তক্ষশিলা : প্রাচীন ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র : -
প্রাচীন ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র : তক্ষশিলা :-
তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়।
তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু ব্রাহ্মণ্য যুগে হলেও বৌদ্ধ যুগ পর্যন্ত এর স্থায়িত্ব দেখা যায়। বলা যেতে পারে , এই বিশ্ববিদ্যালয় উভয় যুগের মধ্যে একটি যোগসুত্র রচনা করেছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বা বৈশিষ্ট্য নিচে আলোচনা করা হল।
১. অবস্থান :-
কথিত আছে রাজা ভরত প্রাচীন গান্ধারের রাজধানী তক্ষশিলায় এই শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেন। প্রায় বারো বর্গমাইল জায়গা জুড়ে তক্ষশিলা অবস্থিত ছিল। বর্তমানে এই অঞ্চলটির অবস্থান পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির কাছে। তক্ষশিলায় বহু পন্ডিতের সমাবেশ হয়েছিল। সেই সব পন্ডিতের কাছ থেকে শিক্ষা লাভের জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সমাবেশ ঘটে। গড়ে ওঠে বিভিন্ন গুরুর অধীনে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোট ছোট বিদ্যালয়।
২. শিক্ষা ব্যবস্থা :-
তক্ষশিলা ছিল উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র। শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক ও সাধারণ শিক্ষা শেষ করে তক্ষশিলায় আসতো উচ্চশিক্ষার জন্য। তক্ষশিলায় প্রবেশের বয়স ছিল ষোলো বছর। প্রায় আট বছর সেখানে তারা শিক্ষা গ্রহণ করত। প্রতিটি বিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা যথেষ্ট ছিল। ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা শিক্ষালাভের অধিকারী ছিল। শুদ্রদের শিক্ষার অধিকার ছিলনা। ধনী ও দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ ছিলনা। শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ আবাসিক ছিলনা। শিক্ষালাভের জন্য গুরুগৃহে বা পৃথকভাবেও থাকা যেত।
৩. শিক্ষার ব্যয় :-
তক্ষশিলায় শিক্ষা অবৈতনিক ছিলনা। অবস্থাপন্ন শিক্ষার্থীগণ শিক্ষার শুরুতেই বেতন প্রদান করতো। অন্যান্যরা শিক্ষা শেষে বেতন দিত। দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা অর্থের পরিবর্তে দিনে গুরুগৃহে নানা ধরনের দৈহিক পরিশ্রম করত এবং রাতে পাঠ গ্রহণ করত। অনেক সময় ধনী পরিবার দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করত।
৪. পাঠ্যসূচি :-
চতুর্বেদ , ইতিহাস , পুরাণ , দর্শন শাস্ত্রাদি , হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম , ব্যাবসা-বানিজ্য , রাজনীতি , হিসাবশাস্ত্র , নৌ ও জাহাজ নির্মাণ , ভাস্কর্য , কৃষি , চিত্রাঙ্কন , হস্তশিল্প মানুষ ও পশু চিকিৎসা , সামরিক বিদ্যা প্রভৃতির পাঠ্যসূচিতে পাওয়া যায়। শিক্ষাসূচিতে ব্যবহারিক দিকে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হত। বিদ্যার সম্পূর্নতার জন্য ভ্রমণ ছিল শিক্ষার বিশেষ অঙ্গ।
৫. শিক্ষাদান পদ্ধতি :-
মৌখিক পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করা হলেও আলোচনা ও বিতর্ক ছিল শিক্ষাদানের বিশেষ অঙ্গ। ব্যক্তিগত ও দলগত উভয়ভাবেই শিক্ষা প্রদান করা হত। রাজপুত্র ও সাধারণ শিক্ষার্থী - সকলকেই একসঙ্গে শিক্ষা দেওয়া হত।
৬. মূল্যায়ন :-
লিখিত পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। তবে মৌখিক পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর কৃতিত্বের মূল্যায়ন করা হত। এছাড়া আলোচনা ও বিতর্কসভায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন হত। ব্যবহারিক বিদ্যার পরীক্ষা ছিল তক্ষশিলার বৈশিষ্ট্য। চিকিৎসাবিদ্যা , সামরিক বিদ্যায় ব্যবহারিক পরীক্ষা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৭. শিক্ষকমন্ডলী :-
তক্ষশিলায় শিক্ষকমন্ডলী ছিলেন বিভিন্ন বিষয়ে সুপন্ডিত। অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী , গুরুদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি ছিল ; যেমন - শিষ্ট , দম্ভনীতিক ,পুরোহিত ইত্যাদি। পাণিনির মতে , শিক্ষকদের শ্রেণিভেদের মধ্যে ছিল - গুরু , আচার্য , উপাধ্যায় - ইত্যাদি। উপাধ্যায়া , আচার্য্যা প্রভৃতির উল্লেখ থাকায় মনে করা হয় যে , এই সুপ্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলারাও শিক্ষাদানের নিযুক্ত থাকতেন।
৮. শৃঙ্খলা :-
তক্ষশিলার শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়কেই কিছু নিয়ম মেনে চলতে হত। ফলে শৃঙ্খলা জনিত সমস্যা খুব কম দেখা যেত।
৯. বিশেষ উৎকর্ষকেন্দ্র : -
তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যায়নের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎকর্ষকেন্দ্র। সেখানে শিক্ষার্থীগণ সাত বছর ধরে অধ্যায়ন করত। শল্যচিকিৎসা সম্পর্কে বিশেষ ভাবে পাঠদান করা হত।শুধুমাত্র চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যায়নের শেষে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া হত। এছাড়া সেখানে ভেষজবিদ্যা সম্পর্কে পঠন-পাঠনের ব্যবস্থাও ছিল।
প্রাচীন ভারতে উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে তক্ষশিলা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সেখানকার উচ্চমানের শিক্ষা , বিশেষতঃ ব্যবহারিক শিক্ষা আজও শিক্ষাবিদরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। কুষাণ যুগ পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব অক্ষুন্ন ছিল। পরে হূন আক্রমণের ফলে এর গৌরব অস্তমিত হয়।
0 comments