দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের সুদৃঢ়করণে ইলতুৎমিসের ভূমিকা ; iltutmish

by - August 02, 2021

দিল্লির সুলতানি শাসনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন ? তাঁর কৃতিত্ব আলোচনা করো। 

অথবা , দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের সুদৃঢ়করণে ইলতুৎমিসের ভূমিকার মূল্যায়ন করো। 




ইলতুৎমিশ ( ১২১১ - ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দ ) :- 

কুতুবউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর পোষ্যপুত্র আরাম শাহ দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু আরাম শাহ রাজ্যশাসনের অযোগ্য ছিলেন। এই কারণে দিল্লির তুর্কি আমীররা কুতুবউদ্দিনের জামাতা ও বদাউন প্রদেশের শাসনকর্তা ইলতুৎমিসকে দিল্লির সিংহাসন আরোহণ করতে আহ্বান জানান। ইলতুৎমিশ ১২১১ খ্রিস্টাব্দে আরাম শাহকে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসন অধিকার করেন। 


একাধিক প্রদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা :- 
কিন্তু ইলতুৎমিসের সিংহাসনারোহন মোটেই আরামদায়ক হয়নি। কুতুবউদ্দিনের মৃত্যুর পর আলিমর্দান খালজী বাংলাদশে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মুলতানের শাসনকর্তা নাসিরউদ্দিন কুবাচা নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করে ভাতিন্ডা দখল করেন। জালোর ও রণথম্ভোর স্বাধীনতা ঘোষণা করে। আজমীঢ় , গোয়ালিয়র ও দোয়াব অঞ্চল দিল্লির সুলতানের হস্তচ্যুত হয়। তাজউদ্দিন ভারতের ওপর সার্বভৌমত্বের দাবি করেন। 


আমীর ও ওমরাহদের বিদ্রোহ দমন :- 
ইলতুৎমিশ এই সংকটময় পরিস্থিতিতে অবিচলিত চিত্তে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রথমে তিনি বিদ্রোহী আমীর - ওমরাহদের দমন করে দিল্লি ও সন্নিকটস্থ বদাউন , অযোধ্যা , বারাণসী - প্রভৃতি অঞ্চল নিজ আয়ত্তে আনেন। এরপর তিনি তাজউদ্দিন ও নাসিরউদ্দিনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। 

তাজউদ্দিন ও নাসিরউদ্দিনের পরাজয় ও মৃত্যু :- 
১২১৬ খ্রিস্টাব্দে তরাইনের কাছে এক যুদ্ধে তাজউদ্দিনকে পরাজিত করে বন্দী করেন। পরে তিনি বদাউন কারাগারে নিহত হন। ১২১৭ খ্রিস্টাব্দে নাসিরউদ্দিন ইলতুৎমিসের হাতে পরাজিত হয়ে সিন্ধুপ্রদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১২২৮ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিশ সিন্ধু আক্রমণ করলে উপায়ান্তর না দেখে নাসিরউদ্দিন আত্মহত্যা করেন। সিন্ধু অঞ্চল ইলতুৎমিসের দখলে আসে। 
তাজউদ্দিন ও নাসিরউদ্দিনের বিরুদ্ধে জয়লাভের তাৎপর্য প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ডক্টর হাবিবুল্লাহ বলেছেন যে , এর ফলে দিল্লি মধ্য এশিয়ার রাজনীতির জাল থেকে মুক্তি পেল। 


মোঙ্গল নেতা চিঙ্গিজ খাঁর ভারত আক্রমণ :- 
ইলতুৎমিশ যখন অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনে ব্যাস্ত ঠিক সেই সময় ১২২১ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গলনেতা চিঙ্গিজ খাঁ এক বিরাট মোঙ্গল বাহিনী নিয়ে ভারতে উপস্থিত হন। চিঙ্গিজ খাঁ খারাজিম রাজ্য আক্রমণ করলে যুবরাজ জালালউদ্দীন মাঙ্গবার্ণী পাঞ্জাবে আশ্রয় গ্রহণ করেন। চিঙ্গিজ খাঁ তার পশ্চাদ্ধাবন করে সিন্ধু পর্যন্ত অগ্রসর হন। এই অবস্থায় জালালউদ্দীন মাঙ্গবার্ণী ইলতুৎমিসের আশ্রয় প্রার্থনা করেন। কিন্তু ইলতুৎমিশ চিঙ্গিজ খাঁ - এর বিরুদ্ধে জালালউদ্দিনকে আশ্রয় দিয়ে দিল্লি সুলতানির বিপদ ডেকে আনার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাই তিনি বিনয়ের সঙ্গে জালালউদ্দিনের প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করলেন। ইলতুৎমিসের নিরপেক্ষতায় সন্তুষ্ট হয়ে চিঙ্গিজ খাঁ ভারত ত্যাগ করে চলে যান। এইভাবে ইলতুৎমিশ এক প্রবল সংকট থেকে দিল্লি সুলতানিকে রক্ষা করেন।    

বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ়করণ :- 
সাংগঠনিক প্রতিভাবলে প্রাথমিক সমস্যাগুলির সমাধান করে দীর্ঘ ছাব্বিশ বছররের অক্লান্ত পরিশ্রমে তিনি সুলতানি সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করেন ও বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করতে সমর্থ হন। বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের আদর্শ পরবর্তী ত্রিশ বছর ধরে দিল্লির সিংহাসনকে প্রভাবিত করেছিল এবং ইলতুৎমিসের বংশধরেরাই সিংহাসনের একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। 


দিল্লি শহরের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা : -  
মধ্যযুগের দিল্লি শহরের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হলেন ইলতুৎমিস। একাধিক মসজিদ , মাদ্রাসা , মিনার - ইত্যাদি তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে। মুসলিম সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে দিল্লি , ইলতুৎমিসের আমলেই ভারতের বাইরেও খ্যাতিলাভ করে। ঐতিহাসিক মিনহাজ - উস - সিরাজের বর্ণনাতে ইলতুৎমিসের সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতার পরিচয় পাওয়া যায়। 

শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসন গঠন :- 
দিল্লির সুলতানির কেন্দ্রীয় প্রশাসনের প্রকৃত ভিত্তি রচনা করেন ইলতুৎমিশ। ইলতুৎমিসের আমলে রাজতন্ত্র ছিল তুর্কিদাস কর্মচারী ও অ - তুর্কি বিদেশিদের সমর্থনের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। স্থানীয় শান্তি - শৃঙ্খলার জন্য তিনি স্থানীয় নায়কদের সমর্থন লাভে সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন। বিভিন্ন নায়ক গোষ্ঠীর মধ্যে সমন্বয়সাধন করার ক্ষেত্রে ইলতুৎমিসের দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। 

খলিফা কর্তৃক স্বীকৃতি প্রদান :- 
ইলতুৎমিস সিন্ধু অধিকার করেন। এরপর রণথম্বোর পুনরাধিকার করে তিনি বাংলার খলজি মালিকদের দমন করেন । গোয়ালিয়রও তার অধিকারে আসে । তিনি মালয় অভিযান করে ভিলসা দুর্গ অধিকার করেন ও উজ্জয়িনী দখল করে তা ধ্বংস করেন । এইভাবে তিনি যখন নিজ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তখন ১২২৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের খলিফা তাঁকে রাজমর্যাদায় ভূষিত করেন । এর ফলে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি পায় ও ভারতের উপর তাঁর আধিপত্য বৈধ বলে স্বীকৃতি লাভ করে । 

সামরিক বাহিনী :- 
ইলতুৎমিশ একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সৈন্যবাহিনী গঠন করতে সমর্থ হন। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে সেনা সংগ্রহ ও কেন্দ্রীয় কোষাগার থেকে এদের ভরণ - পোষণের ব্যবস্থা করা হয়। এইভাবে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে এক কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনী সংগঠনের সূত্রপাত হয়। 

মুদ্রা :- 
দিল্লির সুলতানদের মধ্যে ইলতুৎমিসই সর্বপ্রথম রৌপ্য তংকা ও তাম্র জিতাল নামে দুপ্রকার মুদ্রার প্রচলন করেন। Nelson Wright  এর মতে , দিল্লির মুদ্রা প্রস্তুতকরণের ইতিহাসে ইলতুৎমিসের রাজত্বকাল স্মরণীয়। তাঁর প্রবর্তিত তংকা পরবর্তীকালের সুলতানদের অনুকরণীয় হয় এবং এই তংকারই রূপান্তর হল আধুনিক কালের রৌপ্য টাকা।    

সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসনের সংগঠনে ইলতুৎমিসের মৌলিক প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি প্রশাসনের যে আদর্শ স্থাপন করেন , তা সমগ্র সুলতানি আমল পর্যন্ত মোটামুটি অব্যাহত থাকে। সিংহাসনে আরোহণ করার সময় সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে অবিচলিত থেকে যে মানসিক দৃঢ়তা ও কূটনীতিজ্ঞানের পরিচয় দেন , দিল্লির অপরাপর সুলতানদের মধ্যে সেরকম দৃষ্টান্ত বিরল। তিনি সুলতানি সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি করে ও দিল্লির সুলতানদের মধ্যে সর্বপ্রথম খলিফার অনুমোদন লাভ করে সাম্রাজ্যের গৌরব বৃদ্ধি করেছিলেন।

 

You May Also Like

0 comments