এক বিপন্ন সময় ও সমাজের কবিতা শঙ্খ ঘোষের '' বাবরের প্রার্থনা। '' - আলোচনা করো।

by - July 22, 2021

'' বাবরের প্রার্থনা '' কবিতায় কবি বর্তমানের এক বিপন্ন সময়ের আর্তি প্রকাশ করেছেন - কবিতাটি বিশ্লেষণ করে কবির এই মনোভাবের পরিচয় দাও। 

অথবা , 

এক বিপন্ন সময় ও সমাজের কবিতা শঙ্খ ঘোষের '' বাবরের প্রার্থনা। '' - আলোচনা করো। 




মননে - মেধায় ঋদ্ধ , অথচ আধুনিক যে কবির ভাষা জলের মত স্বচ্ছ ও সঙ্গীতের মূর্ছনায় পাঠকের হৃদয় ও মনকে একই সঙ্গে আন্দোলিত করে বশীভূত করে ফেলে তাঁর নাম শঙ্খ ঘোষ। সামাজিক দায়বদ্ধতাকে স্বীকার করেও স্বপ্নবিলাসী ও আদ্যন্ত নিসর্গ প্রেমিক এই মানুষটি ইতিহাসকে তাঁর কবিতায় তুলে এনেছেন বারবার। বস্তুতঃ তাঁর কবিতায় আমরা ইতিহাসকে দেখি বিপন্ন বর্তমানের আর্তির মাঝে। '' বাবরের প্রার্থনা '' কবিতাটি তাঁর এই জাতীয় কবিতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। 


এক শঙ্কাতুর পিতা তাঁর রোগাক্রান্ত সন্তানের আরোগ্য প্রার্থনায় ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনারত , যিনি প্রয়োজনে নিজ আয়ু প্রদান করেও সন্তানের সুস্থতা কামনা করেন। আলোচ্য কবিতায় কবি এমনই এক ইতিহাসের ধূসর ছবিকে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে উজ্জ্বল রঙে 
এঁকেছেন।  কবিতাটিতে কবির কালচেতনা ও ইতিহাস চেতনা মূর্ত হয়ে উঠেছে। 

মুক্তির দশক হিসেবে চিহ্নিত সত্তরের দশকের তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতা , হত্যালীলা - দেশকে ও দেশের যুবকদের ঠেলে দিচ্ছিল মৃত্যুর দিকে। একই সঙ্গে বিশ্ব রাজনীতিতে দেখা দিয়েছিল চরম অস্থিরতার বাতাবরণ। বিবেকী কবি এই অস্থিরতার আবহে ব্যক্তিগত ভাবনাকে সমষ্টিগত রূপ প্রদান করে ইতিহাসের সেই শঙ্কাতুর পিতার মত ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা জানান তাঁর সন্ততিদের সুস্থ জীবন প্রদান করতে। 
'' ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও , 
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক। '' 


কবির নিজের ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। তার আরোগ্যলাভ ডাক্তারদের সাধ্যের বাইরে। এই পরিস্থিতে ইতিহাসের পদচারণায় তাঁর স্মৃতিপটে রোগশয্যায় শায়িত হুমায়ূনের ছবি ফুটে ওঠে এবং বাবরের মত তিনিও প্রার্থনা করেন তাঁর কবিতায়। তবে সেই প্রার্থনা কেবলমাত্র আত্মজার জন্য নয় , যুগের সমস্ত লাঞ্চিত , স্বপ্নছিন্ন সন্তানের জন্য। 

কবিতায় ব্যবহৃত 'বসন্ত' শব্দটি আনন্দ ও যৌবন - উভয় দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। পাশাপাশি কবি অস্তগামী সূর্যের আভাস , শুন্য বসন্ত - এই দুয়ের ইঙ্গিতে জানিয়েছেন - এই যুগ , এই কাল কিছু চায়। সন্ততির স্বপ্ন পূরণের প্রার্থনার মধ্যে তা তাঁর আত্ম প্রক্ষেপও বটে। সন্তানের মাধ্যমে চরিতার্থ হতে চায় মানুষ ; যে সাধ - বাসনা কবির একার নয় , সর্বজনের। সুদূর মধ্যযুগের অন্নদামঙ্গলের ঈশ্বরী পাটনীর '' আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে ''- র সার্থক রূপ যেন বাঙময় হয়ে ওঠে শঙ্খ ঘোষের অসামান্য মিথ কথনের ভঙ্গিতে। সত্তর দশকের রক্ত বারুদে মাখা দিনগুলিতে সন্ততির সুখে থাকার এক আন্তরিক প্রার্থনা ফুটে ওঠে তাঁর কণ্ঠ এবং কবিতায় এবং তিনবার ধ্রুবপদের মতো ব্যবহৃত হয় - '' আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক '' - পংক্তিটি। 


দ্বিতীয় স্তবকে কবি যখন উচ্চারণ করেন - 
'' কোথায় গেল ওর স্বচ্ছ যৌবন 
কোথায় কুরে খায় গোপন ক্ষয় ! '' 
তখন পিতা বাবরের সঙ্গে কবির খেদ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। পদাঘাতে ভাঙতে চায় পথের সকল বাধা। সেইসব যুবকদের সমূহ পরাভব কোনমতেই মানা যায়না। কবি শঙ্খ ঘোষ লক্ষ্য করেছেন আজকের যুবকদের ফুসফুস - ধমনী - শিরা বিষিয়ে গেছে। তাদের আরোগ্য দরকার। সেই কারণেই তার প্রার্থনা শহরে , প্রান্তরে , ধূসর শূন্যে 'আজান গান' ধ্বনিতে হোক। কবি শঙ্খ ঘোষ কিংবা সম্রাট বাবর তাদের জীবন , প্রাণচঞ্চলতা অনায়াসে দান করে দিতে চান যাতে সন্তান সুস্থ - সুন্দর ও স্বাভাবিক থাকে।  এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে জীবনানন্দ দাসের কথা , যিনি '' পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন '' নির্দেশ করেও '' ভালো মানব সমাজ '' গড়ার স্বপ্ন দেখেন। কবি শঙ্খ ঘোষও তাঁর '' বাবরের প্রার্থনা '' - কে করে তোলেন এই বিপন্ন সময় ও সমাজের তীব্র আকুতি।    


You May Also Like

0 comments