ইতিহাস রচনায় প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান

by - August 02, 2021

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলি সম্পর্কে আলোচনা করো।






ভারতীয় সভ্যতা অতি প্রাচীন এবং ইতিহাস সমৃদ্ধ। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান দুভাবে বিভক্ত। প্রত্নতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক উপাদান। প্রাচীন ভারতে লিখিত ঐতিহাসিক গ্রন্থের অপ্রতুলতার কারণে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলি পথনির্দেশকের কাজ করে। এককথায় বলা যেতে পারে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস লিখিত ও প্রত্নতাত্ত্বিক উভয় প্রকার উপাদানের সমন্বয়ে রচিত।
প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলি হলো - (ক ) লিপি বা লেখমালা , (খ ) মুদ্রা , (গ ) স্থাপত্য ও ভাস্কর্য , (ঘ ) প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ।
লিখিত সাহিত্যিক উপাদানগুলি হলো - (ক ) দেশীয় সাহিত্য , (খ ) বৈদেশিক বিবরণ।


লিপি বা লেখমালা :-
প্রাচীন লিপির ঐতিহাসিক মূল্য প্রসঙ্গে স্মিথ বলেছেন - '' ঐতিহাসিক জ্ঞানের উপাদান হিসাবে প্রাচীন লিপিগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য। ''
ঐতিহাসিক ফ্লিট -এর মতে , মুদ্রা , ভাস্কর্য , স্থাপত্য , ঐতিহ্য ও সাহিত্য থেকে আমরা যে সকল বিবরণ পাই তার সত্যতা নির্ণয় করতে লিপিমালা যথেষ্ট সাহায্য করে।
লিপিগুলি থেকে প্রাচীন যুগের আর্থ -সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বহুল বিবরণ পাওয়া যায়। যেমন -
(i)হাতিগুমফা শিলালিপি থেকে কলিঙ্গরাজ খারবেল সম্পর্কে জানা যায়।
(ii)এলাহাবাদ স্তম্ভলিপি থেকে সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকাল ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের ইতিহাস জানা যায়।
(iii)সম্রাট অশোকের একাধিক শিলালিপি ও স্তম্ভলিপি থেকে অশোকের ধম্ম ও মৌর্য সাম্রাজ্যের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।
(iv)এশিয়া মাইনর-এ প্রাপ্ত ''বোঘাজ - কোয়'' শিলালিপি থেকে ভারত আগমনের পূর্বে আর্যদের বিস্তৃতি সম্পর্কে জানা যায়।
(v)নকশি রুস্তম - এ প্রাপ্ত লিপি থেকে ভারতের সাথে ইরানের রাজনৈতিক সম্পর্কের ইতিহাস জানা যায়।
(vi)নাসিক প্রশস্তি থেকে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী সম্পর্কে জানা যায়।
(vii)রবিকীর্তির আইহোল প্রশস্তি দ্বিতীয় পুলকেশী সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে।
এছাড়াও আরো বহু লিপির অস্তিত্ব বর্তমান - যা প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় সহায়তা করে।

মুদ্রা :-
সাহিত্য ও লিপি থেকে যে সকল তথ্যাদি পাওয়া যায় তার সত্যতা জানতে সাহায্য করে মুদ্রা। সন তারিখ সম্বলিত মুদ্রাগুলি কাল নিরুপন করতে সাহায্য করে। মুদ্রা থেকে রাজাদের শাসন , আর্থ - সামাজিক অবস্থা , তাঁদের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়। শক , ব্যাকট্রিয় ও কুষাণদের ইতিহাস জানতে মুদ্রাই  একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপাদান। গুপ্ত রাজাদের মুদ্রা থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধির কথা জানা যায়।ব্যাকট্রিয় গ্রিক ও শকদের মুদ্রা থেকে ভারত ও রোমের সম্পর্কের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
মুদ্রায় অঙ্কিত ছবি থেকে সমকালীন যুগের ধর্মীয় ও সামাজিক ইতিহাস জানা যায়। মুদ্রার গঠনরীতি থেকে শিল্পকলা ও সৌন্দর্যের পরিচয় পাওয়া যায়। মুদ্রায় ব্যবহৃত ধাতু থেকে তৎকালীন সময়ের অর্থনৈতিক অবস্থা ও ধাতুবিদ্যার কথা জানা যায়।


স্থাপত্য ও ভাস্কর্য :-
রাজনৈতিক ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের গুরুত্ব অধিক না হলেও প্রাচী ভারতের ইতিহাস রচনায় এদের গুরুত্ব কম নয়। তক্ষশীলা ও সারনাথে প্রাপ্ত বহু স্তম্ভগুলি থেকে বৌদ্ধ ধর্ম , কুষাণ যুগ , গান্ধার শিল্প - ইত্যাদি সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়।  পশ্চিম বাংলার অজয় নদের তীরে পান্ডু রাজার ঢিপি ও চব্বিশ পরগনার বারাসাত - বসিরহাট অঞ্চলে চন্দ্র্রকেতুর গড় ইত্যাদি স্থাপত্য নিদর্শন প্রাচীন বাংলার ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তুর্কিস্থান ও বেলুচিস্তানের খননের দ্বারা ভারতের সাথে উক্ত অঞ্চল দুটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পরিচয় পাওয়া যায়। কম্বোজের আঙ্কোরভাট ও জাভার বরোবুদুরের মন্দির দুটি থেকে ভারতের ঔপনিবেশিক ও সাংস্কৃতিক বিস্তারের পরিচয় পাওয়া যায়।

প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ :-
প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ যেকোনো দেশের সভ্যতা - সংস্কৃতির ইতিহাস জানতে অপরিহার্য উপাদান। খনন কার্যের ফলে প্রাপ্ত প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ গুলি হলো একমাত্র বাস্তব ভিত্তিক উপাদান ; কেননা এই উপাদানগুলির মধ্যে কোনো কৃত্তিমতা থাকে না। ১৯২৪ সালে হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে বিশ্ববাসীর সামনে এক নতুন দিগন্ত খুলে যায়। এছাড়া মৌর্য আমলে নির্মিত কাষ্ঠ নির্মিত প্রাসাদ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান। বর্তমান বিহারের নিকট নালন্দা ও তক্ষশীলার ধ্বংসাবশেষ প্রাচীন ভারতের শিক্ষার ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সাম্প্রতিক কালে মেহেরগড় সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের সভ্যতার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে নতুন করে গবেষণা শুরু হয়েছে।

পরিশেষে বলা যায় , ঐতিহাসিক উপাদানগুলির মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলিকে সবচেয়ে বেশি প্রামাণিক তথ্য হিসেবে ঐতিহিসিকগণ গ্রহণ করে থাকেন। ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার , ভিনসেন্ট স্মিথ , অধ্যাপক র‍্যাপসন - প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা সকলেই প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলিকে ইতিহাস রচনার জীবন্ত দলিল বলে উল্লেখ করেছেন।   


You May Also Like

0 comments