দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে কুতুবউদ্দিন আইবকের ভূমিকা আলোচনা কর।

by - June 29, 2022

দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে কুতুবউদ্দিন আইবকের ভূমিকা আলোচনা কর। 

দিল্লির সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। 

স্বাধীন সুলতানির সূচনায় কুতুবউদ্দিন আইবকের ভূমিকা। 

Role of Qutubuddin Aibek to established Delhi Sultanate. ( In Bengali )  




দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে কুতুবউদ্দিন আইবকের ভূমিকা :-    

কুতুবউদ্দিন আইবক ১২০৬ - ১২১০ খ্রিস্টাব্দ। 

 
প্রথম জীবন :- 
কুতুবউদ্দিন আইবকের জন্ম হয় তুর্কিস্থানের এক উপজাতি পরিবারে এবং জাতিতে তিনি ছিলেন তুর্কি। কিন্তু খুব ছোটবেলাতেই তিনি ক্রীতদাসে পরিণত হন। এক দাস ব্যবসায়ী নিশাপুর নামক স্থানে তাঁকে নিয়ে এলে নিশাপুরের কাজী তাঁকে ক্রয় করেন এবং তাঁকে সাহিত্য , দর্শন ও সামরিক শিক্ষা প্রদান করেন। কিন্তু এরপর সেই কাজীর মৃত্যু হলে পুনরায় কুতুবউদ্দিন ক্রীতদাসে পরিণত হন এবং মোহাম্মদ ঘোরী তাঁকে ক্রয় করেন। 


মহম্মদ ঘোরীর প্রভাব :- 
মহম্মদ ঘোরী কুতুবউদ্দিনকে দাস হিসাবে ক্রয় করার পর তাঁর সাহিত্য প্রতিভা , সামরিক প্রতিভার পরিচয় পান। তাঁর রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে মহম্মদ ঘোরী তাঁকে প্রথমে একজন সাধারণ সৈনিক পদে নিযুক্ত করেন এবং তারপর '' আমির -ই - আখৌর '' বা অশ্ববাহিনীর অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। 

মহম্মদ ঘোরীর ভারত আক্রমণ ও কুতুবউদ্দিনের কৃতিত্ব :- 
১১৯১ খ্রিস্টাব্দে তরাইনের প্রথম যুদ্ধে এবং ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে কতুবউদ্দিন মহম্মদ ঘোরীর সেনাপতি হিসাবে দক্ষতার পরিচয় প্রদান করেন। তরাইনের যুদ্ধের পর মহম্মদ ঘোরী ভারত ত্যাগ করলে তাঁর বিজিত রাজ্যগুলির দায়িত্ব কুতুবউদ্দিনের উপর অর্পিত হয়। 

রাজ্যজয় ও বৈবাহিক সম্পর্ক :- 
১১৯২ থেকে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি একে একে হান্সি , মীরাট , দিল্লি , বারাণসী , রণথম্ভোর জয় করেন। এরপর ১১৯৭ খ্রিস্টাব্দে ও ১১৯৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি কনৌজ ও কালিঞ্জর জয় করেন। এইভাবে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘোরীর মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি উত্তর ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তুর্কি প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেন। 
এছাড়াও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিতার পরিচয় দিয়ে তিনি তাঁর বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। 
প্রথমতঃ তিনি মহম্মদ ঘোরীর প্রধান সেনাপতি তাজউদ্দিনের কন্যাকে বিবাহ করেন। 
দ্বিতীয়তঃ মুলতানের শাসনকর্তা নাসিরুদ্দিন কুবাচার সঙ্গে নিজ ভগিনীর বিবাও দেন। 
তৃতীয়তঃ নিজ কন্যার সঙ্গে ইলতুৎমিসের বিবাহ দেন। 

সিংহাসনারোহণ :- 
মহম্মদ ঘোরী মৃত্যুর পূর্বেই কুতুবউদ্দিনকে ভারতে নিজ বিজিত রাজ্যগুলির উত্তরাধিকারী মনোনীত করে গিয়েছিলেন। মহম্মদ ঘোরীর মৃত্যুর পর ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে লাহোরের তুর্কি নাগরিকদের আমন্ত্রণে '' মালিক '' উপাধি ধারণ করে দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। এরপর ১২০৮ খ্রিস্টাব্দে গজনীর সুলতান তথা মহম্মদ ঘোরীর উত্তরাধিকারী গিয়াসউদ্দিন মামুদ কুতুবউদ্দিনকে '' সুলতান '' উপাধিতে ভূষিত করেন। 


কুতুবউদ্দিনের সমস্যা :- 
১২০৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতানির সূচনা করেই কুতুবউদ্দিন একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হন। সমস্যাগুলি হল - 
(১) সিংহাসনে কুতুবউদ্দিনের কোনো বৈধ অধিকার ছিল না। কেননা একদিকে তিনি ছিলেন দাস এবং অন্যদিকে মহম্মদ ঘোরী তাঁকে সরাসরি উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করেন নি। 
(২) তাজউদ্দিন দিল্লির সিংহাসনের উপর নিজের অধিকার দাবী করেন। 
(৩) ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘোরীর মৃত্যুর পর রাজপুত শাসক ও রাজন্যবর্গ কুতুবউদ্দিনের বিরোধিতা করতে থাকেন। 
(৪) মধ্য এশিয়ার আলাউদ্দিন মহম্মদ গজনি ও দিল্লি দখলের চেষ্টা শুরু করলে কুতুবউদ্দিনের নিকট এক প্রতিকূল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। 

সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ :- 
উক্ত সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য কুতুবউদ্দিন একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন - 
(১) ১২০৮ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘোরীর উত্তরাধিকারী গিয়াসউদ্দিন ঘুর কুতুবউদ্দিনকে '' সুলতান '' উপাধিতে ভূষিত করেন। এর ফলে কুতুব দাসত্ব থেকে মুক্তি পান। 
(২) তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়ে তিনি কঠোর হাতে তাঁকে দমন করেন। 
(৩) রাজপুত রাজন্যবর্গের প্রতি তিনি বিচ্ছিন্ন ও নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেন। 
(৪) বাংলার শাসনকর্তা আলিমর্দানকে নিজ পদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। 
(৫) সাম্রাজ্যের সর্বত্র এক কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। 
(৬) সামরিক শক্তিকে সুদৃঢ় করেন। 

রাজ্যশাসনের প্রকৃতি :- 
কুতুবউদ্দিন মাত্র চার বছর রাজত্ব করেন। মূলতঃ সামরিক শক্তির উপরেই তাঁর সাম্রাজ্যের ভিত রচিত হয়েছিল। তিনি শাসন সংক্রান্ত ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো সংস্কার সাধন করেন নি। বিভিন্ন অঞ্চলের শাসনভার স্থানীয় কর্মচারীদের উপর ন্যাস্ত ছিল। কুতুবউদ্দিন পূর্ববর্তী রাজস্ব ব্যবস্থাকে অপরিবর্তিত রেখেছিলেন। গ্রাম ও শহরে মুসলমান শাসনকর্তারা সেনাধ্যক্ষ ও কাজীর সাহায্যে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। যদিও কুতুবউদ্দিন ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন উদারচেতা। তাই মুসলিম সাহিত্যিকরা তাঁকে '' লাখবক্স '' উপাধিতে ভূষিত করেছেন। 

ডক্টর নিজামি কুতুবউদ্দিন সম্পর্কে বলেছেন - '' Aibek was a military leader par - excellence .'' কুতুবউদ্দিনের কৃতিত্ব সম্পর্কে ডক্টর হাবিবুল্লাহ বলেছেন - '' He combined the intrepidity of the Turk with the refined taste and generosity of the Persion . ''        

সাহিত্য , শিল্প - সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের প্রতি অনুরাগ :- 
কুতুবউদ্দিন শিক্ষাচর্চা ও সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন। ঐতিহাসিক হাসান নিজামি তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। এছাড়াও স্থাপত্যের প্রতিও কুতুবউদ্দিন গভীর অনুরাগী ছিলেন। তিনি দিল্লিতে '' কোয়াত - উল - ইসলাম '' নামে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এছাড়াও বিখ্যাত সুফী সাধক কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীর নাম অনুসরণে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে কুতুবউদ্দিন কুতুবমিনারের নির্মাণকার্য শুরু করেন।     

পরিশেষে বলা যায় , ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনেকেই কুতুবউদ্দিনকে দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করেন না। তবে , দিল্লি সুলতানির ভিত রচনা এবং সুলতানির সূচনার ক্ষেত্রে কতুবউদ্দিনের কৃতিত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায়না। ঘুর রাজ্যের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে তিনি স্বাধীন সুলতানির সূচনা করেন। ডক্টর হাবিবুল্লাহ কুতুবউদ্দিনকেই দিল্লি সুলতানির প্রধান স্থপতি বলে দাবী করেছেন।   


You May Also Like

0 comments