দিল্লি সুলতানির সংহতিসাধনে বলবন কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন ?

by - June 30, 2022

দিল্লি সুলতানির সংহতিসাধনে বলবন কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন ? 

দিল্লির সুলতানি আমল। দিল্লি সুলতানাত। 

গিয়াসউদ্দিন বলবনের কৃতিত্ব ও রাজতান্ত্রিক আদর্শ। 

রাজতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষায় বলবন কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন ?   

বলবনের নরপতিত্বের আদর্শ। 




দিল্লি সুলতানি সংহতিসাধনে বলবনের ভূমিকা :- 

সিংহাসনারোহনের পর বলবনকে বিবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সমস্যাগুলি হল - 
(১) ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরণী-র মতে , আইন - শৃঙ্খলার সমস্যা ছিল বলবনের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা। 
(২) দিল্লির নিকটবর্তী অঞ্চলগুলিতে মেওয়াটি ও অন্যান্য দস্যুদের উপদ্রবে জনজীবনে নিরাপত্তার অভাব দেখা দেয়। 
(৩) চল্লিশ চক্রের সীমাহীন ঔদ্ধত্য , আমির - ওমরাহদের ক্ষমতালিপ্সা , উদ্ধত ও ষড়যন্ত্রমূলক প্রবল সমস্যার সৃষ্টি করে। 
(৪) কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযোগে দেশে আইন - শৃঙ্খলার চূড়ান্ত অবনতি ঘটে , রাজপদের গুরুত্ব হ্রাস পায় , সাধারণ মানুষ সরকারের প্রতি আস্থা হারায় , রাজকীয় মর্যাদা শোচনীয়ভাবে খর্ব হয়। 
(৫) বহিরাগত মোঙ্গলদের ধারাবাহিক আক্রমণে সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত হয়। 

উক্ত সমস্যাগুলিকে দূর করে এক শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত শাসন ও রাজতন্ত্রের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। 


অরাজকতা দমন :- 
১. সুলতানি যুগের সূচনা থেকেই রাজপুতানার মেওয়াট নামক স্থানের অধিবাসীরা দিল্লি ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে দস্যুবৃত্তির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। মানুষের জীবন ও সম্পত্তির কোনো নিরাপত্তা ছিল না। এই সমস্যার অবসানকল্পে বলবন দিল্লির সন্নিহিত অঞ্চলের সব বন জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করেন , যাতে দস্যুরা সেখানে কোনোভাবেই আশ্রয় না পায়। এরপর অতর্কিত আক্রমণের দ্বারা তিনি বহু মেওয়াটিদের হত্যা করেন এবং তাদের গ্রামগুলি পুড়িয়ে দেন। এছাড়াও ঐসকল স্থানে পুলিশ ও সেনা - চৌকি স্থাপন করে আফগান সেনা মোতায়েন করা হয়। 

২. গঙ্গা ও যমুনার দোয়াব অঞ্চলের হিন্দু কৃষক ও জমিদাররা তুর্কি শাসন মেনে নিতে পারেন নি। তাদের উপদ্রবে সকল বাণিজ্যপথগুলি বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থায় বলবন বিদ্রোহী গ্রামগুলিতে আক্রমণ করেন। সকল সক্ষম পুরুষদের হত্যা করা হয় , নারী ও শিশুদের দাস - দাসীতে পরিণত করা হয়। সমগ্র অঞ্চলটিকে ছোট ছোট ইক্তা - য় ভাগ করে সেগুলির শাসনভার তুর্কি সেনাপতিদের হাতে দেওয়া হয়। 

৩. অযোধ্যার অন্তর্গত কাম্পিল , পাতিয়ালি - ইত্যাদি অঞ্চলের দস্যুদের উপদ্রবে সুলতানি সাম্রাজ্যের ব্যবসা - বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। বলবন উক্ত অঞ্চলগুলিতে দুর্গ নির্মাণ করে সেখানে আফগান সেনা নিয়োগ করেন। 

৪. এরপর তিনি কাটেহার - এর বদাউন , আমরাহো প্রভৃতি অঞ্চলের দস্যুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। কঠোর দমননীতি ও নৃশংস হত্যাকান্ডের মাধ্যমে ঐসকল অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। 

৫. ১২৬৮ - ১২৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি জাদ বা লবণ পর্বত এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিদ্রোহী খোক্কর উপজাতিদের দমন করেন। 


রাজকীয় আদর্শের প্রতিষ্ঠা :- 
ডক্টর কে এ নিজামি বলেছেন , দিল্লির সুলতানদের মধ্যে একমাত্র বলবনই খুব স্পষ্ট করে রাজতন্ত্র সম্পর্কে নিজ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আমির - ওমরাহদের শক্তি খর্ব করে রাজশক্তির মর্যাদা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তিনি কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেন - 
১. তিনি নিজেকে '' নায়েবৎ - ই - খুদাই '' বা ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে ঘোষণা করেন। 
২. তিনি '' জিল্লিলাহ '' উপাধি গ্রহণ করে ঘোষণা করেন তার কাজের জন্য তিনি ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। 
৩. তিনি কোনো সাধারণ মানুষ বা নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের সাথে সাক্ষাৎ বা বাক্যালাপ করতেন না। 
৪. তিনি পারসিক দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে দরবারে '' সিজদা '' ও '' পাইবস '' প্রবর্তন করেন। 
৫. তিনি সর্বদা ভীতি উদ্রেককারী দেহরক্ষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে রাজদরবারে প্রবেশ করতেন। 
৬. দরবারে সমস্ত রকম আমোদ - প্রমোদ , কৌতুক , মদ্যপান নিষিদ্ধ হয়। 
৭. একমাত্র '' উজির '' ছাড়া দরবারে কেউ তার সাথে কথা বলতে পারতো না। 

এইভাবে চূড়ান্ত গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে তিনি প্রমান করেন যে সুলতান সকলের উর্ধে। 

চল্লিশ - চক্রের উচ্ছেদ :- 
চল্লিশ চক্রের একজন হয়ে চল্লিশ চক্রকে সোপান হিসেবে ব্যবহার করে তিনি ক্ষমতায় আরোহন করলেও তিনি উপলব্ধি করেন , চল্লিশ চক্রই হল সুলতানের ক্ষমতার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী এবং রাষ্ট্রশক্তির প্রধান নিয়ামক। তাই তিনি চল্লিশ চক্রকে উচ্ছেদ করে নিজের এবং নিজের উত্তরাধিকারীদের সিংহাসন সুনিশ্চিত করতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কর্তব্যে অবহেলা বা তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলেই তিনি তাদের প্রতি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত , জরিমানা , মৃত্যুদন্ড , এমনকি বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করতেও তিনি বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত হতেন না। এইভাবে কঠোর ও নৃশংস পন্থা প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি চল্লিশ চক্রকে ধ্বংস করেন। তবে চল্লিশ চক্রের ধ্বংসের ফলে  তুর্কি শাসকগোষ্ঠী দুর্বল হয়ে পরে। 

শক্তিশালী গুপ্তচর বিভাগ গঠন :- 
সাম্রাজ্যের সকল প্রকার খবর , সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র - ইত্যাদি বিষয়ে সর্বদা অবগত থাকার জন্য বলবন এক শক্তিশালী গুপ্তচর বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর আমলে গুপ্তচরদের বলা হত - বারিদ। সাম্রাজ্যের সকল অংশে গুপ্তচরদের নিয়োগ করা হত। সৈন্যবাহিনীর উচ্চ পদাধিকারী , প্রাদেশিক শাসনকর্তা , আমির - ওমরাহ , রাজকর্মচারী , এমনকি রাজপরিবারের সদস্যদের উপরেও নজরদারি করার জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করা হত। 


প্রশাসনিক ব্যবস্থার সুদৃঢ়করণ :- 
বলবন প্রশাসনিক ব্যবস্থার সকল দুর্বল দিকগুলিকে চিহ্নিত করে সেগুলির সংস্কারসাধন করেন। তিনি কোনো রাজকর্মচারীদের হাতেই অধিক ক্ষমতা প্রদান করতেন না। প্রাদেশিক শাসনকর্তারা নিয়মিত সুলতানের কাছে প্রতিবেদন পাঠাতে বাধ্য থাকতেন। তৎকালীন সময়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত অঞ্চল ছিল - মুলতান ও লখনৌতি। এই দুই অঞ্চলে শাসনকার্যের জন্য বলবন সরাসরি তাঁর দুই পুত্র বুঘরা খাঁন ও মহম্মদকে দায়িত্ব অর্পণ করেন। ইক্তাদারদের হিসাব পত্র পরীক্ষা করার জন্য '' খোয়াজা '' নামক একশ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ করা হয়। 

সামরিক বাহিনীর সংস্কার ও শক্তিশালী সামরিক বাহিনী প্রতিষ্ঠা :- 
মধ্যযুগে সুলতানি শাসনের মূল ভিত্তি ছিল সামরিক বাহিনী। তাই বলবন একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সেই উদ্দেশ্যে বলবন বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন - 
১. শুধুমাত্র অল্পবয়স্ক যুবকদের সেনাদলে নিযুক্ত করা হয় ও জমির পরিবর্তে মাসিক নগদে বেতন দানের ব্যবস্থা করা হয়। 
২. সেনাবাহিনীর সদস্য বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি করা হয়। 
৩. স্বয়ং সুলতানের অধীনে একটি বৃহৎ সেনাদল মোতায়েন থাকে। 
৪. সেনাদলের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত অনুশীলন করা হত। 
৫. সেনাবাহিনীর উৎকর্ষতা বৃদ্ধির জন্য ইমাদ - উল - মুলক নামে এক ব্যক্তিকে যুদ্ধমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করেন। 

মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধ :- 
১. মোঙ্গলদের হাত থেকে সীমান্তের নিরাপত্তাবিধানের জন্য বলবন সীমান্ত অঞ্চলকে বলবন দুটি ভাগে ভাগ করেন - মুলতান ও দীপালপুর , সামানা অঞ্চল। মুলতান ও দীপালপুরের দায়িত্বে থাকে জ্যেষ্ঠ পুত্র সুলতান মহম্মদের হাতে এবং সামানা অঞ্চলের দায়িত্ব থাকে দ্বিতীয় পুত্র বঘরা খাঁ - এর হাতে।  
২. বিরাট অশ্বারোহী বাহিনী সীমান্তবর্তী অঞ্চলে নিযুক্ত হয়। প্রতিটি বাহিনীতে প্রায় আঠারো হাজার অশ্বারোহী সেনা ছিল। 
৩. সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বহু দুর্গ নির্মাণ করেন এবং সেগুলিতে সর্বদা সেনাবাহিনী নিযুক্ত থাকতো। 
৪. বলবনের ভাতুষ্পুত্র দুর্ধর্ষ সেনাপতি শের খাঁ - কে সমগ্র অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। 

বঙ্গদেশে বিদ্রোহ দমন :- 
বলবনের বার্ধক্য ও মোঙ্গল আক্রমণের সুযোগ নিয়ে বাংলার শাসনকর্তা তুঘ্রিল খাঁ ১২৭৮ খ্রিস্টাব্দে বলবনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তুঘ্রিলকে দমন করার জন্য অযোধ্যার শাসক মালিক তুরমাতি প্রেরিত হলে তিনি পরাজিত হন। এরপর স্বয়ং বলবন তুঘ্রিলের বিরুদ্ধে যাত্রা করেন এবং তুঘ্রিল রাজধানী লক্ষণাবতী ত্যাগ করে সোনারগাঁও ও সেখান থেকে উড়িষ্যা পলায়ন করেন। অবশেষে বলবনের অতর্কিত আক্রমণে তুঘ্রিলের সেনাবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তুঘ্রিল নিহত হন। বলবন তুঘ্রিলের অনুচরদের নির্মমভাবে হত্যা করে বাংলায় দিল্লি সুলতানির শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। 

কৃতিত্বের দিক দিয়ে বিচার করলে বলবনকে দিল্লির সুলতানদের অন্যতম বলা যেতে পারে। তিনি প্রায় চল্লিশ বছর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই সময়কালের মধ্যে তিনি মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধে এক সুদূরপ্রসারী ফলদায়ক ব্যবস্থা গড়ে তোলেন - এটি ছিল তাঁর রাজত্বকালের অন্যতম সাফল্য। এছাড়াও তৎকালীন সময়ে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল - তা দূর করে বলবন এক শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থার প্রণয়ন করেন। এর সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাজপদের গৌরবকে পুনরুদ্ধার করেন - এটি তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব। 

     

You May Also Like

0 comments