নালন্দা : প্রাচীন ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র : -

by - July 15, 2021

প্রাচীন ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র : নালন্দা :- 

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। 




প্রাচীন ভারতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি লাভ করেছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। বৌদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে নালন্দার খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি হল :- 

১. অবস্থান :- 
রাজগিরের সাত মাইল উত্তরে , বর্তমান বরাগাত্তের কাছে নালন্দা নামে একটা গ্রাম ছিল। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে ফা হিয়েন - এর সময় নালন্দাকে নালা বলা হত। 

২. গঠন ও পরিকাঠামো :- 
প্রায় সাড়ে তিন বর্গমাইল জুড়ে অবস্থিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়টি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছিল। পাঁচিলের গায়ে একটি দরজা ছিল , সেটি খুললেই আলাদা আলাদা আটটি হলঘর দেখা যেত। ঘরগুলির মাঝে ছিল সংঘারাম। সব দালানগুলোই ছিল একাধিক তলাবিশিষ্ট। কেন্দ্রীয় ভবনের লাগোয়া আটটি বৃহৎ অট্টালিকা এবং বারোটি ছাত্রাবাসের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। সেখানে প্রায় দশ হাজার শিক্ষার্থী এবং এক হাজার শিক্ষকের থাকার ব্যবস্থা ছিল। 

৩. ব্যয়ভার :- 
নালন্দার জমি , মঠ , দৈনন্দিন ব্যয়নির্বাহ ইত্যাদি সবেরই উৎস ছিল দান। হিউয়েন সাং বলেন , পাঁচশো ব্যবসায়ী দশ কোটি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে জমি কিনে বুদ্ধদেবকে এই জমি দান করেন। শতাব্দীব্যাপী একের পর এক রাজ্যের অবিরত দানের ফলেই ছয় তলা বিশিষ্ট মঠের নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল। যতদূর জানা গেছে একশোটি গ্রামের রোজগার , বিত্তশালী ব্যক্তিদের দান এবং রাজাদের আর্থিক আনুকূল্যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চালানো হত। 

৪. অবৈতনিক শিক্ষা :- 
সম্পত্তির আয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় তার সমস্ত ছাত্রদের জন্য বিনামূল্যে খাদ্য , পোশাক , থাকার ব্যবস্থা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করত। 

৫. প্রবেশাধিকার :- 
নালন্দায় প্রবেশের পরীক্ষা খুবই কঠিন ছিল। হিউয়েন সাং উল্লেখ করেছেন মাত্র কুড়ি শতাংশ পরীক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সক্ষম হত। ভর্তির বয়স নির্দিষ্ট ছিল কুড়ি বছর।  অভ্যন্তরীণভাবে নিয়মিত ছাত্রদের মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। তাদের ক্ষেত্রে প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রয়োজন হত না। 

৬. পাঠক্রম :- 
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম ছিল বিপুল ও বৈচিত্র সমৃদ্ধ। সেই সময়কার সমগ্র জ্ঞান এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ ধর্মীয় , ধর্মনিরপেক্ষ , দার্শনিক ও ব্যবহারিক , বিজ্ঞান ও কলাবিদ্যা প্রভৃতি শিক্ষার বিভিন্ন শাখার পঠন পাঠনের ব্যবস্থা ছিল। নালন্দার শিক্ষার্থীদের আঠারোটি কলাবিদ্যা , বেদ ও অন্যান্য গ্রন্থ , হেতুবিদ্যা , শব্দবিদ্যা , চিকিৎসাবিদ্যা , যাদুবিদ্যা , অথর্ববেদ , সাংখ্য প্রভৃতি পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা ছিল। 

৭. শিক্ষাদান পদ্ধতি :- 
নালন্দাতে আবৃত্তির মাধ্যমে পাঠদান হত। এ ছাড়া আলোচনাচক্র , বিতর্ক প্রভৃতি মৌখিক উপায়ও  অবলম্বন করা হত। শিক্ষাশেষে শিক্ষার্থীদের উপাধিও প্রদান করা হত। 

৮. গণতান্ত্রিক পরিচালনা :- 
ইৎ - শিঙ - এর মতে মঠের জীবনযাত্রা কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলায় আবদ্ধ থাকলেও ঘর ভাগ করা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যাবলী গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসারে পরিচালিত হত। নালন্দার বিপুল সংখ্যক ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে সংহতি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। হিউয়েন সাং উল্লেখ করেছিলেন যে , সাত দশক ধরে এই সংহতিতে একটি ঘটনাও নথিভুক্ত নেই , যেটি অপরাধমূলক কাজের দ্বারা কলঙ্কিত হয়েছে। সংঘচেতনা ব্যক্তি - সন্ন্যাসীদের থেকে বেশি গুরুত্ব পেত।  নালন্দার সন্ন্যাসীরা বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। তবে তারা নিজেদের মধ্যেকার সংহতিকে  কোনোভাবেই বিপন্ন হতে দিতেন না। গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আদর্শগত মতপার্থক্যকে বিতর্ক ও  আলোচনা সাহায্যে প্রতিষ্ঠা করতে হত। 

৯.  শৃঙ্খলা :- 
নালন্দা বিহারে শিক্ষার্থী ও অধ্যাপক সকলকেই শৃঙ্খলা রক্ষা করে চলতে হত। শুধু যে শয্যা গ্রহণ ও শয্যাত্যাগের নির্দিষ্ট সময় ছিল - তা'ই নয় ,  এর মধ্যবর্তী সময়ে কখন কী করতে হবে এবং কীভাবে করতে হবে - তা'ও সুনির্দিষ্ট ছিল। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সমাজগত অবস্থানের কোনো প্রভাব ছিল না।  রাজপুত্র এবং সাধারণ পরিবারের সন্তান - সকলকেই শৃঙ্খলা মেনে চলতে হত। 

১০. গ্রন্থাগার :- 
নালন্দায় উত্তম মানের গ্রন্থাগার ছিল। গ্রন্থাগারটি একটি বিশেষ অঞ্চলে অবস্থিত ছিল , যার নাম ছিল ধর্মগঞ্জ। রত্নসাগর , রত্নদধি ও রত্নরঞ্জক নামে তিনটি বড় গ্রন্থাগার নিয়ে এটি গঠিত ছিল। 


১১. অধ্যাপকমন্ডলী :- 
শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবে নালন্দার খ্যাতি প্রধানত এর বিখ্যাত শিক্ষকমন্ডলীর কারণে ঘটেছিল। এঁদের মধ্যে যাঁদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন - ধর্মপাল , শীলভদ্র , চন্দ্রপাল , গুণমতী ও স্থিরমতি , প্রভামিত্র , জিনামিত্র , জ্ঞানচন্দ্র প্রমূখ। 

১২. খ্যাতি :- 
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি চীন , তিব্বত , কোরিয়া , জাভা , সুমাত্রা , সিংহল , যবদ্বীপ - প্রভৃতি দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। 

১৩. ধ্বংস :- 
পাল রাজাদের শেষদিকে নালন্দার গৌরব ম্লান হয়ে পড়ে। গোষ্ঠী সংঘর্ষ ও অভ্যন্তরীণ কলহের ফলে নালন্দার জীবনযাত্রার মানের অবনতি ঘটে। সেই সময়ে মুসলিম সেনাপতি বক্তিয়ার খলজির আক্রমণে ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয়। 

১৪. মূল্যায়ন :- 
প্রাচীন ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এক প্রত্যন্ত গৌরব উজ্জ্বল স্থান দখল করেছিল।  তার গণতান্ত্রিক পরিচালন ব্যবস্থা , অত্যন্ত উন্নত মানের শিক্ষকমন্ডলী , সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার , ছাত্র-শিক্ষক সবার জন্য শৃঙ্খলাবিধান - ইত্যাদি কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক খ্যাতির শিখরে ওঠে। আমাদের দেশ তো বটেই বিশ্বের অন্যান্য দেশও  প্রাচীন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অনুকরণ করার চেষ্টা করে। 

You May Also Like

0 comments