কপোতাক্ষ নদ চতুর্দশপদী কবিতায় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্বদেশপ্রীতির পরিচয় দাও।

by - June 21, 2022

কপোতাক্ষ নদ চতুর্দশপদী কবিতায় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্বদেশপ্রীতির পরিচয় দাও। 

কপোতাক্ষ নদ চতুর্দশপদী কবিতায় বঙ্গভূমির প্রতি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের যে গভীর অনুরাগ ফুটে উঠেছে - তার পরিচয় দাও। 



কপোতাক্ষ নদ - কবিতায় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্বদেশপ্রীতির পরিচয় :- 

কপোতাক্ষ নদ কবিতাটি মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা একটি চতুর্দশপদী কবিতা বা সনেট। কপোতাক্ষ নদ কবিতার মধ্যে দিয়ে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্বদেশপ্রীতির পরিচয় পাওয়া যায়। কপোতাক্ষ নদ কবিতার মধ্যে দিয়ে কবি স্বদেশের প্রতি তাঁর আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন। ইউরোপীয় সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা লাভের ইচ্ছা নিয়ে তিনি পাশ্চাত্যে পাড়ি দিলেও - নিজ স্বদেশের কথা এবং বঙ্গভূমির প্রতিটি  বিষয়ের জন্য তাঁর হৃদয় সর্বদা ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। জননী বঙ্গভূমি যেন পরম মাতৃস্নেহে সর্বদা তাকে আহ্বান করছেন। সেজন্য বঙ্গজননীর তীব্র স্নেহ আহ্বানে তিনি বারবার স্বদেশে ফিরে যেতে চেয়েছেন। 


বস্তুতঃপক্ষে কপোতাক্ষ নদ হল কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাগরদাড়ি গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত একটি নদ। এই নদকে ঘিরে কবির শৈশবের বিভিন্ন ঘটনা , বিভিন্ন স্মৃতি - কবির স্মরণে ও মননে সদাজাগ্রত। শৈশবের সেই দিনগুলি , কপোতাক্ষ নদের স্মৃতি - ইত্যাদি কবি মনকে আকুল করে তোলে।  সেই সকল স্মৃতি যেন সর্বদা তাঁকে আহ্বান করে। কবির নিজের নিজের ভাষায় - 
'' সতত , হে নদ , তুমি পড় মোর মনে ! 
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে ; '' 
এই ছত্রটির মধ্যে দিয়েই কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত স্বদেশের প্রতি তাঁর তীব্র অনুরাগের পরিচয় দিয়েছেন। কপোতাক্ষ নদের স্মৃতি কবির মনে সদা জাগ্রত এবং একাকী সময়কালে সেই স্মৃতি আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। 

শুধু জাগ্রত অবস্থায় নয় - ঘুমের মধ্যে , স্বপ্নের মধ্যে - সর্বদা কপোতাক্ষ নদ এবং তার সাথে জড়িত স্মৃতি কবিমনকে উতলা করে। মানুষ ঘুমের মধ্যে এবং স্বপ্নের মধ্যে তীব্রভাবে কাঙ্খিত বিষয়কে উপলব্ধি করে , তার পেছনে ছুটতে থাকে এবং তাঁকে যেন কাছে পায়। এ যেন এক মায়ামন্ত্র - যা কবিমনকে এক অনাবিল আনন্দে ভরিয়ে তোলে। কবি বলেছেন - 
'' সতত ( যেমনি লোক নিশার স্বপনে 
শশানে মায়া মন্ত্রধ্বনি ) তব কলকলে 
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে ! '' 
এই ছত্রটির মাধ্যমে একথা পরিষ্কার যে , কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত মায়াময় স্বপ্নের মধ্যে কপোতাক্ষ নদের ধ্বনি শুনতে পান এবং এভাবেই কবি দেশান্তরে নিজের জন্মভুমিকে উপলব্ধি করেন। 


পাশ্চাত্য দেশে কবি বহু নদনদী প্রত্যক্ষ করেছেন। প্রতিটি ভূমিরূপ , প্রতিটি নদনদী আপন সৌন্দর্যে অপরূপ। সকল সৌন্দর্য দর্শনেই হৃদয় ও মন জুড়িয়ে যায়। কিন্তু শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত কপোতাক্ষ নদ যেভাবে কবি মনকে আকুল করে তোলে তা যেন আর কেউই করতে পারে না। কবি বলেছেন - 
'' বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ - দলে , 
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে ? '' 
এখানে কবি পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন - পৃথিবীর সকল নদী আপন সৌন্দর্যে মহিমান্বিত হলেও তার মধ্যে যেন স্নেহের ছোঁয়া নেই। কবির শৈশবের সেই কপোতাক্ষ নদ যেন মাতৃরূপে এবং মাতৃস্নেহ ছায়ায় কবিকে বেঁধে রেখেছেন। 

কবি পাশ্চাত্য দেশ গমনের পর সেখানে যেন মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এখানে কবির স্বদেশপ্রেম কপোতাক্ষ নদ-কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এখানে কবি কপোতাক্ষ নদের জলকে মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কবির ভাষায় - '' দুগ্ধ-সোতোরূপী তুমি জন্মভূমি - স্তনে। '' প্রবাসের জীবন যন্ত্রণাময় ও হতাশাক্লিষ্ট। সেই হতাশাময় জীবনে কবির স্মৃতিপটে বারবার উপস্থিত হয়েছে শৈশবের সেই কপোতাক্ষ নদের চিত্র। 

দেশান্তরে গিয়ে কবি শৈশবস্মৃতি যন্ত্রণায় কাতর। জীবনে হাজারো ব্যস্ততার মাঝে কবির মনে এ সংশয়ও এসেছে যে আর কখনো তিনি জন্মভূমিতে ফিরে যেতে পারবেন কি'না ! আর কখনো কপোতাক্ষ নদের কোলে তিনি পৌঁছতে পারবেন কি'না ! কবির নিজের ভাষায় - 
'' আর কি হবে দেখা ? '' 
কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে তিনি জননী মাতৃভূমির কাছে এ প্রার্থনাও করেছেন যে - কপোতাক্ষ নদ যেন কবিকে স্নেহময় পরশে জড়িয়ে রাখে ; বঙ্গভূমির মানব যেন তাকে বন্ধুভাবে মনে রাখে। 

পরিশেষে বলা যায় যে , '' কপোতাক্ষ নদ '' চতুর্দশপদী কবিতাটি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্বদেশপ্রেমের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই চতুর্দশপদী কবিতাটিতে কবির স্বদেশপ্রেম কেন্দ্রীভূত হয়েছে কপোতাক্ষ নদকে কেন্দ্র করে। স্বদেশ বঙ্গভূমির থেকে দূরে গিয়েই কবি উপলব্ধি করেছেন - স্বদেশ বঙ্গভূমির মাতৃরূপী মহিমা ও স্নেহস্পর্শের। তাই এই চতুর্দশপদী কবিতাকে স্বদেশপ্রেমের এক উৎকৃষ্ট  নিদর্শন বলা যেতে পারে। 

You May Also Like

0 comments