মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্ত্বটি আলোচনা কর।

by - August 07, 2025

মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্ত্বটি আলোচনা কর। 




ঐতিহাসিক বস্তুবাদ :- 


মার্কস সমাজের ঐতিহাসিক বিবর্তনের সূত্র ধরে সমাজে দ্বন্দ্বের অবস্থান এবং তার ফলে সামাজিক পরিবর্তনের বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি ঐতিহাসিক বস্তুবাদ নামে পরিচিত। মার্কসের মতে , ইতিহাসের কোনো ঘটনা পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয় , তাদের মধ্যে নিবিড় যোগসূত্র বর্তমান। প্রতিটি ঘটনা এবং তার প্রতিক্রিয়া সমাজে গভীর প্রভাব সৃষ্টি করে। যার ফলে সমাজে সাধিত হয় পরিবর্তন। 

মার্কস সমাজ ও সামাজিক পরিবর্তনের মূল আধার হিসাবে উৎপাদন ব্যবস্থাকে চিহ্নিত করেছেন। জীবনে বেঁচে থাকার জন্য যা যা কিছু প্রয়োজন তার কিছুটা মানুষ প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করে এবং বাকীটা উৎপাদন করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাহিদা পাল্টেছে এবং তার সঙ্গে পাল্টেছে উৎপাদন ব্যবস্থা। মার্কস এই উৎপাদন ব্যবস্থাকেই সমাজ পরিবর্তনের মূল হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। অর্থনীতি ও উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত থাকে - রাজনীতি , সংস্কৃতি , শিল্প - সাহিত্য , শিক্ষা - ইত্যাদি সবকিছুই। মার্কসবাদীরা এই পরিবর্তনশীল ইতিহাস ও বস্তুবাদকে সমাজ পরিবর্তনের মূল প্রতিপাদ্য হিসাবে বিবেচনা করেছেন - এই দৃষ্টিভঙ্গিই ঐতিহাসিক বস্তুবাদ নামে পরিচিত। 

উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক :- 

মার্কস উৎপাদনের দুটি দিক চিহ্নিত করেছেন - একটি হল উৎপাদিকা শক্তি (forces of production) ও অপরটি হল উৎপাদন সম্পর্ক (relation of production)। উৎপাদন শক্তি হল উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক এবং তাদের শ্রম ক্ষমতা , মূলধন ও বিভিন্ন যন্ত্র , কারিগরি দক্ষতা ইত্যাদি। অন্যদিকে উৎপাদন সম্পর্ক হল - উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মানুষে মানুষে ও শ্রেণীতে শ্রেণীতে পারস্পরিক সম্পর্ক। 

মার্কস বলেছেন , উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের পারস্পরিক সঙ্গতির ভিত্তিতেই উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গতি বিনষ্ট হয়। ফলে সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে ওঠে। তাই মার্কস উৎপাদন ব্যবস্থাকেই সমাজ পরিবর্তনের মূল ভিত হিসাবে উল্লেখ  করেছেন।    

সমাজের ভিত ও উপরিকাঠামো :- 

মার্কস মনে করেন , অর্থনীতি ও উৎপাদন ব্যবস্থা হল সমাজের ভিত বা সবকিছুর মূল। সমাজের অন্যান্য উপাদানগুলি - যেমন - রাজনীতি , শিক্ষা , শিল্প - সংস্কৃতি , সাহিত্য - ইত্যাদি সবকিছু অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকে। অর্থনৈতিক  ব্যবস্থার পরিবর্তন হলে তার উপরিকাঠামো অর্থাৎ অন্যান্য সবকিছুর পরিবর্তন সাধিত হয়। 


ঐতিহাসিক বস্তুবাদের নিরিখে উৎপাদনের বৈশিষ্ট :- 


(ক ) উৎপাদনে গতিশীলতা : স্তালিনের মতে , মানুষের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদন ব্যবস্থা সদা পরিবর্তনশীল। উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তনের সূত্র ধরে সমগ্র রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাতে পরিবর্তন সাধিত হয়। 

(খ ) উৎপাদন শক্তির সচলতা : উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক এবং তাদের শ্রম ক্ষমতা , মূলধন ও বিভিন্ন যন্ত্র , কারিগরি দক্ষতা ইত্যাদি হল উৎপাদন শক্তি। উৎপাদনে গতিশীলতা আনে উৎপাদন শক্তি। তাই উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটাতে ও সেই পরিবর্তন অব্যাহত রাখতে উৎপাদন শক্তিকেও সচলতা বজায় রাখতে হয়। 

(গ ) উৎপাদন শক্তির বৈপ্লবিক প্রকৃতি : মার্কস বলেছেন সমাজে উদ্ভুত বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতির সাপেক্ষে উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে বিরোধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। উৎপাদন সম্পর্ক যখন উৎপাদিকা শক্তির সহায়ক না হয়ে বিরোধী হয়ে ওঠে তখন উৎপাদন শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে সামাজিক বিপ্লবের সূচনা ঘটায়। 

(ঘ ) শ্রেণীর উদ্ভব : উৎপাদন ব্যবস্থার হাত ধরে সমাজে শ্রেণিভেদের উদ্ভব ঘটে। মার্কস মূলতঃ দুই ধরণের শ্রেণীর কথা বলেছেন। যেমন সামন্ততান্ত্রিক সমাজে ভূমিদাস ও ভূস্বামী শ্রেণী এবং তার পরবর্তীকালে আধুনিক শিল্প সমাজে মালিক ও শ্রমিক শ্রেণী। একদল সর্বদা নিজ অধিকার হতে বঞ্চিত এবং অপর দল সর্বদা সুবিধাভোগী শ্রেণী হিসাবে সমাজের সকল প্রকার সুবিধা ভোগ করে। 

(ঙ ) পুরাতন উৎপাদন ব্যবস্থাকে ভিত্তি করে উৎপাদন শক্তির বিকাশ : সমাজে উৎপাদন শক্তির বিকাশ ঘটে পুরাতন উৎপাদন ব্যবস্থাকে ভিত্তি করে। পুরাতন ব্যবস্থার সঙ্গে ক্রমান্বয়ে যুক্ত হয় আধুনিক উদ্ভাবন ও নিত্য নতুন প্রযুক্তি। মানুষের চাহিদা নতুন নতুন সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত করে। পুরাতন সমাজে প্রচলিত দ্বন্দ্ব , শ্রেণীবৈষম্য ও শ্রেণীশোষণ বিপ্লবের পথকে প্রশস্ত করে। 

এইভাবে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মাধ্যমে মার্কস দেখিয়েছেন ঐতিহাসিকভাবে  সমাজের বিবর্তন মূলতঃ উৎপাদন  ব্যবস্থার পরিবর্তনের ফসল। উৎপাদন ব্যবস্থা সমাজের বস্তুবাদী সকল উপাদানের উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং এর ফলে গড়ে ওঠে শ্রেণীদ্বন্দ্ব - যা কালক্রমে বিপ্লবের রূপ নিয়ে সমাজকে পরিবর্তন করে। 

ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সীমাবদ্ধতা / সমালোচনা :- 


বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সমালোচনা করা হয়। যেমন - 

(ক ) মার্কস অর্থনীতিকে সমাজের একমাত্র একক হিসাবে গণ্য করেছেন। কিন্তু সমাজের অন্যান্য সাংস্কৃতিক , ভাষাগত , ধর্ম , রাজনীতি - ইত্যাদি উপাদান গুলিও কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেননা , ইতিহাস পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে শুধুমাত্র অর্থনীতি একমাত্র কারণ হিসাবে কাজ করেনা। যেমন ভারতে মুসলিম আক্রমণ বা কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন - ইত্যাদি বিষয়গুলির সঙ্গে অর্থনীতির তুলনায় ধর্মীয় কারণ অনেক বেশি দায়ী ছিল। 

(খ ) কাঠামো ও উপরিকাঠামো তত্ত্বের সমালোচনা : মার্কস ঐতিহাসিক বস্তুবাদের আলোচনায় অর্থনীতিকে সমাজের কাঠামো এবং অন্যান্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানগুলিকে সমাজের উপরিকাঠামো হিসাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সমালোচকেরা মনে করেন - এই ধারণা সর্বাংশে সঠিক নয়। কেননা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সমাজকে প্রভাবিত করে ঠিকই , কিন্তু সমাজও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। 

(গ ) অর্থনীতি  সমাজের একমাত্র নিয়ন্ত্রক নয় : মার্কস একমাত্র অর্থনৈতিকভাবে বলশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে সমাজর মূল নিয়ন্ত্রক বলে দাবী করেছেন। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে অর্থনীতি সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন ধারণা সঠিক নয়। কেননা মধ্যযুগে পোপের সর্বময় ক্ষমতার সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক ছিল নগন্য। এছাড়াও আধুনিক বিশ্বের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর ঠান্ডা লড়াই ছিল কেবলমাত্র আদর্শগত সংঘাত , সেখানে অর্থনৈতিক কোনো প্রভাব ছিল না। 

(ঘ ) পরিবর্তন সম্পর্কে  অসম্পূর্ণ ব্যাখ্যা : সমালোচকদের মার্কস সামাজিক ও অর্থনৈতিক উপাদানগুলির পরিবর্তনের কথা বললেও কীভাবে অর্থনৈতিক উপাদানগুলি সামাজিক উপাদানগুলির পরিবর্তন ঘটায় - তার  কোনো রূপরেখা মার্কস প্রদান করেননি। তাই কোনো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে অসম্পূর্ন বলে দাবী করেন। 

পরিশেষে বলা যায় যে , ঐতিহাসিক বস্তুবাদের বিরুদ্ধে সমালোচকেরা যেসকল অভিযোগ এনেছেন তা সত্য নয়। কেননা , প্রথমতঃ - আদিম সমাজ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে যেসকল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে - তত্ত্বগতভাবে বিচার করলে দেখা যাবে প্রতিটি পরিবর্তনের জন্য অর্থনীতি তার প্রভাব বিস্তার করে।      
দ্বিতীয়তঃ - মার্কস এবং এঙ্গেলস কখনোই অর্থনীতিকে সমাজের একমাত্র চালিকাশক্তি বলেননি। তাঁরা অন্যান্য উপাদানগুলিরও গুরুত্ব স্বীকার করেছেন এবং অর্থনীতিকে মূল উপাদান বলেছেন।    

You May Also Like

0 comments