মৌর্য শাসন ব্যবস্থা আলোচনা কর। সম্রাট অশোকের আমলে মৌর্য শাসন ব্যবস্থায় কী কী পরিবর্তন দেখা যায় ?

by - February 25, 2022

মৌর্য শাসন ব্যবস্থা আলোচনা কর। সম্রাট অশোকের আমলে মৌর্য শাসন ব্যবস্থায় কী কী পরিবর্তন দেখা যায় ?  

Examine the Mauryan administration under Chandragupta Maurya . Did Asoka bring about any major changes ? ( In Bengali ) 

Mauryan administration ( In Bengali ) 



মৌর্য শাসন ব্যবস্থা 


তথ্য সূত্র : মেগাস্থিনিসের বিবরণ , কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র , অশোকের শিলালিপি - ইত্যাদি থেকে আমরা মৌর্য শাসন ব্যবস্থা সংক্রান্ত তথ্যাদি পেয়ে থাকি। 

রাজা : সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী :-
মৌর্য রাজারা ভগবানপ্রদত্ত ক্ষমতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। রাজা ছিলেন একাধারে সর্বোচ্চ কার্যনির্বাহক , প্রধান বিচারপতি , প্রধান সেনাপতি ও আইন প্রণেতা। আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা একমাত্র রাজার ছিল। তাঁর ইচ্ছানুসারে মন্ত্রী , অমাত্য , সেনাপতি - ইত্যাদি উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা নিযুক্ত ও পদচ্যুত হতেন। সর্বোচ্চ সামরিক ক্ষমতার অধিকারী রাজা যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যাপারে তার চরম প্রভাব প্রতিফলিত করতেন। অনেক সময় রাজা স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থাকতেন। অর্থশাস্ত্র অনুসারে মৌর্য রাজারা সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।


মন্ত্রী ও মন্ত্রী পরিষদ :-
মন্ত্রীদের অশোকের আমলের '' মহাপাত্র '' দের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। মন্ত্রীরা রাষ্ট্রের সকল ব্যাপারে রাজাকে পরামর্শ দিতেন। অর্থশাস্ত্র অনুসারে মন্ত্রীদের বাৎসরিক বেতন ছিল ৪৮০০০ টাকা। Dr. R. C. Majumdar  মন্ত্রী ও মন্ত্রীপরিষদকে যথাক্রমে Executive Council ও Legislative Council  বলে অভিহিত করেছেন। গুরুতর সমস্যার আলোচনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ আহ্বান করা হতো। প্রদেশপাল , উপরাজ্যপাল , প্রধান বিচারপতি , নৌ - সেনাপতি - প্রভৃতি উচ্চ পদস্থ রাজকর্মচারী নিয়োগের ব্যাপারে মন্ত্রী পরিষদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। 
এছাড়াও ছিল প্রধান সচিব বা অমাত্য - রা। এরা শাসন ও বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতেন। এছাড়াও '' অধ্যক্ষ '' বা ম্যাজিস্ট্রেটরা শাসন বিভাগের সাথে যুক্ত ছিলেন। অর্থশাস্ত্রে এইরূপ ৩২ জন অধ্যক্ষের উল্লেখ পাওয়া যায়। 


সামরিক সংগঠন :-
অর্থশাস্ত্র অনুসারে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সামরিক বিভাগ ৩০ জন সদস্য বেষ্টিত একটি পরিষদের উপর ন্যাস্ত ছিল যা ৫ জন করে ৬ টি শাখাতে বিভক্ত ছিল। এই ৬ টি শাখা মোট ৬ টি বিভাগের দায়িত্ব পালন করতো। এই ৬ টি বিভাগ হলো - ১. পদাতিক , ২. অশ্বারোহী , ৩. যুদ্ধরথ , ৪. হস্তীবাহিনী , ৫. রসদ ও যানবাহন এবং ৬. নৌ - বাহিনী। নৌ - বাহিনীর সেনাপতিদের '' নাবাধ্যক্ষ '' বলা হতো। এর মতে , মৌর্য সম্রাটদের নৌ - বাহিনী  মিশর , সিরিয়া , এপিরাস - ইত্যাদি বিদেশি রাষ্ট্রগুলির সাথে সম্পর্ক স্থাপনে সহায়ক হয়েছিল। 
অর্থশাস্ত্র অনুসারে , তীর - ধনুক , বর্শা , কুঠার , তরবারি ছাড়াও '' স্থিতযন্ত্র '' ও '' চলযন্ত্র '' নামক দুটি স্বতন্ত্র অস্ত্রের অস্তিত্ব বর্তমান ছিল। 

পৌর শাসন - ব্যবস্থা :-
মেগাস্থিনিসের বিবরণী থেকে জানা যায় যে , রাজধানীর পৌর শাসনভার ৩০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত একটি পরিষদের ওপর ন্যাস্ত থাকতো। পরিষদটি ৫ জন করে ৬ টি বিভাগে বিভক্ত ছিল। যেমন - ১. প্রথম বিভাগ শিল্পকার্যের তত্ত্বাবধান করতো , ২. দ্বিতীয় বিভাগ বিদেশিদের তত্ত্বাবধান করতো , ৩. তৃতীয় বিভাগ জন্ম - মৃত্যুর হিসাব রাখতো , ৪. চতুর্থ বিভাগ ব্যবসা - বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতো , ৫. পঞ্চম বিভাগ শিল্পজাত পণ্যের বিক্রয়ের তত্ত্বাবধান করতো , ৬. ষষ্ঠ বিভাগ বিক্রিত দ্রব্যের ১/১০ অংশ কর আদায় করতো। নগরের পৌর শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে Basham মন্তব্য করেছেন - 
‘’ Conditions in the larger Mauryan cities approximated to those of a modern police state .’’


রাজস্ব ব্যবস্থা :-
সরকারের প্রধান আয় ছিল ভূমি রাজস্ব। জমির ফসলের ১/৬ অংশ ও উৎপন্ন দ্রব্যের ১/৮ অংশ থেকে ১/৪ অংশ পর্যন্ত '' বলি '' কর নেওয়া হতো। এছাড়াও '' ভাগ '' , ''হিরণ্য '' - ইত্যাদি কর প্রচলিত ছিল। বিক্রিত দ্রব্যের ১/১০ অংশ কর , জন্ম - মৃত্যু কর , জলকর - ইত্যাদি রাজস্ব আদায় করা হতো। 
রাষ্ট্রের সমস্ত জমির মালিক রাজা হলেও ব্যাক্তিগত মালিকানাও স্বীকৃত ছিল। ব্যাক্তিগত চাষ এবং মজুর নিয়োগ করে চাষ - উভয় প্রথাই প্রচলিত ছিল। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ক্রমশ প্রসারলাভ করতে শুরু করলে নিয়মিতভাবে জমি জরিপের গুরুত্ব অনুভূত হয় এবং দক্ষতার সাথে রাজস্ব আদায় করা রাষ্ট্রের অন্যতম কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়। সেই সময় রাজা ও কৃষকের মধ্যে '' মধ্যস্বত্তভোগী '' বলে কিছু ছিল না।  মৌর্য রাজস্ব ব্যবস্থার গুরুত্ব প্রসঙ্গে R.S. Sharma বলেছেন , 
‘’ The Maurya period constitutes a landmark in the system of taxation in ancient India .’’

বিচার - ব্যবস্থা :-
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিচারপতি রাজা শাস্ত্রজ্ঞ ও অভিজ্ঞ মন্ত্রী ও অমাত্যদের সাহায্যে বিচারকার্য সম্পাদন করতেন। অর্থশাস্ত্রে বিবিধ বিচারালয়ের উল্লেখ আছে। যেমন - ১. ধর্মস্থীয় , ২. কণ্টকশোধন , ৩. স্থানীয় , ৪. দ্রোনমুখ , ৫. সংগ্রহন - ইত্যাদি। অর্থশাস্ত্র অনুসারে , ধর্ম , চরিত্র , আচার , রাজানুশাসন - ইত্যাদি আইন বলে বিবেচিত হতো। দন্ডবিধি অত্যন্ত কঠোর ছিল। অর্থশাস্ত্রে '' সমস্থা '' ও '' সঞ্চরা '' নামে দুই শ্রেণীর ও স্ট্রাবোর রচনা থেকে ''পরিদর্শক '' নামক এক শ্রেণীর গুপ্তচরের উল্লেখ পাওয়া যায়। 


প্রাদেশিক শাসন - ব্যবস্থা :-
মৌর্য সাম্রাজ্যের ৫ টি প্রদেশ ছিল। যথা - ১. প্রাচ্য , ২. উত্তরাপথ , ৩. অবন্তী , ৪.  দক্ষিণাপথ ও ৫. কলিঙ্গ। এদের রাজধানীগুলি ছিল যথাক্রমে - পাটলিপুত্র , তক্ষশীলা , উজ্জয়িনী , সুবর্ণগিরি  ও তোসালি। সম্রাট নিজে রাজধানী থেকে প্রাচ্য শাসন করতেন। অন্যান্য প্রদেশগুলির ভার '' কুমার '' ও '' মহামাত্র '' উপাধিধারীদের হাতে ন্যাস্ত ছিল। প্রদেশগুলি কতকগুলি জনপদে বিভক্ত ছিল। এই জনপদগুলির শাসনভার '' সমাহরাত্রি '' নামক কর্মচারীদের হাতে ন্যাস্ত ছিল। জনপদের ১/৪ অংশের শাসনভার ছিল স্থানিকদের উপর। গ্রামের শাসনভার '' গোপ '' ও '' গ্রামিক '' দের উপর ন্যাস্ত ছিল। '' গ্রামিক '' রা রাষ্ট্র কর্তৃক নিযুক্ত হতেন না , এরা গ্রামবাসী কর্তৃক নিযুক্ত হতেন। 
এছাড়াও প্রদেশ সমূহে '' অন্তপাল '' ও '' দুর্গপাল '' নামক রাজকর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এরা সীমান্ত রক্ষা ও দুর্গ রক্ষার কাজে নিযুক্ত থাকতেন। 

অশোকের শাসন - ব্যবস্থা : শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন :- 


চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কর্তৃক প্রবর্তিত শাসন ব্যবস্থার মূল কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে তার উন্নতিকল্পে অশোক কিছু পরিবর্তন সাধন করেন। কলিঙ্গ যুদ্ধের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে অশোক নিম্নলিখিত পরিবর্তনগুলি সাধন করেন। তাঁর শাসন ব্যবস্থার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল জনকল্যান। তাই তিনি ঘোষণা করেছিলেন , 
‘’ All men are children , and just as I desire for my children that they may obtain every kind of welfare and happiness both in this and the next world , so I desire for all men .’’
-- Rock Edict VI .

সম্রাট অশোক কর্তৃক ঘটিত পরিবর্তন গুলি হলো - 

১. নতুন শ্রেণীর রাজকর্মচারী - অশোকের অনুশাসনলিপিতে নতুন চার শ্রেণীর রাজকর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা - রাজুক , যুত , মহামাত্র ও পুরুষ। 

২. ধর্মমহামাত্র - ধর্মমহামাত্রেরা ধর্ম ও নৈতিকতার কথা প্রচার করতেন। এরা বিচার সংশ্লিষ্ট ব্যাপারেও নিযুক্ত থাকতেন। 

৩. নগর শাসন - অর্থশাস্ত্র অনুসারে অশোকের আমলে তোসালি - ইত্যাদি বৃহৎ নগরীর ক্ষেত্রে পৌর শাসন ভার '' নগর ব্যবহারিক '' রাজকর্মচারীদের হাতে ন্যাস্ত হয়েছিল। 

৪. দণ্ডবিধির কঠোরতা হ্রাস - অশোক '' দন্ডসমতা '' ও '' ব্যবহার সমতা '' নীতির প্রবর্তন করে প্রচলিত দন্ডবিধির কঠোরতা অনেকাংশে হ্রাস করেছিলেন। 

৫. প্রতিবেদক - প্রজাবর্গের অবস্থা ও রাজকর্মচারীদের দায়িত্বপালন সম্পর্কে অবহিত থাকার জন্য অশোক '' প্রতিবেদক '' নামক এক নতুন শ্রেণীর রাজকর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন। 

পরিশেষে বলা যায় যে , চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কর্তৃক প্রবর্তিত শাসন ব্যবস্থার মূল কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে অশোক আপন আদর্শ অনুযায়ী শাসন ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করেছিলেন। শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের সাথে সাথে তিনি যুক্ত করেছিলেন জনকল্যাণকারী নীতি। তাই Dr. R.C. Majumdar মন্তব্য করেছেন - '' বিশ্বের শাসকদের মধ্যে অশোকের স্থান সর্বোচ্চে। ''


You May Also Like

0 comments