদীরা দেখিয়েছেন  সমাজ পরিবর্তনের মূল উপাদান হল দ্বন্দ্ব। 

C. উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব :-

উদ্বৃত্ত সংক্রান্ত বিষয়টির  সূচনা ঘটে সমাজে ব্যক্তি মালিকানার সূচনার পর থেকে। উদ্বৃত্ত মূল্যের বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ এবং পরবর্তীকালে পুঁজিবাদী সমাজে শ্রেণী শোষণ চলতে থাকে। কৃষক ও শ্রমিকেরা যা উৎপাদন করে তাতে তাঁদের কোনো অধিকার থাকেনা ; তাদেরকে সামান্য কিছু মজুরি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। অন্যদিকে উদ্বৃত্ত পণ্যের মুনাফা সম্পূর্ণরূপে ভোগ করে মালিক সমাজ। একদিকে মালিক শ্রেণী মুনাফার পাহাড়ে বসে থাকে এবং অন্যদিকে কৃষক ও শ্রমিক থাকে সর্বদা বঞ্চিত। 
এইভাবে পুঁজিপতি ও মালিকের  বিরুদ্ধে কৃষক ও শ্রমিকের ক্ষোভ জন্মে এবং সমাজে দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। এই দ্বন্দ্বের ফলে ক্রমশঃ সমাজে পরিবর্তন সাধিত হয়।   

D. শ্রেণিসংগ্রাম :-

শ্রেণী বলতে লেনিন বুঝিয়েছেন একটি নির্দিষ্ট আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় পৃথক পৃথক অবস্থানকারী ব্যক্তিবর্গ। মার্কসবাদের শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্বের মূল বিষয় হল - সুবিধাভোগী ও সর্বহারা শ্রেণীর একই আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় পৃথক পৃথক অবস্থান। 

কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো গ্রন্থে মার্কস - এঙ্গেলস দাবী করেছেন - আজ পর্যন্ত যতগুলি সমাজ দেখা গেছে সেই সকল সমাজের ইতিহাস হল শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে সমাজ দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে ; এরপর পুঁজিবাদী সমাজে মালিকের হাতে শ্রমিক শোষিত হতে থাকে। ফলে উভয় শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্বের উদ্ভব ঘটে যা জন্ম দেয় শ্রেণী সংগ্রামের। পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় , সমাজের প্রতিটি স্তরে যা পরিবর্তন এসেছে - তার মূলে আছে শ্রেণী সংগ্রাম। 

মার্কসবাদীরা মনে করেন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বঞ্চনার কারণে যেসকল শ্রেণিসংগ্রাম সংগঠিত হয় তার দ্বারা সম্পূর্ণভাবে সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। কেননা , এই ধরণের আন্দোলনকে উৎখাৎ করতে মালিক শ্রেণী বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে পারে। তাই মার্কসবাদীরা শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক শ্রেণীসংগ্রামের উপর গুরুত্ব প্রদান করেছেন।    


E. রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্ব :- 

মার্কসবাদীদের মতে , রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে নির্দিষ্ট কার্য - কারণের ভিত্তিতে। মার্কসবাদীরা রাষ্ট্রকে মূলতঃ বলপ্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে মনে করেন। এক্ষেত্রে শাসক শ্রেণী শোষিতের উপর সর্বদা বলপ্রয়োগ করে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে। এ প্রসঙ্গে এঙ্গেলস বলেছেন - রাষ্ট্র হল একটি সর্বাধিক শক্তিশালী সংগঠন যা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভুত্ব বিস্তার করে কায়েমী স্বার্থ চরিতার্থ করে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজ থেকে আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ - সর্বত্রই দেখা যায় রাষ্ট্রযন্ত্রকে হাতিয়ার করে সুবিধাভোগী ও মালিক শ্রেণীর প্রতিনিধিরা বঞ্চিত ও সর্বহারারদের শোষণ করে। 

তাই মার্কসবাদীদের মতে , সমাজে শোষণের অবসান ঘটাতে গেলে সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা একান্ত প্রয়োজন। সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে শ্রমিক শ্রেণীর ঐকবদ্ধ বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ সরাসরি প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। পুঁজিবাদী ও বুর্জোয়া রাষ্ট্রের অবসান ঘটে প্রতিষ্ঠিত হবে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র। 

মার্কসবাদীরা বলেন , প্রকৃত সাম্যবাদী সমাজে অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে সকলে শ্রেণী শোষণের কোনো অবকাশ থাকবে না। তার ফলে শ্রেণী শোষণের যন্ত্র হিসাবে রাষ্ট্রের অবলুপ্তি ঘটবে। 

F. বিপ্লব সম্পর্কিত তত্ত্ব :-

সামাজিক ক্ষেত্রে বিপ্লব এমন একটি প্রক্রিয়া যার ফলে পুরাতন সমাজ ব্যবস্থার অবসান ঘটে এবং নতুন সমাজের সূচনা হয়। বিপ্লবের কারণ হিসাবে মার্কসবাদীরা উৎপাদন - শক্তির সঙ্গে উৎপাদন - সম্পর্কের দ্বন্দ্বকেই দায়ী করেছেন। লেনিন বিপ্লবের শর্ত হিসাবে Objective ও Subjective এই দুই শর্তের উল্লেখ করেছেন। মার্কস বিপ্লবের পূর্বে বৈপ্লবিক পরিস্থিতির গুরুত্বের কথা বলেছেন। মার্কসের মতে , এই বৈপ্লবিক পরিস্থিতি সংগঠিত হয় সাধারণত তিনটি কারণে - (ক ) সমাজে সমস্যার চূড়ান্ত আত্মপ্রকাশ (খ) সমাজে দারিদ্রতা , বেকারত্ব , অশিক্ষা চূড়ান্ত আকার ধারণ করবে এবং (গ ) উক্ত পরিস্থিতির ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সমাজ পাল্টে দেওয়ার মানসিকতা তৈরী হবে। 

অন্যদিকে Subjective বা বিষয়ীগত অবস্থা হল - জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা , বিপ্লবী চেতনা , গণশক্তির বিকাশ , নেতৃত্ব প্রদানকারী গণসংগঠনের উপস্থিতি। লেনিন বলেছেন - বিপ্লবকে সার্থক করে তুলতে হলে বিষয়গত পরিস্থিতির সঙ্গে বিষয়ীগত পরিবেশের যথার্থ মেলবন্ধন প্রয়োজন। 

আবার প্রলেতারিয়েত ও সর্বহারারদের বিপ্লবকে ধ্বংস করে দেবার জন্য শাসক ও সুবিধাভোগীরা সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগ করবে ; রাষ্ট্রশক্তিকে প্রয়োগ করে তারা বিপ্লব দমন করতে চাইবে। তাই মার্কস মনে করেন সংগঠিত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছাড়া সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। 

পরিশেষে বলা যায় , মার্কসবাদের সমালোচক সাধারণতঃ বুর্জোয়া , পুঁজিবাদের সমর্থক দক্ষিণপন্থীরা। কিন্তু পৃথিবীর সর্বত্র আজও শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক , শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক , সর্বহারা ও সুবিধাভোগীর সম্পর্ক - ইত্যাদি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মার্কসবাদের গুরুত্ব অপরিসীম। আধুনিক সময়কালেও মার্কসের প্রাসঙ্গিকতা তাই বিশ্বজুড়ে অনুভূত হয়। মার্কসবাদ শোষিত মানুষকে বিপ্লব ও সাম্যবাদী সমাজের যে পথ দেখিয়েছেন -তা আজও শোষিত ও সর্বহারাদের মুক্তির পথ প্রদর্শন করে।    

You May Also Like

0 comments