'' প্রিয়তমাসু '' কবিতাটি এক সৈনিকের আত্মকথন - কবিতা অবলম্বনে আলোচনা কর।

by - July 03, 2022

'' প্রিয়তমাসু '' কবিতাটি এক সৈনিকের আত্মকথন - কবিতা অবলম্বনে আলোচনা কর। 


সুকান্ত ভট্টাচার্যের '' প্রিয়তমাসু '' কবিতায় এক সৈনিকের আত্মকথা :-     

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রিয়তমাসু কবিতাটি যুদ্ধ , মানবতা , যুদ্ধের ভয়াবহতা ও ভালোবাসা - এই সকলের টানাপোড়েনকে নিয়ে রচিত একটি কালজয়ী কবিতা। কবিতার প্রতিটি ছত্রে যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণাম ও ভালোবাসার আকুল আর্তি ফুটে উঠেছে। মূলতঃ কবি সুকান্তের এই কবিতাটির মধ্যে যুদ্ধাহত এক প্রতিবাদী মানুষের অপরিসীম ভালবাসার গুঞ্জণ ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায় । মন যেন কী এক নিগূঢ় ক্রন্দনে বারবার ধরাশায়ী হয়, মনের কোনে হাজারও লুক্কায়িত বেদনার সুর যেন বারবার দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে। কবি এখানে প্রতিবাদী এবং ভালোবাসা থেকে দূরে থাকা এক প্রতিবাদী পথিক। এক সৈনিক রূপে কবি যুদ্ধ বিরোধী সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছেন। 


কবি সমাজ ও সামাজিক দায়িত্ব থেকে ছুটে গেছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। এদেশ থেকে ও দেশে। নিজেকে হারিয়েছেন নিরন্তর মানুষের প্রেমে। তাদের স্বপ্ন রচনা করতে গিয়ে নিজের স্বপ্নকে বলি দিতে চলেছেন। তবুও কবি আশাবাদী যে তার জন্যে কেউ অপেক্ষা করে থাকলেও থাকতে পারেন।
বিশ্বে চলছে আজ নিরন্তর মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলন। কবি সে আন্দোলনের এক নিবিড় সৈনিক। তিনি এক যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে আর এক যুদ্ধ ক্ষেত্রে ছুটে গেছেন অপ্রহত রাইফেল হাতে, ধূসর তিউনিসিয়া থেকে স্নিগ্ধ ইতালি, ইতালি থেকে তিনি ছুটে গেছেন ফ্রান্সে, সেখানে তিনি জয়, বন্ধুত্ব ও মুক্তির মন্ত্র নিয়ে আবারও ছুটে গেছেন প্রতিবেশী বার্মাতে/ মায়ামমাতে,  সেখানে তিনি পেয়েছেন নিষ্কণ্ঠক ঘরে ফেরার তাগাদা।

যুদ্ধ শেষ হলে প্রতিটা সৈনিকের ঘরে ফেরার তাগাদা চলে আসে, আসে সকল ক্ষয়ক্ষতির হিসেব-নিকেশ। কবিরও চলছে তেমন হিসেবের পালা। প্রতিবেশী দেশে তিনি থাকলেও স্বদেশে তিনি না ফিরে কোন কিছুই মেলাতে পারছেন না। বড়ই ব্যথিত মন, ব্যথিতের যাতনায় তিনি প্রশ্নবিদ্ধ। ভয়ানক দুর্বিষহ যাতনার মধ্যে তিনি ফেলে এসেছেন তার অকৃত্রিম ভালবাসার সবকিছু। কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, কখনো মন ফিরে আসার জন্যে বিদ্রোহী হয়ে উঠছে, এক লহমায় টেনে খুলে ফেলে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে তাঁর সৈনিকের ওই কড়া পোশাক। কিন্তু তিনি তা পারছেন না। তবুও তাকে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা খেলতেই হবে। নিরন্তর মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনতেই হবে।
অবশেষে কবির আত্মসমালোচনামূলক বাণী---
‘আমি যেন সেই বাতিওয়ালা,
যে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে
অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য,
নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার’।-------

এ এক অনবদ্য অনুভূতি! এ যুদ্ধ শুধু বাইরের জগতের সঙ্গে নয় , যুদ্ধ কবির নিজের সঙ্গেও। তিনি বলেছেন - 
পরের জন্যে যুদ্ধ করেছি অনেক,
এবার যুদ্ধ তোমার আর আমার জন্যে।
প্রশ্ন করো যদি এত যুদ্ধ ক’রে পেলাম কী? উত্তর তার-
তিউনিসিয়ায় পেয়েছি জয়,
ইতালীতে জনগণের বন্ধুত্ব,
ফ্রান্সে পেয়েছি মুক্তির মন্ত্র;
আর নিষ্কণ্টক বার্মায় পেলাম ঘরে ফেরার তাগাদা।

যুদ্ধ শুধুমাত্র যুদ্ধের বিরোধিতার জন্য নয় , সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার জন্য নয় - যুদ্ধ মানবতার জন্য , মানুষের অধিকার রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। যুগ যুগ ধরে অজস্র মানুষ শোষিত ও বঞ্চিত। সীমাহীন বঞ্চনা ও আপোষ তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে। আলোর ঠিকানা তাঁদের থেকে বহু দূরে। কবি যেন সেই সকল মানুষের প্রতিনিধিস্বরূপ সৈনিক। মানুষের জীবন , জীবিকা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার তাগিদে কবিকে যুদ্ধ করতে হবে। তাই কবির সংগ্রাম চিরন্তন ও অপ্রতিরোধ্য। 

পরিশেষে বলা যায় , প্রিয়তমাসু কবিতার মধ্যে দিয়ে কবি যুদ্ধাহত এক সৈনিকের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন - যার বুকে আছে কিছু প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের তাগিদে , বঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধি হয়ে , কবি সৈনিক রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। এই বিপ্লবাত্মক মনোভাব কবিতাটিকে আদর্শ ও প্রেরণামূলক করে তুলেছে। কবিতাটির মাধ্যমে মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের আহ্বান শুনতে পাওয়া যায়। এখানেই কবিতাটি বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে।   


You May Also Like

0 comments