রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান চেতনার ফল '' বিশ্বপরিচয় '' প্রবন্ধ। - আলোচনা করো।

by - July 22, 2021

রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান চেতনার ফল '' বিশ্বপরিচয় '' প্রবন্ধ। - আলোচনা করো।  




রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার প্রয়োজন সম্পর্কে যখন বলেছেন তখনই সর্বজনীন শিক্ষা এবং সর্বাঙ্গীণ শিক্ষার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। কোনো একটি বা দুটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলেও সর্বাঙ্গীণ শিক্ষার অভাব যদি থেকে থাকে, তাহলে প্রকৃত শিক্ষার আলো মানুষের হৃদয়ে ও মনে প্রবেশ করতে পারে না। সেজন্যেই তিনি বলেছেন : ‘'বুদ্ধিকে মোহমুক্ত ও সতর্ক করবার জন্য প্রধান প্রয়োজন বিজ্ঞান-চর্চার।’' 
''বিশ্বপরিচয় '' প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথ উৎসর্গ করেছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। এতে ভূমিকাস্বরূপ ‘শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রীতিভাজনেষু’ শিরোনামের লেখাটি যুক্ত হয়েছে। 


রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই আধুনিক বিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিষ্কার ও উদ্ভাবনসমূহ সেকালের সাধারণ মানুষের চিন্তার জগৎকেও অভূতপূর্ব বিস্ময়ে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। পাশ্চাত্যের শিক্ষাজগতে ও চিন্তাজগতে সে-আলোড়নের ছায়াপাত ঘটেছিল অনেকটা স্বাভাবিক-ভাবেই। 

অবৈজ্ঞানিক মনকে বিজ্ঞানের যুক্তিনিষ্ঠতার পথে ধাবিত করানোর জন্যে প্রয়োজন শিক্ষা-কাঠামোর মধ্যে বিজ্ঞানশিক্ষার গুরুত্বকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া। তাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞানশিক্ষার প্রতি আগ্রহ যেমন বাড়ে, তেমনি বিজ্ঞানশিক্ষার সুযোগও বেশি করে সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-কাঠামোর বাইরেও বিজ্ঞানশিক্ষার চর্চা চলতে পারে নানা উপায়ে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে লেখা রচনাদি পড়া। 

তাঁর নিজের ভাষায় , '' আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সে কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু বালককাল থেকে বিজ্ঞানের রস-আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিল না। আমার বয়স বোধ করি তখন নয়-দশ বছর; মাঝে মাঝে রবিবারে হঠাৎ আসতেন সীতানাথ দত্ত মহাশয়। আজ জানি তাঁর পুঁজি বেশি ছিল না, কিন্তু বিজ্ঞানের অতি সাধারণ দুই-একটি তত্ত্ব যখন দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিতেন আমার মন বিস্ফারিত হয়ে যেত। '' 


রবীন্দ্রনাথ সেই তরুণ বয়সেই ‘সার্ রবার্ট বল্’, ‘নিউকোম্ব্স্’, ‘ফ্লামরিয়’ প্রভৃতি অনেক লেখকের জ্যোতির্বিজ্ঞান-বিষয়ক অনেক বই পড়ে ফেলেছিলেন। তারপর ‘সাহস করে’ পড়েছিলেন ‘প্রাণতত্ত্ব সম্বন্ধে হক্স্লির এক সেট প্রবন্ধমালা’। এই পড়াটার মাধ্যমে তিনি বিজ্ঞানের পন্ডিত হয়ে ওঠেননি, পান্ডিত্যের শক্ত গাঁথুনিও তাঁর মধ্যে ছিল না। ‘কিন্তু ক্রমাগত পড়তে পড়তে মনের মধ্যে বৈজ্ঞানিক একটা মেজাজ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। 

বিশ্বপরিচয় প্রবন্ধ থেকে রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি :- 


১. যে নক্ষত্র থেকে এই পৃথিবীর জন্ম, যার জ্যোতি এর প্রাণকে পালন করছে, সে হচ্ছে সূর্য। এই সূর্য আমাদের চারদিকে আলোর পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীকে ছাড়িয়ে জগতে আর যে কিছু আছে তা দেখতে দিচ্ছে না। কিন্তু দিন শেষ হয়, সূর্য অস্ত যায়, আলোর ঢাকা যায় সরে; তখন অন্ধকার ছেয়ে বেরিয়ে পড়ে অসংখ্য নক্ষত্র। বুঝতে পারি জগৎটার সীমানা পৃথিবী ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। কিন্তু কতটা যে দূরে তা কেবল অনুভূতিতে ধরতে পারি  নে। সেই দূরত্বের সঙ্গে আমাদের একমাত্র যোগ চোখের দেখা নিয়ে। সেখান থেকে শব্দ আসে না, কেননা শব্দের বোধ হাওয়ার থেকে। 
(‘পরমাণুলোক’, বিশ্বপরিচয়)

২. পদার্থের মধ্যে অণুগুলি পরস্পর কাছাকাছি আছে একটা টানের শক্তিতে। তবু সোনার মতো নিরেট জিনিসের অণুরও মাঝে মাঝে ফাঁক আছে। সংখ্যা দিয়ে সেই অতি-সূক্ষ্ম ফাঁকের পরিমাণ জানতে চাইলে, তাতে মন পীড়িত হবে। প্রশ্ন ওঠে একটুও ফাঁক থাকে কেন, গ্যাস থাকে কেন, কেন থাকে তরল পদার্থ। এর একই জাতের প্রশ্ন হচ্ছে, পৃথিবী কেন সূর্যের গায়ে গিয়ে এঁটে যায় না, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মান্ড একটা পিন্ডে তাল পাকিয়ে যায় না কেন। এর উত্তর, এই পৃথিবী সূর্যের টান মেনেও দৌড়ের বেগে তফাত থাকতে পারে। দৌড় যদি যথেষ্ট পরিমাণ বেশি হত তা হলে টানের বাঁধন ছিঁড়ে শূন্যে বেরিয়ে পড়ত, দৌড়ের বেগ যদি ক্লান্ত হত তা হলে সূর্য তাকে নিত আত্মসাৎ ক’রে। 


(‘পরমাণুলোক’, বিশ্বপরিচয়)

৩. এখন এই মত দাঁড়িয়েছে, ইলেক্ট্রনের ডিম্বাকার চলবার পথ একটি নয়, একাধিক। কেন্দ্র থেকে এই কক্ষগুলির দূরত্ব নির্দিষ্ট। কেন্দ্রের সবচেয়ে কাছের যে পথ, কোনো ইলেক্ট্রন তা পেরিয়ে যেতে পারে না। ইলেক্ট্রন বাইরের পথ থেকে ভিতরের পথে দর্শন দেয়। কেন দেয় এবং হঠাৎ কখন দেখা দেবে তার কোনো বাঁধা নিয়ম পাওয়া যায় না। 
(‘পরমাণুলোক’, বিশ্বপরিচয়)

৪. একদা মৌলিক পদার্থের খ্যাতি ছিল যে, তাদের গুণের নিত্যতা আছে। তাদের যতই ভাঙা যাক কিছুতেই তাদের স্বভাবের বদল হয় না।
(‘পরমাণুলোক’  বিশ্বপরিচয়)

৫. রাত্রের আকাশে মাঝে মাঝে নক্ষত্রপুঞ্জের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় লেপে-দেওয়া আলো। তাদের নাম দেওয়া হয়েছে নীহারিকা। এদের মধ্যে কতকগুলি সুদূরবিস্তৃত অতি হালকা গ্যাসের মেঘ, আবার কতকগুলি নক্ষত্রের সমাবেশ। দুরবীনে এবং ক্যামেরার যোগে জানা গেছে যে, যে ভিড় নিয়ে এই শেষোক্ত নীহারিকা তাতে যত নক্ষত্র জমা হয়েছে বহু কোটি তার সংখ্যা, অদ্ভুত দ্রুত তাদের গতি।
(‘নক্ষত্রলোক’, বিশ্বপরিচয়)

৬. চোখে দেখার যুগ থেকে এল দুরবীনের যুগ। দুরবীনের জোর বাড়তে বাড়তে বেড়ে চলল দ্যুলোকে আমাদের দৃষ্টির পরিধি। পূর্বে যেখানে ফাঁক দেখেছি সেখানে দেখা দিল নক্ষত্রের ঝাঁক। তবু বাকি রইল অনেক। বাকি থাকবারই কথা। আমাদের নক্ষত্র জগতের বাইরে এমন-সব জগৎ আছে যাদের আলো দুরবীন-দৃষ্টিরও অতীত। 

এই উদ্ধৃতিগুলি থেকে সহজেই বুঝতে পারা যায়, রবীন্দ্রনাথ কেবল যে ‘সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার ছাঁচ গড়ে দেবার’ ইচ্ছায় সফল হতে পেরেছিলেন তা নয়, বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করার কাজেও কোনো শৈথিল্য দেখাননি। পরমাণুলোকের অভ্যন্তরের চিত্র কিংবা নক্ষত্রলোকের অপরিমেয় বিশালতার ব্যাপ্তি এতে সহজভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক তথ্য ও ব্যাখ্যার ঘাটতি তাকে মোটেও খর্ব করেনি। 

‘পরমাণুলোক’, ‘নক্ষত্রলোক’, ‘সৌরজগৎ’, ‘গ্রহলোক’ ও ‘ভূলোক’ – এই পাঁচটি অধ্যায় ছাড়াও বিশ্বপরিচয় বইটিতে আছে একটি সংক্ষিপ্ত উপসংহার। বিশ্বপরিচয়ের প্রথম সংস্করণে পঞ্চম অধ্যায়টির ছিল ‘পৃথিবী’; দ্বিতীয় সংস্করণে অধ্যায়টির নাম পরিবর্তন করে ‘ভূলোক’ নাম রাখলেন রবীন্দ্রনাথ। বিজ্ঞানের বই রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত পড়তেন, এমনকি পত্রপত্রিকায় নতুন বইয়ের সমালোচনা পড়েও তিনি সেসব বই সংগ্রহ করে পড়ার জন্য উদ্গ্রীব থাকতেন। বিশ্বপরিচয় লেখার সময়ও রবীন্দ্রনাথ বইটিতে বিজ্ঞানের সর্বশেষ তথ্য দেবার আকাঙ্ক্ষায় নিয়মিত বই সংগ্রহ করেছেন, এমনকি বিলেত থেকেও বই আনিয়েছেন অথবা আনানোর জন্য তালিকা তৈরি করে দিয়েছেন। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ছোটোদের পত্রিকা বালকের সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র চবিবশ বছর। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী রবীন্দ্রনাথের মেজবউঠাকুরানী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী বালক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সহযোগী ছিলেন এবং কার্যত সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব তিনিই পালন করে যেতেন। গল্প, উপন্যাস, কবিতা ছাড়াও বালকের পাতায় ‘বৈজ্ঞানিক সংবাদ’ও লিখতেন রবীন্দ্রনাথ। তাতে অনেক অজানা তথ্য এবং মজার কথা থাকত। অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষকে মূঢ়তার অভিশাপ থেকে মুক্ত করার ইচ্ছাই ছিল তাঁর বিজ্ঞানচর্চার মূল উদ্দেশ্য, কেননা আধুনিক সংস্কারমুক্ত জীবনবোধ তৈরি না হলে মনের অন্ধকার ও জীবনের অন্ধকার কখনো অপসৃত হয় না।

You May Also Like

0 comments