গুপ্তযুগের প্রশাসনিক ব্যবস্থা administrative system of guptas

by - July 31, 2021

গুপ্তযুগের প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিবরণ দাও। 

অথবা , সাম্রাজ্যবাদী গুপ্তদের শাসন ব্যবস্থা আলোচনা করো। 




গুপ্তযুগের প্রশাসনিক ব্যবস্থা : - 


ঐতিহাসিক উপাদান / তথ্যের উৎস :- 
(ক ) গুপ্ত রাজাদের ইতিহাস রচনায় পুরাণ হল উল্লেখযোগ্য উপাদান। যেমন - বায়ু পুরাণ , মৎস পুরাণ , ভগবৎ পুরাণ , বিষ্ণু পুরাণ - ইত্যাদি। 
(খ ) দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী শিখর কর্তৃক রচিত '' কমন্দক - নীতিসার '' গ্রন্থ। 
(গ ) বিশাখ দত্ত কর্তৃক রচিত ' মুদ্রারাক্ষস ' নাটক। 
(ঘ ) ফা - হিয়েন , ইৎসিং - প্রমুখ বৈদেশিক পর্যটকদের বিবরণী। 
(ঙ ) বিভিন্ন অনুশাসনলিপি , যেমন - এলাহাবাদ স্তম্ভলিপি , উদয়গিরির গুহালিপি , ভিতরী স্তম্ভলিপি , সাঁচীর শিলালিপি - ইত্যাদি। 
(চ ) গুপ্তরাজগন কর্তৃক প্রচারিত মুদ্রা। 


১. কেন্দ্রীয় শাসন , রাজা ও রাজার ক্ষমতা :- 
মৌর্যদের সাম্রাজ্যবাদী শাসনব্যবস্থা সংশোধিত অবস্থায় দেখা যায় গুপ্ত শাসন ব্যবস্থায়। গুপ্ত শাসনতন্ত্রে রাজতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্র উভয়ই প্রচলিত থাকলেও রাজতন্ত্রই ছিল প্রধান। রাজা ছিলেন রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তা। গুপ্ত সম্রাটরা রাজার দৈবস্বত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তারা মহারাজাধিরাজ , পরমেশ্বর , সম্রাট - ইত্যাদি উপাধি ধারণ করতেন। এলাহাবাদ স্তম্ভলিপিতে সমুদ্রগুপ্তকে কুবের , ইন্দ্র , বরুন - প্রভৃতি দেবতাদের সমতুল্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। 
রাজপদ ছিল বংশানুক্রমিক এবং রাজার ক্ষমতা ছিল সীমাহীন। তিনি ছিলেন সামরিক , বিচার , শাসন বিভাগের সর্বময় কর্তা। রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ , আইন প্রণয়ন , যুদ্ধ পরিচালনা ছিল রাজার অন্যতম দায়িত্ব। প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা রাজা কর্তৃক নিযুক্ত ও পদচ্যুত হতেন। 


২. মন্ত্রিপরিষদ :- 
রাজা শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারে মন্ত্রিপরিষদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। রাজপুত্র , উচ্চপদস্থ কর্মচারী ও সামন্তদের নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হত। অবশ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা একমাত্র রাজার ছিল। মন্ত্রিপরিষদের কাজ ছিল রাজাকে পরামর্শ দান করা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নাবালক রাজার অভিভাবক হিসেবে মন্ত্রিপরিষদ রাজ্য শাসন করতেন। 
কালিদাস তিনপ্রকার মন্ত্রীর কথা উল্লেখ করেছেন। যথা - পররাষ্ট্র মন্ত্রী , রাজস্ব মন্ত্রী , বিচার মন্ত্রী। মন্ত্রীপদ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বংশানুক্রমিক ছিল। শাসন বিভাগের সর্বোচ্চ কর্মচারী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। 

৩. বিচার ব্যবস্থা :- 
রাজা বা সম্রাট ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারক। কেন্দ্রীয় বিচারালয়ে উচ্চপদস্থ কর্মচারীরাও বিচারকার্যে অংশগ্রহণ করতেন। গ্রামাঞ্চলে গ্রামসভার প্রতিনিধিদের সাহায্যে রাজকর্মচারীরা বিচারকার্য সম্পাদন করতেন। দক্ষিণ ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে জুরি প্রথার প্রচলন ছিল। 
ফা - হিয়েনের মতে , গুপ্তযুগে দন্ডপ্রথা ছিল উদার এবং প্রাণদন্ড বা দৈহিক শাস্তির বিধান ছিল না বললেই চলে। কিন্তু ফা - হিয়েনের এই বিবরণ যথার্থ নয়। কেননা মুদ্রারাক্ষস নাটকে প্রাণদন্ড ও বধ্যভূমির উল্লেখ পাওয়া যায়। স্কন্ধগুপ্তের জুনাগড় প্রস্তরলিপিতে কঠোর শাস্তিদানের উল্লেখ আছে। 


৪. সামরিক সংগঠন :- 
প্রথম চন্দ্রগুপ্ত থেকে স্কন্ধগুপ্ত পর্যন্ত সকল গুপ্ত সম্রাটরা ছিলেন সুদক্ষ যোদ্ধা ও সাম্রাজ্যবাদী। গুপ্ত সম্রাটদের সামরিক বাহিনী - পদাতিক , অশ্ব - বাহিনী , হস্তীবাহিনী , নৌবাহিনী নিয়ে গঠিত ছিল। এছাড়া সামন্তরাও যুদ্ধের সময় সেনা দিয়ে সাহায্য করতেন। উচ্চপদস্থ সামরিক পদগুলি ছিল - মহাদন্ডনায়ক , মহাসন্ধি - বিগ্রহিক , মহাসেনাপতি , মহাবলাধিকৃত - ইত্যাদি। প্রধান যুদ্ধাস্ত্র ছিল - তীর , ধনুক , তরবারি , বর্শা , কুঠার - ইত্যাদি। 
এছাড়া গুপ্ত সম্রাটদের একটি শক্তিশালী নৌবাহিনীরও উল্লেখ পাওয়া যায়। পশ্চিম ও পূর্ব উভয় উপকূলেই গুপ্ত সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করেছিল। এলাহাবাদ স্তম্ভলিপি থেকে জানা যায় , সিংহল ও অন্যান্য বহু দ্বীপপুঞ্জে সমুদ্রগুপ্ত প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন। শক্তিশালী নৌ বাহিনীর সাহায্যেই ওই অঞ্চলগুলি গুপ্ত সম্রাটরা নিজ অধীনস্থ করতে পেরেছিলেন। 

৫. প্রাদেশিক শাসন :- 
গুপ্তযুগে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা ছিল কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার ক্ষুদ্র সংস্করণ। প্রাদেশিক প্রশাসনের সর্বোচ্চে থাকতেন প্রাদেশিক শাসনকর্তা। শাসনকার্যের সুবিধার জন্য গুপ্ত সাম্রাজ্য কয়েকটি ভাগে বিভক্ত ছিল , যথা - ভুক্তি , দেশ , রাষ্ট্র ও মন্ডল। উত্তরাঞ্চলে ভুক্তি ও দক্ষিণাঞ্চলে মন্ডল ছিল সাধারণ বিভাগ। ভুক্তি কতকগুলি বিষয় বা জেলায় বিভক্ত ছিল। দক্ষিণাঞ্চলের মন্ডলগুলি নাড়ু ও কোট্টম - এ বিভক্ত ছিল। দেশ ও ভুক্তির শাসনভার যথাক্রমে গোপত্রি ও উপরিকমহারাজ নামক রাজকর্মচারীদের হাতে ন্যাস্ত থাকতো। 
জেলা বা বিষয়ের শাসক ছিলেন বিষয়পতি বা আয়ুক্ত। বিষয়পতিদের সাহায্য করার জন্য - নগরশ্রেষ্ঠী , কুলিক , স্বার্থবাহ , প্রধান কায়স্থ - প্রভৃতি উপাধিধারী রাজকর্মচারীরা নিযুক্ত থাকতেন। 


৬. রাজস্ব - ব্যবস্থা :- 
রাজস্ব ও পুলিশি শাসনের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। প্রায় একই ধরণের কর্মচারীরা এই দুই বিভাগ পরিচালনা করতেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন - উপনিকা , দশপরাধিকা , দন্ডিকা , গৌলমিকা , রাজুক - ইত্যাদি। 
গুপ্ত সাম্রাজ্যে যে সকল কর প্রচলিত ছিল , সেগুলি হল -
(ক ) ভাগ বা ভূমিকর যা ছিল উৎপন্ন ফসলের এক - ষষ্ঠাংশ।  
(খ ) ভূতপ্রত্যয় বা আবগারী শুল্ক। এই শুল্ক  পণ্যের ওপর ধার্য হত। 
(গ ) সরকারি কার্যের জন্য বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমদানের বা '' বিষ্টি '' প্রথা প্রচলিত ছিল। 
(ঘ ) যুদ্ধ বা বৈদেশিক আক্রমণের সময় অতিরিক্ত কর বা '' মল্ল কর '' আদায় করা হত। 

এছাড়া , গুপ্তযুগে রাষ্ট্র ও গ্রামসভাগুলি যৌথভাবে জমির মালিকানা ভোগ করতেন এবং জমি হস্তান্তর করার ব্যাপারে রাষ্ট্রের সম্মতির প্রয়োজন হত। 

৭. স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন :- 
গুপ্তযুগে জনবহুল নগরসমূহে '' নিগম সভা '' নামে পরিচিত প্রতিষ্ঠান পৌর শাসনকার্য পরিচালনা করত । নগরশ্রেষ্ঠী , পুস্তাপান , স্বার্থবাহ - প্রভৃতি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে '' নিগম সভা '' গঠিত হত। নগর শাসন ব্যবস্থার প্রধানকে '' পুরপাল '' বা '' নগর রক্ষক '' বলা হত। 
অন্যদিকে গ্রামগুলি ছিল অনেকক্ষেত্রে স্বয়ংশাসিত। ' গ্রামিক ' নামক কর্মচারী গ্রামের নেতৃস্থানীয়দের পরামর্শ অনুসারে গ্রামের যাবতীয় শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। 

পরিশেষে বলা যায় , গুপ্তশাসনে কোনোরূপ মৌলিকতার নিদর্শন স্বীকার না করা হলেও তা প্রজাকল্যাণমূলক ছিল। তবে , ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় গুপ্তশাসনের মৌলিকতা স্বীকার করেছেন। রাজারা সকল ক্ষমতার অধিকারী হয়েও স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না। গুপ্ত শাসনপ্রণালী ছিল সুগঠিত ও সুনিয়ন্ত্রিত এবং কেন্দ্রীয় শাসন ছিল শক্তিশালী। ডক্টর মজুমদার গুপ্ত শাসনের উদারতা , সাধারণ মানুষের সমৃদ্ধি ও নৈতিক মূল্যবোধের উল্লেখ করেছেন।

                         

You May Also Like

0 comments