পল্লবদের শিল্প , স্থাপত্য ও সাহিত্য ; art and architecture of pallavas

by - July 31, 2021

পল্লব কারা ? পল্লবদের শিল্প , স্থাপত্য ও সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করো। 

অথবা , ভারতের শিল্প , স্থাপত্য ও সাহিত্যে পল্লবদের অবদান আলোচনা করো। 




পল্লবদের শিল্প , স্থাপত্য ও সাহিত্য :- 

পল্লব রাজারা শিল্প , সাহিত্য , স্থাপত্য , ভাস্কর্য - ইত্যাদির পরম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। দক্ষিণ ভারতে পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্প সর্বাধিক প্রাচীন। দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পরীতি পল্লবরাই সর্বপ্রথম প্রবর্তন করেন। Grousett এর মতে , পল্লবরা তাঁদের নিজস্ব স্থাপত্য শিল্প - রীতির সৃষ্টি করে দক্ষিণ ভারতীয় শিল্প রীতির ভিত্তি রচনা করেন। ( They created an architecture of their own which was to be the basis of all the styles of the South .


পল্লব স্থাপত্যরীতি :- 

দুই ধরণের রীতি অনুসরণ করে পল্লবদের মন্দির - স্থাপত্য কলা গড়ে ওঠে - ( ক ) পাথর কেটে মন্দির নির্মাণ , ( খ ) সৌধ আকারের মন্দির নির্মাণ। পল্লব স্থাপত্য রীতির অপর বৈশিষ্ট হল রথ আকারে দেবালয়ের নির্মাণ। পল্লব শিল্পরীতিকে রাজাদের নামানুসারে চারটি পৃথক রীতিতে ভাগ করা যায় - 

১. মহেন্দ্র রীতি 
পল্লব রাজা মহেন্দ্রবর্মনের আমলে গড়ে ওঠে মহেন্দ্র রীতি। একেশ্বরনাথের মন্দির এই শিল্পরীতির নিদর্শন। পাহাড় কেটে বৌদ্ধ মন্দিরের অনুকরণে মন্দির নির্মাণ ছিল এই রীতির বৈশিষ্ট। 

২. নরসিংহবর্মন রীতি 
দ্বিতীয় নরসিংহ বর্মনের আমলে গড়ে ওঠে নরসিংহবর্মন রীতি। সমুদ্রতীরের মন্দিরগুলি এই রীতির নিদর্শন। কাঞ্চীর কৈলাসনাথ মন্দির এর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। 

৩. রাজসিংহ রীতি 
রাজা রাজসিংহবর্মনের আমলে গড়ে ওঠে রাজসিংহ রীতি। মহাবলীপুরমের পুরো একটি পাহাড় কেটে পাঁচটি বধাকৃতি মন্দির নির্মিত হয়েছে। 

৪. অপরাজিত রীতি। 
রাজা প্রথম অপরাজিত বর্মনের আমলে গড়ে ওঠে অপরাজিত রীতি। এই রীতির প্রধান বৈশিষ্ট হল বিশালাকৃতি ও কারুকার্যের সংমিশ্রণ। এই শিল্পরীতির সাথে চোল শিল্পরীতির সাদৃশ্য দেখা যায়। 



প্রথম মহেন্দ্রবর্মন :- দেবালয়ের সম্মুখে স্তম্ভের ওপর নির্মিত মন্ডপের প্রবর্তক ছিলেন মহেন্দ্রবর্মন। মহাবলীপুরমে এই ধরণের দশটি মন্ডপের নিদর্শন পাওয়া যায়। 

প্রথম নরসিংহবর্মন :- রথ ধরণের স্থাপত্যের প্রবর্তক ছিলেন প্রথম নরসিংহবর্মন। গুহা কেটে রথগুলি নির্মাণ করা হত। এদের সংখ্যা ছিল আট। এগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিল ধর্মরাজা রথ। রথগুলি বিভিন্ন নামে পরিচিত , যথা - দ্রৌপদী , অর্জুন , ভীম , ধর্মরাজা ও সহদেব। বৌদ্ধ চৈত্যের অনুকরণে ভীম , গণেশ ও সহদেব রথগুলি নির্মিত। কাঞ্চীর কৈলাসনাথের মন্দির ও মহাবলীপুরমের রথ মন্দিরগুলি ছিল পল্লব শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। 

কাঞ্চীর অপরাপর মন্দিরগুলির মধ্যে ঐরাবতেশ্বর মন্দির বিশেষ উল্লেখযোগ্য। পাহাড় কেটে এই সকল মন্দিরগুলির নির্মাণকৌশল ও তাদের গঠনসৌন্দর্য আজও বিস্ময়ের বস্তু। স্মিথের ভাষায় , The Pallava school of architecture and sculpture is one of the most important and interesting of the Indian schools .'' 


পল্লব স্থাপত্যে দ্রাবিড় প্রভাব :- 

এই মন্দিরগুলিতে সর্বপ্রথম দ্রাবিড় শিল্পনীতির সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।  দ্রাবিড় রীতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্রধান দেবগৃহ বা গর্ভগৃহ এর বিমানটি হতো পিড়ামিটের মতো এবং বহু তলে বিন্যস্ত।  প্রতিটি তল গর্ভগৃহের অনুরূপ এবং নিচের তলের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র। মন্দিরের শীর্ষ দেশ গম্বুজ আকৃতি, শিল্প শাস্ত্রে যাকে বলে স্তুপ বা স্তুপিকা।  গর্ভগৃহের সামনে হলঘর নির্মাণ করা হতো, যাকে বলা হতো "মন্ডপ।"  সমগ্র বিন্যাসটির চারিদিকে উচ্চ দেওয়াল বেষ্টিত প্রাঙ্গন থাকতো| দেওয়ালের মধ্যে ছিল সুউচ্চতোরণ, যাকে বলা হতো গোপুরম। 

পল্লবদের সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্য নিদর্শন :- 


সাহিত্যের ক্ষেত্রেও পল্লবরাজরা ছিলেন পরম পৃষ্ঠপোষক। তাঁদের আমলে কাঞ্চী শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র ছিল। ভারবি ও দন্ডি এই যুগের খ্যাতনামা সাহিত্যিক ছিলেন। পল্লবরাজ প্রথম মহেন্দ্রবর্মন নিজে সুসাহিত্যিক ছিলেন। তাঁর রচিত '' মত্তবিলাস প্রহসন '' গ্রন্থে শৈব ও বৌদ্ধ সন্যাসীদের প্রতি বিদ্রুপের আভাস পাওয়া যায়। 

কীরতার্জুনীয় গ্রন্থের রচয়িতা ভারবি ছিলেন সিংহবিষ্ণুর সভাকবি। অপর খ্যাতনামা সাহিত্যিক দন্ডির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন নরসিংহবর্মন। ন্যায়ভাষ্য - গ্রন্থের রচয়িতা বাৎস্যায়ন ছিলেন কাঞ্চীর নাগরিক ও সুপ্রসিদ্ধ সংস্কৃত পন্ডিত। কাঞ্চী নগরের দেবালয়গুলিতে মহাভারতের নিয়মিত পাঠ খুবই জনপ্রিয় ছিল। সেইসঙ্গে কাঞ্চীর বিভিন্ন স্থানে বেদের নিয়মিত পঠন - পাঠন প্রচলিত ছিল। সুতরাং দেখা যায় যে , পল্লবদের আমলে জ্ঞানচর্চা সুপ্রসারিত ছিল এবং হিউয়েন সাং এর মতে , নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ধর্মপাল ছিলেন পল্লব রাজ্যের নিবাসী। দক্ষিণ ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে পল্লবদের অবদান অস্বীকার করা যায় না। দক্ষিণ ভারতে আর্য - সংস্কৃতি প্রসারে পল্লবদের অবদান অনস্বীকার্য। এই যুগে দক্ষিণ ভারতে সংস্কৃত ভাষার বহুল প্রচলন হয় এবং কাঞ্চী ছিল সংস্কৃত চর্চার প্রধান কেন্দ্র। 

কাঞ্চীর বিভিন্ন মন্ডপে মহাভারতের রীতিমত আবৃত্তি ও আলোচনা চলত। কুরুম নামক স্থানে ১০৮ টি পরিবার ছিল , তারা বেদ - চর্চায় সর্বদা নিমগ্ন থাকত। সংস্কৃত চর্চার সঙ্গে সঙ্গে তামিল ভাষা ও সাহিত্যের চর্চাও ছিল জনপ্রিয়। ত্রিয়াভালুভার রচিত ' তামিল কুরাল ' গ্রন্থটি ছিল জ্ঞানের এক বিরাট ভান্ডার।     


You May Also Like

0 comments