প্রতিবাদের নাটক হিসাবে নবান্ন নাটকের আলোচনা কর।

by - June 12, 2022

প্রতিবাদের নাটক হিসাবে নবান্ন নাটকের আলোচনা কর। 

নবান্ন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের নাটক - বিশ্লেষণ কর। 

'' নবান্ন একই সঙ্গে দুর্গতি ও প্রতিরোধের নাটক '' - আলোচনা কর। 




প্রতিবাদের নাটক নবান্ন :- 


বাংলা নাট্যজগতে এক প্রবাদপ্রতিম মানুষ হলেন বিজন ভট্টাচার্য। তাঁর লেখা নবান্ন নাটকটিকে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের নাটক হিসাবে বিবেচিত করা হয়। গণনাট্য হিসাবে নবান্ন নাটকটি প্রতিবাদের নতুন ভাষা সংযোজন করেছে। নবান্ন নাটকটি যে শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকেই সমৃদ্ধ করেছে তা নয় , তা সমকালীন বাঙালিদের মধ্যে অত্যাচারী সাম্রাজ্যবাদী শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক নতুন প্রেক্ষাপট রচনা করে। বস্তুতঃ নাটকটি তৎকালীন সময়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক আলোড়ন সৃষ্টি করে। 


নাটকের শুরুতেই নাটকের ঘটনাস্থল দেখা যায় আমিনপুর গ্রাম। এই আমিনপুর গ্রাম হল মেদিনীপুর জেলার অংশ। এই মেদিনীপুর জেলা ছিল তৎকালীন সময়ে বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পীঠস্থান। নাটকে দেখা যায় , সেই সময়ে বিপদ এসেছিল তিন দিক দিয়ে। 
প্রথমতঃ একদিকে ছিল , সাম্রাজ্যবাদী শাসকের প্রবল অত্যাচার ; গ্রামের পর গ্রাম লুঠ করা ; মানুষের সম্পত্তি ও প্রাণ হরণ করা ; মানুষের সকল অধিকার কেড়ে নেওয়া। 
দ্বিতীয়তঃ আবার অন্যদিকে ছিল - প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ভয়ঙ্কর বন্যা , ধ্বংসাত্মক ঝড় গ্রামগুলিকে একেবারে তছনছ করে দিয়েছে আর এর হাত ধরে এসেছে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী।  
তৃতীয়তঃ দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর সুযোগ নিয়ে একদল স্বার্থান্মেষী ও সুযোগসন্ধানী মানুষ কালোবাজারি করে , পণ্যের অবৈধ মজুদ করে সাধারণ মানুষকে অবাধ শোষণ করে চলেছে। 
এই তিন সমস্যার মুখোমুখি হয়ে গ্রাম বাংলার জীবন পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই দুর্যোগপূর্ণ , অত্যাচারক্লিষ্ট মানুষের প্রতিবাদের স্বরূপ উপস্থাপন করেছেন নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য তাঁর নবান্ন নাটকে। 

নাটকে দেখা যায় , গ্রামের সমাদ্দার পরিবারকে কেন্দ্র করেই নাটকের যাবতীয় ঘটনাক্রম আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু নাটকের বক্তব্য আমিনপুর গ্রাম বা সমাদ্দার পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি - তা দেশ কালের সীমা অতিক্রম করে শোষিত , দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জীবন পরিচয় ও প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছিল। নাট্যকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সমাদ্দার পরিবারকে সামনে রেখে তৎকালীন সামাজিক , অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চালচিত্রকে উপস্থাপন করেছেন। একদিকে সাম্রাজ্যবাদী শাসকের অত্যাচার ও অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ - এই দুয়ের যাঁতাকলে পড়েও আমিনপুর গ্রামের মানুষ প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। 

নাটকের প্রথম তিনটি অঙ্কে দেখা যায় , আমিনপুর গ্রামের অধিবাসীদের জীবন অত্যাচারী শাসকের অত্যাচারে জর্জরিত গ্রামের সচ্ছল পরিবারগুলিও চূড়ান্ত হীন হয়ে পড়েছে। সমাদ্দার পরিবারের মত সচ্ছল পরিবারের অবস্থায় অত্যন্ত সংকটের মধ্যে পড়েছে। আবার দুর্ভিক্ষ , মহামারী ,কালোবাজারি - ইত্যাদি বাংলার গ্রামগুলিকে শ্মশান করে তুলেছে। গ্রাম ছেড়ে মানুষ শহরে চলে আসছে একমুঠো অন্নের আশায়। কালিধনের মত কিছু অসাধু কিছু ব্যবসায়ী কালোবাজারির সঙ্গে সঙ্গে নারী ব্যবসাও শুরু করেছে। এই সময় আবার একদল চিত্র সাংবাদিক সেই দুর্গতির ছবি তুলে ধরে '' বাংলার ম্যাডোনা '' নাম দিয়ে ছাপতে চায়। সবমিলিয়ে এক অসহায় অবস্থার চিত্র তুলে ধরেছেন নাট্যকার নাটকের প্রথম তিনটি অঙ্কে। 

কিন্তু , চতুর্থ অঙ্ক থেকেই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চিত্র তুলে ধরেছেন নাট্যকার। অসীম নির্যাতন , মহামারীর যন্ত্রনা , কালোবাজারির প্রকোপ - সমস্ত প্রতিকূল অবস্থা থেকে মানুষের উত্তরণ ঘটে ; মানুষ গ্রামে ফিরে আসে। তাঁরা জোট বাঁধে , নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে সম্মিলিত প্রতিরোধ ছাড়া এই অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব নয়। নিরঞ্জন - প্রমুখের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে প্রতিরোধ। প্রতিরোধের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে নতুন করে ধান চাষের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যুধিষ্ঠিরের শেখানো বুলির পরিবর্তে নিজ অভিজ্ঞতা উপর বিশ্বাস রেখে নিজেরাই আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের ভবিষ্যত কর্মপন্থা স্থির করে। '' ধর্মগোলা '' বা ধানের গোলা তৈরী করে তাতে ধান জমা করে নবান্ন উৎসবের প্রস্তুতি নেয়। 

কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে আমিনপুর গ্রামের মানুষেরা হঠাৎ করে তৈরী হওয়া প্রতিকূল পরিস্থিতির কথাও ভোলেনা। তারা বুঝতে পারে , শুধু ফসল ফলালেই সমস্যার সমাধান হবেনা। এর জন্য চাই সংঘবদ্ধতা ও ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ। সম্মিলিত প্রতিরোধের মাধ্যমেই ভবিষ্যত সমস্যার সমাধান সম্ভব। মন্বন্তরের বিপর্যয় দিয়ে নাটকের শুরু হলেও নাটকের শেষে নবজীবনের মহামন্ত্রের জয়গান শোনা যায়। বিপর্যস্ত মানুষ গ্রামে ফিরে এসে নতুনকরে সংঘবদ্ধভাবে বাঁচার ও প্রতিরোধের শপথ নিয়েছেন। মন্বন্তরের , শোষণ - ইত্যাদি চরম প্রতিকূল পরিস্থির মধ্যেও মানুষ নতুন ধান উৎপাদন করে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করেছে। এইভাবে অসহায়তা , প্রতিকূলতা , দুর্ভিক্ষ ও সমস্যার মধ্যে দিয়ে নাটকের শুরু হলেও পরিণতিতে নাটকটি হয়ে উঠেছে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের নাটক। 


You May Also Like

0 comments